‘পাহাড়ে আসবি? ওখানে পাহাড়ি গ্রামে একটা স্কুল আছে বাচ্চাদের, স্কুলের দেয়ালে আঁকাআঁকি করবি আর কটা দিন পাহাড়ে ঘুরবি। আসবি নাকি?’
আমার একটু আঁকাআঁকির অভ্যাস আছে, এ কারণেই হয়তো পাহাড়ে যাওয়ার আহ্বানটা এভাবেই এসেছিল গ্যাব্রিয়েল পাংখোয়ার কাছ থেকে। গ্যাব্রিয়েল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, তার বাড়ি পাহাড়ে, জাতিতে সে পাংখোয়া। রাঙামাটির গভীর পাহাড়ে পাংখোয়াদের বাস।
আমি আজন্ম টইটই ধাঁচের মানুষ, আর পাহাড়ের কথা শুনলে আমার বুকের মধ্যে এমনিতেই কাঁপন জাগে। সেই আমি পাহাড়ে যাওয়ার এ রকম সুযোগ কি আর ছাড়ি। তার ওপর এটা ঠিক আর দশটা ভ্রমণের মতো নয়। গহিন পাহাড়ের ভেতরে আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে তাদের রোমাঞ্চকর জীবনযাপন দেখা, সঙ্গে কটা দিন ও রকম জীবনযাপন করা—এ রকম সুযোগ সহজে মেলে নাকি! তাই গ্যাব্রিয়েলের এক কথাতেই আমি যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলাম।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ, সারা দেশ তখন শীতে জবুথবু। আমি ব্যাগভর্তি শীতের জামাকাপড় আর বস্তাভরে রং, তুলি আর আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে রওনা দিলাম পাহাড়ের উদ্দেশে, আঁকার সঙ্গী হিসেবে জুটল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলার ছোট ভাই দিহান।
রওনা দিলাম, কথাটা যত সহজে লিখে ফেললাম, যাওয়ার পথটা মোটেই অতটা সহজ ছিল না। দুর্গম জায়গাটায় কীভাবে যেতে হবে, সেটা সম্পর্কেও স্পষ্ট জানাশোনা ছিল না আমার। গ্যাব্রিয়েল শুধু জানিয়েছিল বাসে করে ঢাকা থেকে কাপ্তাই গিয়ে বোটে উঠতে হবে আমাদের। বোট গিয়ে নামিয়ে দেবে বিলাইছড়িতে। আমাদের নেওয়ার জন্য লোক থাকবে সেখানে। তারপর ঘণ্টা দুয়েক মোটরসাইকেলে পাড়ি দেওয়া লাগবে পাহাড়ি রাস্তা। মোটরসাইকেলের রাস্তা শেষ হলে ঘণ্টাখানেক ট্রেকিং করে তারপরই আমরা পৌঁছাব পাহাড়ি ওই গ্রামে। ঢাকা থেকে সব মিলিয়ে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টার যাত্রাপথ!
ঢাকা থেকে কাপ্তাইয়ে পৌঁছালাম একেবারে ভোরবেলায়। কাপ্তাই জেটিঘাট থেকে বিলাইছড়ির উদ্দেশে বোট ছাড়ল সকাল সাড়ে আটটায়। সেখান থেকে জলপথে যাওয়া ছাড়া বিলাইছড়িতে যাওয়ার অন্য কোনো উপায় নেই। ইঞ্জিনের বোটে করে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লেগে যায় পৌঁছাতে। আমাদের দেশে যতগুলো পথ জলযানে করে যাওয়া লাগে, আমার মতে কাপ্তাই লেকের এই পথগুলোই সবচেয়ে সুন্দর। দুই ধারে সবুজ পাহাড়ের দেয়াল, সেই পাহাড়ে গাছপালার ভেতর দিয়ে উঁকি দেওয়া আদিবাসীদের বাঁশ-কাঠের বাড়ি, ওপরে খোলা আকাশ, তার নিচ দিয়ে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা হাজারও লেক আর সেই লেক পাহাড়ে গোলকধাঁধার মতো নৌপথে বাউলি কেটে নৌকা নিয়ে যাওয়া যে কী অদ্ভুত রোমাঞ্চকর, তা কেবল অভিযাত্রীরাই জানে!
ঘণ্টা দুয়েক নিপাট কুয়াশার ফাঁকফোকর দিয়েই কোনোমতে ধূসর পাহাড় দেখতে দেখতে একসময় বিলাইছড়িতে পৌঁছালাম। বিলাইছড়ি নৌঘাটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ইফদ সাঙ্গা পাংখোয়া দাদা। বলে রাখা ভালো, যে স্কুলটিতে আমরা ছবি আঁকতে যাচ্ছি, সেটা মূলত ‘চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে একটি সংগঠনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। সাধারণত পাহাড়ের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের উন্নয়নে কাজ করে এই সংগঠন। আর ইফদ দাদা এই সংগঠনেরই একটা অংশের ব্যবস্থাপক।
ইফদ দাদার হাসিমুখের অভ্যর্থনার ভেতর দিয়েই মূলত শুরু হলো আমাদের পাহাড়যাত্রার দ্বিতীয় ধাপ। এই ধাপটা যে এতটা রোমাঞ্চকর আর এমন দুর্গম হবে, সেটা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আমার। বিলাইছড়ি বাজার থেকে চালকসহ দুটো মোটরসাইকেল ঠিক করলেন ইফদ দাদা। একটাতে রঙের বস্তা, আমাদের ব্যাগব্যাগেজসহ ইফদ দাদা উঠলেন, আরেকটাতে চাপলাম আমি আর দিহান। ইটবিছানো উঁচু–নিচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আয়েশিভাবেই মোটরসাইকেল চালিয়ে যাত্রা শুরু করল পাহাড়ি মোটরসাইকেলচালক। সেই রাস্তায় পাহাড় দেখে এগোতে এগোতে মিনিট দশেকেই আমার মনে হচ্ছিল যে যাত্রাটা খুবই নিরামিষ ধাঁচের হবে। একই রকম রাস্তায় একই রকম আকাশ পাহাড় দেখতে দেখতেই যাত্রা শেষ।
কিন্তু আরও মিনিট দশেক এগোতেই আমার সে ভুল ধারণা ধপাস করে ভূপাতিত হলো! ইটবিছানো রাস্তা শেষ হতেই শুরু হলো ভাঙাচোরা আর খানাখন্দে ভরা মাটির রাস্তা, যার পুরোটাই পাহাড় কেটে বানানো হচ্ছে। একে তো বড় গামলা সাইজ খানাখন্দে ভরা রাস্তা, তার ওপর কখনো খাড়া পাহাড় উঠে গেছে পাঁচতলা বাড়িসমান উঁচুতে, পরক্ষণেই নেমে গেছে দশতলা সমান নিচে, সঙ্গে আচমকা ৯০ ডিগ্রির বেশি বিপজ্জনক বাঁকের তো অভাবই নেই! এই রাস্তায় শহুরে মানুষ হাঁটতেই দুবার ভাববে, আর সেই দুর্গম রাস্তায় মোটরসাইকেলচালকেরা মোটরসাইকেল চালানোর সাহস কীভাবে করছে, সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছিলাম। রাস্তার যা অবস্থা, তাতে দুর্ঘটনা না ঘটাটাই অস্বাভাবিক।
কিন্ত মোটরসাইকেলের চালক পার্কে ভোরবেলায় মর্নিংওয়াকে বের হওয়ার মতো নির্লিপ্ততার সঙ্গেই সেই দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় দুর্বার গতিতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। আমি পেছনে কাঠ হয়ে বসে আছি, আমার পেছনে দিহান। এমনকি খাড়া পাহাড়ি ঢালের ৯০ ডিগ্রি বাঁকেও গতি কমানোর কোনো নামই নিচ্ছেন না চালক। বাঁক ঘুরতে গিয়ে একটু এদিক–সেদিক হলেই যে খাড়া খাদ বেয়ে সোজা ১০০-২০০ মিটার নিচে গিয়ে আছড়ে পড়তে হবে, সে বিষয়ে কোনো দুশ্চিন্তাও নেই চালকের ভেতর। চালকের ভাবভঙ্গি এ রকম যে সকালের নাশতাতেই সে দুর্ঘটনা ঘটার সব আশঙ্কা পেট পুরে খেয়ে এসেছে।
চালকের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে আমিও বিপদের কথা ভুলে ভাঙাচোরা পাহাড়ি রাস্তার চারপাশে অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার দিকেই মনোযোগ দিলাম। বিপদ ও সৌন্দর্য যদি একই সঙ্গে আসে, তবে আমি সৌন্দর্যের দিকে মনোযোগ দিতেই বেশি আগ্রহী!
পাহাড়ের ওপরে ততক্ষণে বেশ রোদ উঠে গেছে, তেতে উঠেছে শীতল আবহাওয়া। শীতের একহারা আকাশের নিচে ঝলমল করছে সবুজ পাহাড়ের সমুদ্র। একটা পাহাড় থেকে আরেকটা পাহাড়ের মাঝের দূরত্বের কারণে সৃষ্ট উপত্যকার মতো ফাঁকা অংশগুলো দেখে মনে হচ্ছে ঠিক যেন সমুদ্রের ঢেউ।
সঙ্গে উষ্ণশীতল বাতাস বিলি কেটে যাচ্ছে গায়ে–মাথায়। রাস্তার ধারের সবুজ ঝোপে ঝলমল করছে দুধসাদা নাম না–জানা ধবধবে ফুল, ঝোপ থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়েই কখনো ত্রস্ত পায়ে ছুটে যাচ্ছে বনমোরগের দল, গাছে গাছে নেচে গেয়ে কলকাকলিতে মাতাচ্ছে হাজারো পাখি। জনমানুষের দেখা নেই বললেই চলে। অদ্ভুত এক শান্তি চারপাশে যেন ফুটিয়ে তুলছে বেঁচে থাকার আনন্দ।
এভাবে মিনিট চল্লিশেক যাওয়ার পর একসময় একটা পাহাড়ি পাড়ার সামনে পৌঁছালাম। ভাবলাম এইবার মনে হয় আমাদের মোটরসাইকেল যাত্রার ইতি। কিন্তু ইফদ দাদা জানালেন আমরা মাত্র অর্ধেক পথ এসেছি। আর সামনের পথ নাকি আরও বেশি বিপজ্জনক! এতক্ষণ আমরা যে রাস্তা অতিক্রম করে এসেছি, সামনের রাস্তার তুলনায় এটা নাকি মহাসড়ক!
পেরিয়ে আসা রাস্তা যে আসলেই মহাসড়ক ছিল, সেটা টের পেলাম মিনিট পাঁচেক পরেই। বাকি রাস্তাকে রাস্তা বললে রাস্তাকেই অপমান করা হবে একপ্রকার। রাস্তা বলতে সামনে আসলে রাস্তা বলে কিছু নেই। খেতের মধ্য দিয়ে যেমন আল থাকে, সে রকম এক থেকে দেড় ফুট চওড়া রাস্তা উঁচু–নিচু পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে। রাস্তার এক পাশে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে আকাশ ছুঁতে, অন্য দিকে হাত চারেক পাশেই নেমে গেছে খাড়া খাদ, একেবারে পাতালপুরীতে। মোটরসাইকেল সামান্য এদিক–সেদিক হলেই উঁচু পাহাড় থেকে সোজা ছিটকে পড়া লাগবে কয়েক শ ফুট নিচে। পপাত ধরণিতল যাকে বলে আরকি। একবার পড়লে আর কোনো কিছুতেই রক্ষা হবে না, এমন ভয়াবহ এ রাস্তা।
এমন দুর্গম, রোমাঞ্চকর রাস্তার গল্প বইতে পড়েছিলাম, ভিডিওতে দেখেছি দু–একবার। কিন্তু সামনাসামনি যে কখনো দেখার সুযোগ হবে, এটা ভাবিনি। রাস্তার এই দুর্গম অবস্থার কারণেই সাধারণত শুধু শীতকালে এসব এলাকায় বাইকে যাওয়া যায়। আর বর্ষার সময় পায়ে হাঁটা ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই।
পাহাড়ের এই দুর্গম রাস্তায় বাইক রাইডিঙের অভিজ্ঞতা যে কী ভয়ানক রোমাঞ্চকর, তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যারা এই রাস্তায় বাইক চালানোর সাহস করে তাদের সকাল–বিকেল স্যালুট করা উচিত! আরও মিনিট চল্লিশেক এই রাস্তায় জান হাতে করে বাইকে চেপে অবশেষে আমাদের বাইকযাত্রা শেষ হলো ধুপপানি গ্রামে পৌঁছে। ধুপপানি গ্রামের ঠিক নিচেই একটা নয়নাভিরাম ঝরনাও রয়েছে, নাম ধুপপানি ঝরনা। আদিবাসী তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় ধুপ মানে সাদা, মূলত সাদা পানির ঝরনা থেকেই ধূপপানি ঝরনা নামকরণ হয়েছে।
দেশের যতগুলো বড় মাপের অনিন্দ্যসুন্দর ঝরনা রয়েছে, তার মধ্য ধুপপানি একেবারে প্রথম সারির। এই ঝরনা এতই বিশাল যে ভরা বর্ষায় প্রায় দুই কিলোমিটার দূর থেকেও ঝরনার পানি পড়ার স্পষ্ট আওয়াজ পাওয়া যায়। শীতকাল হওয়ায় ঝরনা এখন প্রায় শুকনো, তাই ঝরনার একেবারে ওপরে দাঁড়িয়েও আমরা কোনো আওয়াজ পেলাম না। পানি না থাকায় আমাদেরও পাহাড় বেয়ে নেমে ঝরনা দেখার আগ্রহ হলো না। তার ওপর আমাদের গন্তব্যের পথ এখনো ঢের বাকি।
বাস, নৌকা, বাইকের পর এবার বাকি পথটা আমাদের হেঁটে যাওয়া লাগবে ঘণ্টাখানেক। এই হাঁটা পথ মোটেই সমতলের সোজাসাপটা আয়েশি হাঁটা পথের মতো না। পাহাড়ি পথ বেয়ে যেতে হবে ট্রেকিং করে, কখনো নেমে যাবে পাহাড়, কখনো উঠতে হবে খাড়া পাহাড়। আমাদের ব্যাগ, রঙের বস্তা নেওয়ার জন্য তিনজন পাহাড়ি আদিবাসীকে ঠিক করে রেখেছিলেন ইফদ দাদা। তারাই আমাদের মালামাল আদিবাসীদের ব্যবহৃত বিশেষ ঝুড়ি, যা কিনা মাথার সঙ্গে বাঁধা থাকে, তাতে তুলে রওনা দিল, পাহাড়ি পথ ধরে তাদের অনুসরণ করলাম আমরা।
কিছুক্ষণ পাহাড় বেয়ে নেমেই সামনে একটা ঝিরিপথ পড়ল, জানতে পারলাম এই ঝিরি দিয়ে নামা পানিই নিচে ধুপপানি ঝরনা হিসেবে অবিরত ঝরে পড়ছে। এখন শীতকাল, শুকনোর সময় বলে ঝিরিপথে পানির তোড় তেমন নেই। শুধু আয়েশি ভঙ্গিতে হালকা কুলকুল ঝংকার তুলে টানেলের মতো দুই পাশের সবুজ পাহাড় ভেদ করে আমাদের সামনে দিয়েই মিঠাপানির স্রোত ঝপাস করে নিচে পড়ে ধুপপানি ঝরনা নামে তার জেল্লা ছড়াচ্ছে। সে এক তন্ময় হয়ে দেখার মতো দৃশ্য!
ঝিরিপথ পেরিয়ে, পাহাড়িদের জুমচাষের জমি আর জুমঘরের ওপর ঠিকরে পড়া শীতের মিষ্টি রোদ ছাড়িয়ে নয়নাভিরাম পাহাড়ি সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে নিতে মিনিট পঁয়তাল্লিশেক পাহাড় বেয়ে ঠিক মাঝদুপুরে আমরা প্রায় ১৭ ঘণ্টার যাত্রা শেষ করে ক্লান্ত শরীরে ঘামতে ঘামতে অবশেষে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত পাহাড়ি গ্রামটিতে। গ্রামের নাম লতা পাহাড়, ইউনিয়ন ফারুয়া, জেলা রাঙামাটি! আদিবাসী পাংখোয়ারা বসবাস করে এখানে।
লতা পাহাড়ের পাংখোয়াদের ছোট্ট এই গ্রামটা যে আমাদের পরের কটা দিন শান্তি আর আনন্দে মাতোয়ারা করে রাখবে, সেটা বুঝতে খুব দেরি হলো না। আমরা তাদের গ্রামে মেহমান হিসেবে এসেছি এটার জন্য যে তারা কী খুশি হয়েছে, সেটা এখানকার প্রত্যেক মানুষই উঠতে–বসতে বুঝিয়ে দিতে লাগল।
পুরো লতা পাহাড় গ্রামটা একটা পাহাড়ের ওপরেই অবস্থিত। পাংখোয়া নামের খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী আদিবাসীদের মাত্র ৩২টি পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট্ট এই ছিমছাম গ্রামটার জনসংখ্যা বাচ্চা বুড়ো সব মিলিয়ে ২০০ জনের মতো। যার মাঝে একটা বৃহৎ অংশ আবার পড়ালেখা কিংবা কাজের জন্য বাইরে থাকে। গ্রামের প্রায় সব খোলা জায়গা থেকেই দেখা যায় ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি, যে পাহাড় ঢেউ খেলতে খেলতে গিয়ে মিলেছে বান্দরবানের পাহাড়ের সঙ্গে। ওপরে উন্মুক্ত আকাশের সঙ্গে কোলাজ করা ওসব পাহাড়ের দিকে চোখ মেললেই পুরো জীবন জুড়িয়ে যায় একনিমেষে।
লতা পাহাড়ের এক পাশে মারমাদের ছোট একটা গ্রাম, আর বাকি সব দিকে পাহাড়ঘেরা। গ্রামে দুটো গির্জা, তিনটি চায়ের দোকান, আদিবাসীদের বানানো কাঠের ঘরবাড়ির বাইরে আছে শুধু একটা প্রাইমারি স্কুল। পাংখোয়া আর মারমাদের বাচ্চাকাচ্চা মিলে স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭০ জনের কাছাকাছি। মূলত এই স্কুলের নতুন পাকা বাড়ির দেয়ালে ছবি আঁকার জন্যই আমাদের এত দূরের অভিযান।
লতা পাহাড়ে পৌঁছানোর পর প্রথম দুটো দিন গ্রামে ঘুরে, ওখানের অধিবাসীদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দিলাম। ওদের ছেলে–বুড়ো সব বয়সীর কাছেই এখনো গুলতি থাকে, গুলতিকে ওরা বলে ‘সাইরুয়া’। সাইরুয়া দিয়ে ওরা পাখি শিকার করে। কেউ কেউ এখনো তির–ধনুকও ব্যবহার করে। আমাদের সামনেই একদিন তেঁতুলগাছে বসা একটা বুলবুলি তির মেরে নামিয়ে আনল একজন বুড়ো আদিবাসী। এই বয়সেও হাতের টিপ যে কী অসাধারণ, একবার তাক করেই হেসেখেলে মেরে ফেলতে পারে পাখি। এর বাইরে নানা রকম ফাঁদ পেতেও তারা পাখি ধরে। ঘুরে ঘুরে সেসব অতি সরল কিন্তু দারুণ কার্যকর সব ফাঁদও দেখলাম একদিন।
ওরা সবাই কাঠ আর বাঁশ দিয়ে বানানো বিশেষ পাহাড়ি বাড়িতে বসবাস করে। পাহাড়ের ঢালে শক্ত কাঠের খুঁটির ওপর বানানো ওসব বাড়ির নিচে তারা শূকর, ছাগল পোষে, রাখে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিসও।
পাংখোয়াদের ভাষা বাংলা না হলেও দিব্যি বাংলা বলতে পারে ওরা । কী দারুণ সহজ–সরল হাসিখুশি মানুষগুলো, আর কী যে আন্তরিক, সেটা না মিশলে বুঝতামই না। মুখ থেকে হাসি যেন হারাতেই চায় না। খাওয়ার পানির জন্যও রোজ সকাল–সন্ধ্যা ওদের কিলোমিটারখানেক পাহাড় বেয়ে নেমে ঝিরিতে গিয়ে ঘড়া, জগ বোতল ভর্তি করে আবার পাহাড় বেয়ে উঠে আসা লাগে। সব থেকে কাছের যে বাজার সেখানে যেতেও পাহাড় বাইতে হয় ঘণ্টা দেড়েক। হাসপাতাল বলতে আশপাশে তেমন কিছু নেই। জুমচাষ ছাড়া তাদের আয়ের আর তেমন কোনো উৎসও নেই। কিন্তু এত সংকটের মধ্যেও যে এমন হাসিখুশি থাকা যায়, সেটা পাহাড়ি আদিবাসীদের কাছ থেকে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।
আমরা স্কুলে ছবি আঁকার কাজ শুরু করার পরই দর্শক হিসেবে গায়ের ছেলে–বুড়োদের জুটে যেতে সময় লাগল না। আমি আর দিহান আঁকি আর তারা তন্ময় হয়ে একমনে আমাদের সেসব রঙিন কারসাজি দেখে ঠায় দাঁড়িয়ে। কখনো এটা–ওটা জিজ্ঞেস করে, মজা করে বলে এটা-সেটা। ওদের সঙ্গে আমাদের রঙিন সময় দিব্যি কেটে যায় হাসি–তামাশায়। স্কুলের বাচ্চাদের অনেকেই এখনো বাংলা শেখেনি, একটু–আধটু বুঝতে পারলেও বাংলা তেমন বলতে পারে না ওদের অনেকেই। কিন্তু ওদের স্কুল যে রঙিন হচ্ছে, সেটার জন্য যে আনন্দ উপচে পড়ছে, সেটা বুঝিয়ে দিতে কোনো ভাষা ব্যবহার করা লাগছে না। ওদের উজ্জ্বল মুখ দেখেই সেটা দিব্যি বুঝতে পারি।
স্কুলের দেয়ালে আমরা মীনা আঁকি, টিনটিন আঁকি, পিনাটস আঁকি, চাঁদের পাহাড়ের শংকরকে আঁকি, মাদার তেরেসা আঁকি, রবীন্দ্রনাথ আঁকি, নজরুল আঁকি, শিশুশ্রম বন্ধ অথবা গাছ লাগানোর শিক্ষণীয় ছবি আঁকি, স্কুলের বাচ্চারা আনন্দের সঙ্গে সেই রঙিন সময়ের সাক্ষী হয়। পাহাড়ের গহিনে নাগরিক সুযোগ–সুবিধাবহির্ভূত দুর্গম জনপদে বেড়ে ওঠা এই শিশুর দল যে আমাদের আঁকা ছবির জন্য একটু হলেও আনন্দ পাচ্ছে, সেটাও আমার জন্য বিশেষ এক আনন্দের বিষয়।
এই আনন্দ নিয়ে আঁকতে আঁকতে আর পাহাড়ের অপার সৌন্দর্যে মন–প্রাণ জুড়াতে জুড়াতেই সপ্তাহখানেক কেটে গেল লতা পাহাড়ে।
সপ্তাহখানেক লতা পাহাড়ে কাটানোর পরই জানতে পারলাম গ্রামে দিন সাতেক পরেই বিয়ের উৎসব শুরু হবে। আমরা যেন অবশ্যই সেই বিয়েতে থাকি। আমাদের দাওয়াত। তত দিনে আমাদের কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেলেও ওদের চাপাচাপিতে দাওয়াত রক্ষা করতেই আমাদের থেকে যাওয়া লাগল আরও সপ্তাহখানেক।
আদিবাসীদের বিয়ে দেখা দারুণ এক অভিজ্ঞতা। তিন দিন নানা রকম কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে চলল তাদের বিয়ের সেই উৎসব। ছেলে–বুড়ো সবাই মিলে দিন–রাত কী যে আনন্দ করল, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমরা দুজন ছিলাম সেই বিয়ের বিশেষ অতিথি। কিন্তু ওদের আন্তরিকতায় নিজেদের একবারও অতিথি বলে মনেই হলো না, পুরো সময়টা মনে হচ্ছিল আমরা ওদেরই একজন, আমরা পাহাড়েরই মানুষ!
সারাক্ষণ ফুর্তিতে মেতে থাকা ছোট্ট এই পাহাড়ি গ্রামটা শান্তির এক অদ্ভুত নিদর্শন যেন। মূলত জুমচাষ করেই তদের জীবন চলে। তাদের ভেতর নেই কোনো কলহ, নেই কোনো কোন্দল। একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে তারা বাস করে দারুণ সংঘবদ্ধভাবে।
রোজ সন্ধ্যায় এখানে গির্জায় ঘণ্টা বাজে, পাড়াসুদ্ধ লোক সব কামকাজ ফেলে গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনার আওয়াজ কলরব করে ছোট্ট পাড়ার প্রতিটি কোণে বয়ে নিয়ে যায় শান্তির বার্তা। শুধু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গির্জায় কোনো প্রার্থনা হয় না।
রোববার তাদের পবিত্র দিন, সেদিন কেউ কোনো কাজে যায় না। গির্জায় গিয়ে আর পরিবারের লোকজনের সঙ্গেই সেদিন তারা সময় কাটায়। অবসরে আমি চায়ের দোকানে বসে তাদের জীবনের গল্প শুনি, তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প শুনি। শহর থেকে দূরে গহিন পাহাড়ের আড়ালে তাদের জীবনসংগ্রামের সেই গল্প অদ্ভুত এক মোহ হিসেবে ধরা দেয় আমার হৃদয়ে। কী তার আবেগ, কী তার আবেশ! সেই আবেশে মিশে গিয়ে আমি ইচ্ছেমতো ঘুরি ওখানকার পাহাড়ে, হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় বেয়ে নেমে যাই নিচের ঝিরিতে, একমনে শুনি পাখপাখালির হৃদয়ভোলানো বিশুদ্ধ সুর, যে সুরে মেশানো নেই ইট–কাঠের আর্তনাদ, নেই গাড়ি–ঘোড়ার কান ঝালাপালা হইহল্লা। ইচ্ছে হলেই গাছভর্তি ফলের গাছ থেকে ছিঁড়ে খাই তেঁতুল, বরই। কেউ মানা করে না, জিজ্ঞেস করে না কেন ছিঁড়লাম। এখানের সব গাছের ফল যেন সবারই। এ এক ইচ্ছেনগর যেন।
লতা পাহাড়ে রোজ সকাল হয় সূর্যের সোনাঝরা রোদ নিয়ে, উষার সেই স্বর্ণাভ রোদে আকাশে ঝলসে ওঠে সোনালি মেঘের দল। গোধূলিতে দূর পাহাড়ের আড়ালে আস্তে করে অস্ত যায় সূর্য। কাপভর্তি চা আর বিস্কুট নিয়ে আমি মুগ্ধ চোখে উদাস হয়ে সেই সৌন্দর্য গিলি। মাধুর্যমণ্ডিত তার রূপ, মায়াময় তার গরিমা!
লতা পাহাড়ের শীতল রাতের কুয়াশা ভেদ করে ঝলমল করে ওঠে পূর্ণিমার বিরাট চাঁদ, এতটাই বড় সে চাঁদ যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। এতটাই উজ্জ্বল সে জোছনা যে চাইলেই বই পড়া যায় সে আলোয়। জোছনার তোড়ে হেসে ওঠে সামনের বিশাল সব পাহাড়ের গা, আমাদের সামনের জুমচাষের একপশলা পাহাড়ি জমিটা মোলায়েম জোছনায় তকতক করে ওঠে, তার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয় জোনাকির দল। ঝোপঝাড়ে টিপিস টিপিস করে হলদে সবুজ আলো জ্বেলে জোছনাকে আরও গাঢ় করে তোলে জোনাকিরা। পাহাড়ের ঢালের মাথায় একটা সুন্দর পাহাড়ি বাড়ি, তার ওপাশে মেঘে ঢাকা উপত্যকা ছাড়িয়ে আরও দূরের পাহাড়ের দেয়ালও স্পষ্ট দেখা যায় সেই জোছনায়। জোছনায় মুহূর্তেই অপার্থিব এক মায়াপুরীতে পরিণত হয়ে যায় যেন লতা পাহাড়। আমি সেই নেশা ধরানো পাহাড়ি জোছনায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে হাবুডুবু খেতে থাকি।
দুটো সপ্তাহ ধরে অনুধাবন করা লতা পাহাড়ের ভোর, লতা পাহাড়ের সকাল, লতা পাহাড়ের গোধূলি, লতা পাহাড়ের রাত কোনোটার সৌন্দর্যের বর্ণনাই লিখে শেষ করা যাবে না। এখানের মানুষ, এখানের পাখি, এখানের গাছ, এখানের ঝিঁঝিপোকার ডাক, সবকিছুই যেন অন্য রকম সুন্দর, অন্য রকম মায়াময়।
সুবিধাবঞ্চিত পাহাড়ি শিশুদের স্কুলে ছবি আঁকার জন্য এসে যে এভাবে এখানের সৌন্দর্যে আটকে যাব, সেটা টের পাইনি শুরুতে। যখন টের পেলাম ততক্ষণে লতা পাহাড় নামের ছোট্ট এই পাহাড়ি গ্রামটার প্রতি, গ্রামের মানুষগুলোর প্রতি, এখানের অপার্থিব সৌন্দর্যের প্রতি আমার অন্য রকম এক মায়া জন্মে গেছে। এই মায়া অনুভবের মায়ার, এই মায়া বেঁচে থাকার মায়ার, এই মায়া মায়াপুরীর মায়া। মানুষের কাজই তো হচ্ছে মায়ায় জড়ানোর, এটা সে রকমই এক মায়া!