৫১ বিলিয়ন থেকে শূন্য

যেহেতু এই লেখা তুমি পড়ছ—আমরা কয়েকটা অনুমান করতে পারি।

১. তুমি একটা চেয়ারে বসে আছ। সেটা যদি প্লাস্টিকের তৈরি না–ও হয়ে থাকে, তোমার আশপাশেই কোথাও প্লাস্টিকের/সিমেন্টের/স্টিলের তৈরি কিছু একটা আছে।
২. তোমার মাথার ওপর একটা ফ্যান ঘুরছে। যদি রাত হয়ে থাকে, নির্ঘাত একটা আলোও জ্বলছে।
৩. কিশোর আলোর সংখ্যাটা হকার মামা তোমার হাতে দিয়ে গেছেন, কিংবা তুমি নিজেই দোকান থেকে আনার ব্যবস্থা করেছ।
৪. সারা দিনে একবার অন্তত কিছু খেয়েছ।
৫. সেই খাবার হয় ফ্রিজ থেকে বেরিয়েছে, নয়তো খাওয়া শেষে কিছু খাবার ফ্রিজে ঢুকেছে।

এই যে পাঁচটা ঘটনা—এই পাঁচটার মধ্যে মিল কোথায় বলতে পারো?

আমি বলে দিচ্ছি—সব কটিতেই একটা জিনিস ঘটেছে—কার্বন নিঃসরণ!

কার্বন নিঃসরণ—সেটা আবার কী?

যদি উত্তরটা না জানো, তাহলে এসো, হাত মেলাই। আমিও ঠিক বুঝতাম না, সবকিছুতে ‘কার্বন’ কেন বের হয়। এমনিতে তো আমি জানতাম, কার্বন মানে কয়লাটাইপ কিছু একটা; পেনসিলের শিষ যেমন হয়, অনেকটা অমন।

সারা জীবন ‘কার্বন নিঃসরণ’ শুনে শুনে (যদিও আমার জীবন বিশেষ লম্বা নয়!) একসময় আবিষ্কার করলাম, এর মানে আসলে ‘কার্বন ডাই–অক্সাইড বের হওয়া’! সংক্ষেপে এটাকে ‘কার্বন নিঃসরণ’ বলে ডাকা হয়।

তা হোক, এটা নিয়ে আমরা আলোচনা কেন করছি? কত কিছুতেই তো কত কিছু হয় (যেমন একটা কুকুরকে আদর করলে সে লেজ নাড়ায়, কোনো অভিনেতা ম্যাকবেথের নাম করে মঞ্চে নামলে তার সর্বনাশ ঘটে)—এর মধ্যে কার্বন নিঃসরণ হঠাৎ আলোচনায় আসছে কেন?

উত্তরটা হলো, ব্যাপারটার সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব জড়িত। তোমার, আমার, এবং পুরো মানবজাতির। ২১০০ সালে পৃথিবীতে কোনো মানুষ থাকবে কি না, যারা থাকবে, তারা আমাদের ভালোবাসবে, না শাপশাপান্ত করে ছাড়বে, সবকিছু নির্ভর করছে—অনেকখানি—এই কার্বন নিঃসরণের ওপর।

‘বড় চাচা, কেসটা কী?’

কেসটা বোঝার জন্য আমাদের একটু পেছন থেকে শুরু করতে হবে। কার্বন নিঃসরণ পৃথিবীর ইতিহাসে ঠিক নতুন কোনো ঘটনা নয়। আমরা যেসব প্রাণী দেখি, মোটামুটি সবাই নিশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন নেয়, আর শ্বাস ছাড়ার সময় কার্বন ডাই–অক্সাইড ছেড়ে দেয়, অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ করে!

মজার ব্যাপার হলো, মোটামুটি উনিশ শতকের শেষ পর্যন্তও কার্বন নিঃসরণ একটা ‘ভালো ব্যাপার’ ছিল! কারণ, কার্বন ডাই–অক্সাইডের একটা বৈশিষ্ট্য আছে, এটা তাপ ধরে রাখতে পারে। সূর্য থেকে যে উত্তাপটুকু পৃথিবীতে আসে, তার প্রায় সবটুকুই বেরিয়ে যেত, যদি কার্বন ডাই–অক্সাইড না থাকত। তখন পৃথিবী এত ঠান্ডা হয়ে যেত যে আমরা সবাই শীতে জমেই মারা যেতাম!

অর্থাৎ পৃথিবীর পুরো ইতিহাসটা ছিল এমন—প্রাণীরা নিশ্বাসের সঙ্গে কার্বন নিঃসরণ করে, সেই কার্বন পৃথিবীকে একটু গরম রাখে। আর অতিরিক্ত যে কার্বনটুকু থাকে, সেটা আবার গাছেরা টেনে নেয়, এরপর বাতাসে অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। ফলে পৃথিবীতে কার্বনের পরিমাণ খুব বেশিও থাকে না, আবার খুব কমও থাকে না। যেটুকু থাকে, সেটা পৃথিবীকে মোটামুটি উষ্ণ রাখে—যতটা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য দরকার।

সমস্যাটা শুরু হয় উনিশ শতকের শেষ দিকে (যারা ভুলে গেছ, তাদের আবার মনে করিয়ে দিই, ‘উনিশ শতক’ মানে কিন্তু ১৮০০ থেকে ১৮৯৯ সাল)। সেই সময়ের আগে মানুষ খুব বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করত না। কিন্তু উনিশ শতকের শেষে এসে হুট করে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে যায়। কলকারখানা থেকে শুরু করে বাসাবাড়ি—সবখানে বিদ্যুৎ একরকম অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

বিদ্যুৎ তৈরি করতে কয়লা পোড়াতে হয় আর কয়লা পোড়ালে যে জিনিস প্রচুর পরিমাণে বের হয়, সেটা হলো কার্বন ডাই–অক্সাইড।

অনেকেই এখন বুঝতে পারছ, সমস্যাটার সূত্রপাত কোথায়। বিদ্যুৎ তৈরির জন্য যখন আমরা কয়লা পোড়াতে শুরু করলাম, বাতাসে হুট করে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যেতে শুরু করল। এত বেশি বেড়ে গেল যে পৃথিবীর গাছেরা কার্বন টেনে কুলিয়ে উঠতে পারল না—কত আর টানবে!

সুতরাং বছরের পর বছর ধরে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বাড়তে থাকল। আমরা একটু আগেই জেনেছি, কার্বন প্রচুর তাপ ধরে রাখতে পারে। সুতরাং পৃথিবীর তাপমাত্রাও বাড়তে শুরু করল।

সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য এটাই যে তাপমাত্রাটা এত ধীরে ধীরে বাড়ে—চট করে টের পাওয়া যায় না। সত্যি বলতে কি, এতই ধীরে বাড়ে যে প্রথমবার শুনলে মনে হয়, এটা কোনো ব্যাপারই না!

করোনার সময় যখন সবকিছু বন্ধ ছিল, তখন প্রায় ৫%–এর মতো নিঃসরণ কমােনা গেছে

‘এটা কি আদৌ কোনো ব্যাপার?’

কথাটা অনেকেই বলে। কারণ, কার্বন নিঃসরণ যদি থামানো না যায়, তাহলে ২১০০ সালে গিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে মোটে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস!

শুনতে হাস্যকর মনে হতে পারে, এই সামান্য ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিয়ে আমরা দুর্ভাবনা করছি কেন?

করছি, কারণ বিপর্যয় ঘটানোর জন্য এটুকুই যথেষ্ট। পৃথিবীর ছোট্ট কোনো অঞ্চলে তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বাড়লে-কমলে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু সারা পৃথিবীতেই যদি তাপমাত্রা বেড়ে যায়, তাহলে ভয়াবহ কিছু ঘটনা ঘটতে পারে।

এই যেমন, শেষবার যখন বরফযুগ এসেছিল, পৃথিবীর তাপমাত্রা মাত্র ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস কম ছিল! ডাইনোসরদের যুগে তাপমাত্রা ছিল চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। তখন মেরু অঞ্চলের আশপাশে কুমির ঘুরে বেড়াত!

সত্যি বলতে কি, পৃথিবীকে এলোমেলো করে দিতে তাপমাত্রা তিন ডিগ্রিও বাড়তে হবে না। মাত্র আধা ডিগ্রির হেরফের ঘটলেই দশ মিলিয়ন মানুষ মারা যেতে পারে—প্রচণ্ড গরমে, পানিস্বল্পতায় কিংবা বন্যায়। আর যদি আসলেই তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি বেড়ে যায়, তাহলে কী হবে, সেই বিপর্যয় কল্পনা করাও কঠিন।

তাহলে কী করা যেতে পারে?

এটা একটা ভালো প্রশ্ন। কিন্তু তার আগে বোঝা দরকার, আমাদের কোন কাজগুলোর কারণে আজ আমরা এই অবস্থায় এসে পড়েছি। এটুকু বুঝতে পারলে কী করা যেতে পারে, সেটা বোঝাও সহজ হবে।

৫১ বিলিয়ন থেকে শূন্য

এই লেখার শুরুতেই আমরা পাঁচটা ঘটনার কথা বলেছি, যে পাঁচটাতেই কার্বন নিঃসরণ ঘটে। এবার একটু বোঝার চেষ্টা করি ঘটনাগুলো কী।

১. জিনিসপত্র তৈরি করা (যেমন সিমেন্ট, স্টিল, প্লাস্টিক): বেশির ভাগ কার্বন নিঃসরণের জন্যই এসব জিনিস দায়ী। মোট নিঃসরণের ৩১% ঘটে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরিতে।

. বিদ্যুৎ ব্যবহার: কার্বন নিঃসরণে দ্বিতীয় দায় এই বিদ্যুতের। ২৭% নিঃসরণ ঘটে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য কয়লা বা গ্যাস পোড়াতে গিয়ে।

৩. যাতায়াত করা: যন্ত্রচালিত যেসব যানবাহন আছে, সেসবের প্রায় সবই তেল বা গ্যাস পুড়িয়ে শক্তি তৈরি করে। ফলে কার্বন বের হয়। প্রায় ১৬% নিঃসরণ ঘটে সারা পৃথিবীর যানবাহনগুলো (যেমন প্লেন, বাস, ট্রাক, গাড়ি, মোটরসাইকেল) চালাতে গিয়ে।

৪. কৃষিকাজ ও পশুপালন: আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে যাতায়াতের চেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ ঘটে কৃষিকাজ আর পশুপালন করতে গিয়ে—প্রায় ১৯%! শুনে যদি অবাক লাগে, আবার আমার সঙ্গে হাত মেলাও। আমিও অবাক হচ্ছি!

৫. ঠান্ডা বা গরম রাখা: প্রায় ৭% কার্বন নিঃসরণ হয় জিনিসপত্র ঠান্ডা বা গরম করতে গিয়ে। এই যেমন, আমরা যখন ফ্রিজ ব্যবহার করি কিংবা এসি চালাই বা কেউ যদি কখনো রুম হিটার ব্যবহার করে থাকি, সেখানে কার্বন নিঃসরণ ঘটে।

এই পাঁচ কাজ করতে গিয়ে আমরা প্রতিবছর ৫১ বিলিয়ন টন কার্বন বাতাসে ছেড়ে দিই। যদি পৃথিবীকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে চাই, তাহলে সংখ্যাটাকে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে, অর্থাৎ একটা ফোঁটা কার্বনও বাতাসে ছাড়া যাবে না!

ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হতে পারে। একেবারেই কার্বন বাতাসে না ছাড়া কীভাবে সম্ভব?

আবারও বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কিন্তু এটাও সম্ভব। কী করে সম্ভব? এটা নিয়ে আমরা কথা বলব। কিন্তু তার আগে বলা দরকার, কাজটা কঠিন।

কত কঠিন?

এই প্রশ্নের উত্তর বেশ বোঝা গেছে ২০২০ সালে, যখন করোনাভাইরাস ঠেকাতে সারা পৃথিবীর সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হলো। প্রায় কোনো কারখানা চলেনি, প্লেন-বাস-ট্রাক চলা বন্ধ ছিল, অনেক কাজ করাই আমরা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই বছর কার্বন নিঃসরণ কতটুকু ঘটেছে, অনুমান করতে পারো?

সংখ্যাটা বিস্ময়কর! ৪৮-৪৯ বিলিয়ন টন! অর্থাৎ মাত্র ৫%-এর মতো নিঃসরণ কমানো গেছে।

এবং আবারও মনে করিয়ে দিই। এই ৫% নিঃসরণ কমানোর জন্য ১ মিলিয়ন মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে আর প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষকে চাকরি হারাতে হয়েছে!

অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার কাজটা খুব সহজ হবে না (এবং আমরা অবশ্যই করোনার দিনগুলোর পুনরাবৃত্তি চাই না)!

সুতরাং আবার, আবার এবং বারবার আমাদের ভেবে দেখতে হবে, আমরা কীভাবে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনব।

[চলবে...]