পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ১০ মরুভূমি

মরুভূমি বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চারদিকে শুধু বালু আর বালু। বাতাসে সেই বালু উড়ছে। গেরুয়া পরা কয়েকজন চড়ছে উটের পিঠে। সিনেমায় এ রকম দেখেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু শুধু ফাঁকা মাঠ ও ধু ধু বালু হলেই তাকে মরুভূমি বলা যাবে না। কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় প্রতিবছর ১০ ইঞ্চির কম গড় বৃষ্টিপাত হলে, সেই অঞ্চলকে মরুভূমি বলা যাবে। তবে মরুভূমি সব সময় শুধু গরমই হয় না, শীতলও হয়।

পৃথিবীতে তিন ভাগ জল ও এক ভাগ স্থল। সেই এক ভাগ স্থলের আবার তিন ভাগের এক ভাগ মরুভূমি। বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণেই মরুভূমির সৃষ্টি হয়। গাছপালা বা কোনো প্রাণীর পক্ষে মরুভূমিতে বেঁচে থাকা তাই প্রায় অসম্ভব।

এখন তোমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমি কোনটি? কী উত্তর দেবে? সাহারা মরুভূমি? এই উত্তরটা একই সঙ্গে ভুল ও সঠিক। কারণ, সাহারা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমি। কিন্তু সামগ্রিক দিক দিয়ে এটি বিশ্বের তৃতীয়। ফলে দেখা যাচ্ছে, মরুভূমির প্রকারভেদ জানাও গুরুত্বপূর্ণ।

পৃথিবীতে প্রধানত চার ধরনের মরুভূমি দেখা যায়।

১. গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমি: বিষুবরেখা বা ক্রান্তীয় অঞ্চলের কাছাকাছি এ মরুভূমি অবস্থিত। সারা বছর এখানকার তাপমাত্রা থাকে শুষ্ক ও উষ্ণ। যেমন সাহারা মরুভূমি।

২. শীতল মরুভূমি: এ ধরনের মরুভূমি হয় শীতল। মানে তাপমাত্রা অনেক কম থাকে। যেমন অ্যান্টার্কটিকা মরুভূমি। শীতকালে সেখানে কিছুটা বৃষ্টিপাত দেখা যায়।

৩. উপকূলীয় মরুভূমি: কর্কটক্রান্তীয় অঞ্চলে এ ধরনের মরুভূমি দেখা যায়। যেমন আতাকামা মরুভূমি। চার ধরনের মরুভূমির মধ্যে সবচেয়ে আর্দ্র থাকে এগুলো। তবে বৃষ্টিপাত বিরল।

৪. আধা শুষ্ক মরুভূমি: রাশিয়ার বন মরুভূমি এ ধরনের। আর্দ্রতা কম হলেও কিছুটা বৃষ্টিপাত দেখা যায়।

অনেক কথাই হলো। এবার পৃথিবীর সেরা ১০টি মরুভূমি সম্পর্কে জানা যাক। এ তালিকায় থাকবে বিশ্বের সব ধরনের মরুভূমি। মানে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই পৃথিবীতে এই ১০টি মরুভূমির চেয়ে বড় মরুভূমি নেই।

১০

গ্রেট বেসিন মরুভূমি

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মরুভূমি এটি। আয়তন প্রায় ৪ লাখ ৯২ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় নয় হাজার ফুট বেশি। মরুভূমির বেশির ভাগ অঞ্চলে বছরে ১০ ইঞ্চির কম বৃষ্টিপাত হয়। তবে কিছুটা বৃষ্টি হওয়ায় এখানে কিছু গাছপালা ও প্রাণী রয়েছে। সেগুলো এ অঞ্চলের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এই মরুভূমিতে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম এবং শীতকালে তীব্র ঠান্ডা পড়ে।

সিরিয়া মরুভূমি

এই মরুভূমি বাদিয়াত আশ-শাম নামেও পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় পাঁচ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই মরুভূমি বিস্তৃত। জর্ডান, ইরাক ও সিরিয়া—এই তিন দেশ জুড়ে রয়েছে মরুভূমিটি। তবে নাম সিরিয়া মরুভূমি হলেও এর বেশির ভাগ অংশ রয়েছে জর্ডানে; যা দেশটির স্থলভাগের ৮৫ শতাংশ। অন্যদিকে সিরিয়ার স্থলভাগের মাত্র ৫৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এটি। এর সীমানা গিয়ে মিশেছে আরব মরুভূমিতে। খরা, শিকারসহ মানুষের কিছু কার্যক্রমের জন্য এই মরুভূমির বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে। তেমন কোনো স্থানীয় প্রাণী নেই বললেই চলে। অতিরিক্ত খরায় অনেক উদ্ভিদ প্রজাতিও মারা গেছে। কিছু ঘাস অবশ্য এখনো টিকে আছে। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথম ও চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে বেদুইনরা এখানে এসে বসবাস শুরু করে। অনেক বেদুইন উপজাতি এখনো এখানে রয়ে গেছে।

কালাহারি মরুভূমি

এ মরুভূমি দক্ষিণ আফ্রিকার মালভূমিতে অবস্থিত একটি সমতল ভূমি। আধা শুষ্ক এই মরুভূমি ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। বতসোয়ানা ও নামিবিয়ায় এর সীমানা রয়েছে। এ মরুভূমিতে রয়েছে সিংহ, চিতা, হায়েনা, জিরাফ, জেব্রাসহ নানা প্রাণী। এখানেও রয়েছে বেশ কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আবাস।

আরও পড়ুন

গ্রেট ভিক্টোরিয়া মরুভূমি

অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় মরুভূমি এটি। মোট আয়তন ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৪৯৭ বর্গকিলোমিটার। এটি মূলত সমতল তৃণভূমি। এখানে রয়েছে লবণাক্ত হৃদ, ছোট পাহাড় ও শুকনা উপত্যকা। সাহারা মরুভূমির মতো এখানেও হাজার বছর ধরে আদিবাসীরা বসবাস করছে।

পাতাগোনিয়ান মরুভূমি

দক্ষিণ আমেরিকার পাতাগোনিয়ান মরুভূমি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মরুভূমি। আর্জেন্টিনা ও চিলি—উভয় দেশে এ মরুভূমি বিস্তৃত। এটি দেখতে বেশ সুন্দর হওয়ায় বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে বেশি পরিচিত। এ মরুভূমির দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে আন্দিজ পর্বতমালা এবং পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগর। ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসেন। প্রায় ৬ লাখ ৭৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে মরুভূমিটি বিস্তৃত। অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী এ মরুভূমিতে দেখা যায়।

আরও পড়ুন

গোবি মরুভূমি

এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় এ মরুভূমি রয়েছে চীন ও মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলজুড়ে। এর আয়তন প্রায় ১০ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার। চেঙ্গিস খান এখানেই তাঁর মঙ্গোল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। শীতকালে যেখানে তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, গ্রীষ্মকালে সেখানে তাপমাত্রা হয় প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ মরুভূমির বেশির ভাগ জায়গায় রয়েছে পাথর ও পাহাড়। এখানে বৃষ্টিপাত প্রায় হয় না বললেই চলে।

আরব মরুভূমি

এটি ইয়েমেন থেকে পারস্য উপসাগর, ওমান ও জর্ডান হয়ে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত। আয়তন প্রায় ২০ লাখ ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানে ১০২ প্রজাতির স্থানীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ৩১০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। আরও রয়েছে প্রায় ৩৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। এর মধ্যে ২০ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায় বালুতে। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৩ দশমিক ৯ ইঞ্চিরও কম। মরুভূমিটি সাহারা মরুভূমির কাছাকাছি হওয়ায় দিনে এখানকার তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে রাতে আবার তাপমাত্রা কমে যায়।

আরও পড়ুন

সাহারা মরুভূমি

বালুর টিলা ও উট নিয়ে শুরুতে মরুভূমির যে বর্ণনা দিয়েছিলাম, তা আসলে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মরুভূমি হলেও এটিই সবচেয়ে বড় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমি। এর আয়তন ৯০ লাখ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। আফ্রিকার উত্তরে মিসর, মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, সুদান, মালিসহ প্রায় ১৩টি দেশ জুড়ে রয়েছে সাহারা মরুভূমি। এ মরুভূমির লিবিয়া ও আলজেরিয়া অংশে প্রচুর তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায়। এ ছাড়া তামা, লোহা ও ফসফরাসও রয়েছে। এখানে বছরে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ৪ থেকে ১০ ইঞ্চি।

আর্কটিক মেরু মরুভূমি

বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটি মরুভূমিই মেরু অঞ্চলে অবস্থিত। এটি আলাস্কা, কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে ও রাশিয়াজুড়ে বিস্তৃত। এর আয়তন প্রায় ১ কোটি ৩৯ লাখ বর্গকিলোমিটার। এখানকার তাপমাত্রা অনেক ঠান্ডা। বাতাস অনেক শুষ্ক হওয়ায় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যদিও এখানে তুষার পড়ে। কিন্তু তা গলে পানি হয় না। বরফই থেকে যায়। তবু এখানে অনেক প্রজাতির পাখি ও মেরু ভালুক দেখা যায়।

আরও পড়ুন

অ্যান্টার্কটিক মেরু মরুভূমি

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা। একই সঙ্গে সবচেয়ে বড় মরুভূমিও। এই হিমশীতল মরুভূমিটি ১ কোটি ৪২ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। যেদিকে তাকাবে শুধু বরফ আর বরফ দেখতে পাবে। এখানে বছরে ১ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতও হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাও এই মরুভূমিকে বলতে পারো। যেখানে মরুভূমি মানে শুধু বালু আর গরম মনে হয়, সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মরুভূমিতে নেই কোনো বালুর চিহ্ন। গরমের কথা তো চিন্তাও করা যায় না। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান। শীতকালে অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা মাইনাস ৮৯ ডিগ্রিতে পৌঁছায়। যদিও এখানে কোনো মানুষের বসবাস নেই; তবে মাঝেমধ্যে বিজ্ঞানীরা গবেষণার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় মরুভূমিতে ঘাঁটি গাড়েন।

সূত্র: হাউ স্টাফ ওয়ার্কস

আরও পড়ুন