মোর্স কোড নিয়ে অজানা তথ্য
টেলিফোন ব্যবহারের আগে দ্রুত তথ্য পাঠানোর উপায় ছিল টেলিগ্রাফ। রেললাইনের ধারে টেলিগ্রাফের তার বা লাইন থাকত। এই তারের ভেতর দিয়ে যেত টেলিগ্রাফিক তথ্য। এই তথ্য পাঠাতে যে সংকেত বা কোড ব্যবহার করা হতো, এর নাম মোর্স কোড। আগে মোর্স কোড ছন্দ বা তাল ব্যবহার করে পাঠানো হতো। এরপর মোর্স কোডে বর্ণমালা, সংখ্যা, বিরামচিহ্ন এবং বিশেষ অক্ষর বোঝানোর জন্য বিন্দু ও ড্যাশ ব্যবহার করা হয়। যখন মোর্স কোডে বার্তা পাঠানো হয়, তখন বিন্দুগুলো সংক্ষিপ্ত বিপ, ক্লিক বা ফ্ল্যাশ হিসেবে হয়। ড্যাশগুলো বিপের তুলনায় দীর্ঘ হয়।
মোর্স কোডের নামকরণ এসেছে স্যামুয়েল মোর্সের নামে, যিনি এটি আবিষ্কারে সহায়তা করেছিলেন। উনিশ বা বিশ শতকে এটি প্রচুর ব্যবহৃত হলেও এখন আর তেমন হয় না। কিছু মানুষ বিশেষ পরিস্থিতিতে রেডিও যোগাযোগের জন্য মোর্স কোড ব্যবহার করেন।
বিভিন্ন দেশের জন্য বিভিন্ন ধরনের মোর্স কোড রয়েছে। মোর্স কোডে তিনটি ভিন্ন চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। সংক্ষিপ্ত সংকেতকে বলে ‘ডিট’। ডিটের তিন গুণ দীর্ঘ সংকেত ‘ডাহ’। আরেকটি হলো বিরতি। বিরতির দৈর্ঘ্য ডিটের সমান। এ ছাড়া মোর্স কোড পাঠানোর বিভিন্ন উপায় আছে। জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে রেডিও যোগাযোগের পরিবর্তে আলো বা লাইটের ঝলকানি দিয়ে যোগাযোগ করা হয়। এই লাইট আসলে মোর্স কোড সংকেত ব্যবহার করে। মোর্স কোড নিয়ে নিচের এই তথ্যগুলো জেনে রাখতে পারো।
টেলিগ্রাফ যোগাযোগের জন্য আবিষ্কৃত হয়েছিল মোর্স কোড
টেলিগ্রাফ শুধু একটি তারের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক পালস সংকেত প্রেরণ করতে পারে। তাই মোর্স কোড উদ্ভাবকদের এটি মাথায় রাখতে হয়েছিল যে শুধু বৈদ্যুতিক পালসের মাধ্যমে কীভাবে বার্তা পাঠানো যায়। মোর্স কোড আবিষ্কৃত হয়েছিল এই পালসকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য। প্রতিটি অক্ষর ও সংখ্যার জন্য আছে সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘ সংকেত, যাকে আমরা বলছি ডিট, ডাহ ও বিরতি। টেলিগ্রাফ ও মোর্স কোড, এই দুই আবিষ্কার দীর্ঘ দূরত্বের যোগাযোগকে একদম সহজ করে দিয়েছিল।
এখনো মোর্স কোড ব্যবহার করা হয়
অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা এখনো মোর্স কোড ব্যবহার করেন। আগে হ্যাম রেডিওর লাইসেন্স পাওয়ার জন্য মোর্স কোড জানা বাধ্যতামূলক ছিল। এখন আর হ্যাম রেডিওর লাইসেন্স পাওয়ার জন্য এটি জানার প্রয়োজন নেই। অনেকে এখন মজার দক্ষতা বা শখ হিসেবে মোর্স কোড শেখেন। কোনো দ্বীপে লোক আটকে পড়লে সৈকতে সর্বজনীন মোর্স কোড এসওএস সংকেত ব্যবহার করে বার্তা পাঠানো হয়। তাই মোর্স কোড এখনো যোগাযোগের এক উপায়। তুমি শিখে ফেলতে পারো মোর্স কোড।
মোর্স কোড তৈরি করেছিলেন দুজন মিলে
স্যামুয়েল এফ বি মোর্স তাঁর বন্ধু ও সহকারী আলফ্রেড লুইস ভেলের সহায়তায় মোর্স কোড আবিষ্কার করেছিলেন। ভেল মোর্সকে সংকেত তৈরি করতে সহায়তা করেছিলেন। স্যামুয়েলের নামানুসারে এই সংকেতকে মোর্স কোড বলা হয়। কারণ, তিনিই মূল ধারণাটি আবিষ্কার করেছিলেন।
মোর্স কোডে প্রথম আনুষ্ঠানিক টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছিল ১৮৪৪ সালে
প্রথম টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসিতে টেলিগ্রাফ রেকর্ডিং পরীক্ষা করার জন্য। সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে স্যামুয়েল মোর্স প্রথম রেকর্ড করা টেলিগ্রাম প্রেরণ করেছিলেন। তিনি এটি পাঠিয়েছিলেন বাল্টিমোরে তাঁর সহকারী আলফ্রেড ভেলের কাছে। এই টেলিগ্রামে লেখা ছিল বাইবেলের একটি বাক্যাংশ।
মোর্স কোডের উদ্ভাবক মূলত একজন চিত্রশিল্পী
স্যামুয়েল মোর্স টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের আগে শিল্পী হিসেবে কাজ করতেন। তিনি এঁকেছিলেন বিখ্যাত বিপ্লবী যোদ্ধা মারকুইস ডি লাফায়েতের প্রতিকৃতি।
এসওএস সিগন্যাল সম্ভব হয়েছে মোর্স কোডের কারণে
১৯০০ সালের প্রথম দশকে জাহাজে ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি-ব্যবস্থা চালু করা হয়। ওই সময় সমুদ্রে জাহাজের ট্রাফিক বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তাই জাহাজ দুর্ঘটনাও বেড়ে যায়। জাহাজ উদ্ধারে সহায়তার জন্য একটি আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থার সংকেত প্রয়োজন হয়। এই সময়ের আগেই মোর্স কোড ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছিল। তাই এসওএস (SOS) বা সেভ আওয়ার সৌলস সংকেতটি মোর্স কোডে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কারণ, এটি মনে রাখা ও বোঝা খুব সহজ। ‘এস’ বোঝাতে দরকার কেবল তিনটি বিন্দু, ‘ও’ বোঝাতে তিনটি ড্যাশ এবং শেষ ‘এস’ বোঝাতে আরও তিনটি বিন্দু (... ___ ...)।
মোর্স কোড কোনো ভাষা নয়
অনেকেই ভাবেন, মোর্স কোড বুঝি একটি ভাষা। আসলে মোর্স কোড কোনো ভাষা নয়, এটি একটি সংকেত। এটি বৈদ্যুতিক সংকেত দিয়ে বর্ণমালার কোড করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই সংকেত ইংরেজিতে অনুবাদ করা যেতে পারে।
ঘোড়ায় চড়া বার্তাবাহককে বেকার করেছে মোর্স কোড
মোর্স কোড আবিষ্কারের আগে মানুষ ঘোড়া, গাড়ি বা ট্রেনের মাধ্যমে চিঠি আদান-প্রদান করে যোগাযোগ করতেন। গন্তব্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগত। পথে ছিল নানা ঝাক্কি ও বিপদ। মোর্স কোড ও টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের ফলে এই ব্যবস্থা পুরোপুরি বদলে যায়। এভাবে দূরদূরান্তে কয়েক মিনিটের মধ্যে বার্তা পাঠানো যেত। পনি এক্সপ্রেস বা ঘোড়ায় চড়া বার্তাবাহকের ব্যবসা টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের ফলে খুব খারাপ হয়ে পড়ে। বলা যায়, একদম লাল বাত্তি। কম্পিউটার আসার পর টাইপরাইটারের যে অবস্থা হয়েছে, ঠিক তেমন। এভাবে ১৮৬১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোড়ায় চড়া বার্তাবাহকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তুমি চোখের পলক ফেলে মোর্স কোড দিয়ে যোগাযোগ করতে পারো
মোর্স কোড যেকোনো পালস সিগন্যালের মাধ্যমে কাজ করে। যেমন একটি টর্চলাইট চালু ও বন্ধ করে তুমি তোমার বিপদের কথা বার্তা হিসেবে পাঠাতে পারো। তুমি যদি সমস্যায় পড়ো, তবে কথা না বলেও এভাবে এসওএস সিগন্যাল পাঠাতে পারো। জরুরি অবস্থায় মোর্স কোড আসলেই সাহায্য করতে পারে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে একজন মার্কিন যুদ্ধবন্দী ভিয়েতনামে ভিডিওর মধ্যে চোখের পলক ফেলে মোর্স কোডে ‘নির্যাতন’ শব্দটি বলেছিলেন। তাঁকে নির্যাতন করা হচ্ছে, বার্তাটি তিনি পাঠাচ্ছিলেন। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার জানতে পারে, বন্দীদের সঙ্গে ভিডিওতে দেখানো ভালো আচরণ আসলে সত্য নয়, তাঁদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা হচ্ছে না। কয়েক বছর পর এই যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি নেভি ক্রস পদকে সম্মানিত হন।
বৈদ্যুতিক লাইনের মাধ্যমে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল মোর্স কোড
ট্রান্সআটলান্টিক কেবলের মাধ্যমে ১৮৫৮ সালে আটলান্টিক মহাসাগরজুড়ে একটি তামার টেলিগ্রাফ সফলভাবে ২ হাজার মাইল দূর পর্যন্ত স্থাপন করা হয়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ত্রুটি-বিচ্যুতির (ট্রায়াল অ্যান্ড এরর) পরও সেই তার ভেঙে যায়। পরে আরও শক্তিশালী তার দিয়ে এই তার বদলানো হয়েছিল। প্রথমবারের মতো ট্রান্সআটলান্টিক কেব্লটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের রানির যোগাযোগ করার সুযোগ দিয়েছিল। খুব দ্রুত তাঁরা এর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারতেন। ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আবিষ্কৃত হলে তারযুক্ত টেলিগ্রাফির প্রয়োজনীয়তা দূর হয়ে যায়।
মোর্স কোডের কোরিয়ান ও জাপানি সংস্করণ আছে
কোরিয়ান মোর্স কোডের ভার্সনকে বলে এসকেএটিএস। জাপানিদের আছে ওয়াবুন কোড, যা জাপানিজ ভাষার অক্ষর ও শব্দকে মোর্স কোডের সংকেতে বদলে দেয়। এই কোড লাতিন বর্ণমালা দিয়েও ব্যবহার করা যায়।