হাতের হিটেড গ্লাভস উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। আশিক চৌধুরী গ্লাভস পরা সেই হাতে শক্ত করে ধরে আছেন আমাদের জাতীয় পতাকা। উত্তেজনার চোটে খেয়ালই করেননি তাঁদের বহনকারী বিমানটি কখন যে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪১ হাজার ফুটের ওপরে উঠে গেছে। আশিকের পাশে বসা জাম্পমাস্টার পল গলসন তখনই সংকেত দিলেন, ‘থার্টি সেকেন্ডস টু এক্সিট।’ মানে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আশিককে বিমান থেকে ঝাঁপ দিতে হবে। তাই শেষবারের মতো অক্সিজেন সাপ্লাই আর থার্মাল স্যুটের হিট সেন্সরগুলো কাজ করছে কি না, চেক করে নিলেন তিনি। আকাশের এত উঁচুতে অক্সিজেন যেমন থাকে না, তেমনি তাপমাত্রাও হিমাঙ্কের নিচে থাকে। তাই অক্সিজেন সাপ্লাই আর থার্মাল স্যুটের দিকে বিশেষ মনোযোগ রাখতে হয়। এবার স্কাইডাইভিংয়ের রীতি মেনে ফ্লাইট ক্রুর সঙ্গে বিদায়ী করমর্দনও করলেন আশিক। কে জানে, এটাই হয়তো দুজনের শেষ দেখা।
আশিককে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। তিনি স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়েছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। এরপর ২০০৭ সালে স্নাতক হয়েই যোগ দেন চাকরিতে। কয়েক বছর চাকরি করে আবার পড়তে যান বিলেতে। সেখানেই খোঁজ পান একটি স্কাইডাইভিং স্কুলের। খোঁজ পেয়ে কি বসে থাকার মানুষ আশিক! যুক্তরাজ্যের ব্র্যাকলি শহরের সেই হিনটন স্কাইডাইভিং সেন্টারে একদিন হাজির হলেন স্কাইডাইভিং করবেন।
তারপর প্লেনের দরজা খোলা হলো। সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরে ঢুকে পড়ল একখণ্ড মেঘ। ভেতরটা ধোঁয়াটে হয়ে গেল। ধীরে দরজার দিকে যেতে যেতে জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন আশিক। পৃথিবীটা আসলেই গোল কি না, সেটিই দেখার চেষ্টা করলেন। বাইরে তাকাতেই স্বর্গীয় এক আনন্দে আশিকের চোখে পানি চলে গেল—কী অদ্ভুত সৌন্দর্য। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র আর তুচ্ছ মনে হলো তখন। তাঁর মনে হলো, চাকরিবাকরি করেও মাসের পর মাস স্কাইডাইভিংয়ের জন্য এত যে খাটাখাটনি করেছেন, তা বৃথা যায়নি। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আশিকের সঙ্গে থাম্বস আপ করলেন পল গলসন। সঙ্গে সঙ্গে বড় একটি শ্বাস নিয়ে ৪২ হাজার ফুট (প্রায় ১৩ কিলোমিটার) উচ্চতা থেকে শূন্যে এক পা বাড়ালেন।
সেই দিনটা ছিল গত ২৫ মে। যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসের একটি এয়ার ফিল্ডে আশিক চৌধুরী এই ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তারপর শূন্যে ভাসতে ভাসতে তিনি মেলে ধরেছিলেন বাংলাদেশের পতাকা। একে তো আকাশে ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে আসার কৌশল মেনে চলা, তার ওপর একখণ্ড কাপড় মেলে দুহাতে ধরা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এতে বাতাস বাধাপ্রাপ্ত হয়ে স্কাইডাইভারের স্বাভাবিক পতনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। আশিক চৌধুরীও তেমনই ঝুঁকিতে পরেছিলেন। তবু বিশ্ব রেকর্ড গড়ার বাসনায় হাত থেকে পতাকা ছাড়েননি তিনি। খুব কৌশলে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে প্যারাস্যুট খুলে মাটিতে নেমে আসেন।
আশিক এখন পতাকা হাতে দীর্ঘ পতনের জন্য বিশ্ব রেকর্ডধারী স্কাইডাইভার। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ‘গ্রেটেস্ট ডিসট্যান্স ফ্রিফল উইথ আ ব্যানার/ফ্ল্যাগ’ শাখায় এই রেকর্ড আগে ছিল ভারতের জিতিন বিজয়ানার। এখন তাঁর জায়গায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আশিকের নাম। আমাদের গর্বের লাল–সবুজ পতাকাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার এই প্রচেষ্টার সঙ্গে মিশে আছে আশিকের দীর্ঘ পরিশ্রম।
পাখির মতো ওড়ার স্বপ্ন দেখতেন আশিক
তোমরা কি ইকারুসের গল্প জানো? গ্রিক পুরাণের চরিত্র সে। এই ইকারুস পাখির পালক দিয়ে ডানা বানিয়ে উড়তে শিখেছিল। আশিক চৌধুরী ছোটবেলায় যখন ইকারুসের গল্প পড়েন, সেই থেকে তাঁরও স্বপ্ন, পাখির মতো উড়বেন।
সে জন্য অবশ্য আশিককে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। তিনি স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়েছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। এরপর ২০০৭ সালে স্নাতক হয়েই যোগ দেন চাকরিতে। কয়েক বছর চাকরি করে আবার পড়তে যান বিলেতে। সেখানেই খোঁজ পান একটি স্কাইডাইভিং স্কুলের। খোঁজ পেয়ে কি বসে থাকার মানুষ আশিক! যুক্তরাজ্যের ব্র্যাকলি শহরের সেই হিনটন স্কাইডাইভিং সেন্টারে একদিন হাজির হলেন স্কাইডাইভিং করবেন। জাম্পস্যুট, হেলমেট, প্যারাস্যুট, গগলসসহ যাবতীয় সুরক্ষা সামগ্রী পরানো হলো তাঁকে। দুজন প্রশিক্ষিত স্কাইডাইভারের সঙ্গে উঠে পড়লেন প্লেনে। কয়েক হাজার ফুট ওপরে ওঠার পর একজন স্কাইডাইভার আশিককে সঙ্গে নিয়ে বিমান থেকে লাফ দিলেন। আকাশে উড়তে উড়তে আশিকের মনে হলো, পাখির জীবনটা কতই–না সুন্দর!
সেদিন মাটিতে পা রেখেই আশিকের মনে আক্ষেপ, স্কাইডাইভারের সাহায্য ছাড়া লাফ দিলে কতই–না রোমাঞ্চকর হতো ব্যাপারটা। সেই রোমাঞ্চ অবশ্য দমিয়ে রাখতে হয় আশিককে। কারণ, তত দিনে লন্ডন বিজনেস স্কুল থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করে আমেরিকান এয়ারলাইনসের লন্ডন অফিসে যোগ দিয়েছেন। অনেক ব্যস্ততা তাঁর। বিমানবন্দরের পাশেই আশিকের অফিস। অনবরত বিমানের ওঠানামা দেখেন আর মনে মনে স্কাইডাইভিংয়ের স্বপ্নটা পুষে রাখেন। স্কাইডাইভিংয়ের সঙ্গে তখন আরেকটি পোকা তাঁর মাথায় ঢোকে। আশিকের বাবা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পাইলট ছিলেন। পাইলট বাবার কাছে আকাশে ওড়ার কত গল্পই–না শুনেছেন। এবার তিনি প্রাইভেট পাইলট হতে একটি প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হন। এক বছর ধরে চলে প্রশিক্ষণ। এরপর একদিন ককপিটে বসেন আশিক। লন্ডন থেকে উড়োজাহাজ নিয়ে ছুটে যান পাশের এক শহরে। এরপর মাঝেমধ্যেই প্লেন ভাড়া করে পরিবার নিয়ে লন্ডন থেকে ম্যানচেস্টারে চলে যেতেন। লাঞ্চ করে আবার ফিরতেন লন্ডনে। সেই দেশে নাকি এটা খুবই সাধারণ ঘটনা।
পাইলট তো হলেন, কিন্তু স্কাইডাইভিংয়ের কী হবে? সেই পোকা আশিকের মাথায় থেকেই যায়। কয়েক বছর আগে যখন তিনি আবার সিঙ্গাপুরে আসেন চাকরির সূত্রে। সেখান থেকেই খোঁজখবর করেন থাইল্যান্ডের একটি স্কাইডাইভিং স্কুলের। থাইল্যান্ডকে বলা যায় স্কাইডাইভিংয়ের স্বর্গভূমি। অনেক স্কুল আছে সেখানে। তুমি চাইলে শখের বশে সেখানে স্কাইডাইভ দেওয়ার পাশাপাশি স্কাইডাইভার হওয়ার প্রশিক্ষণও নিতে পারো। গত বছর এমনই একটি স্কুলে ভর্তি হন আশিক।
যুক্তরাজ্যে প্রথম স্কাইডাইভিংয়ের এক দশকের বেশি সময় পর থাইল্যান্ডে স্কাইডাইভিং করেন আশিক। সেদিন প্রশিক্ষকের সঙ্গে আরও কয়েকবার ঝাঁপ দেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণে কোনো প্রশিক্ষক আর আশিককে সঙ্গে নিয়ে লাফ দিলেন না। শুধু দুজন পেশাদার স্কাইডাইভার থাকলেন আশিকের দুই পাশে। আশিক নিজে নিজের প্যারাস্যুট খুলে নেমে এলেন মাটিতে। এভাবে ১০ বার লাফ দেওয়ার পর সহযোগিতার জন্যও কেউ সঙ্গে থাকলেন না। লাফ দিলেন একা। সেই লাফে সফলও হলেন আশিক।
সপ্তাহান্তে সিঙ্গাপুর থেকে থাইল্যান্ডে ছুটে যেতেন। দুই দিন অনুশীলন করে সিঙ্গাপুর ফিরে অফিস ধরতেন। এভাবে চার সপ্তাহ পর ২৫তম বার লাফ দিতেই ঝানু স্কাইডাইভারের মতো হয়ে যান আশিক। তাঁর অগ্রগতি দেখে সন্তুষ্ট থাই স্কাই অ্যাডভেঞ্চারের কর্তারা। এরপর আরও কয়েকবার লাফ দেওয়ার পর আশিকের হাতে তুলে দেওয়া হয় স্কাইডাইভারের লাইসেন্স। এই লাইসেন্স দেখিয়ে বিশ্বের যেকোনো দেশে স্কাইডাইভিং করতে পারবেন আশিক, যার শুরুটাই তিনি করলেন লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে রেকর্ড গড়ে।