এশিয়া থেকে ইউরোপ। এই দুই মহাদেশের মধ্যে অধিকাংশ পণ্য পরিবহন হয় জাহাজে করে। এশিয়া থেকে ইউরোপে পণ্য নেওয়ার একটা সহজ রাস্তা হলো ভারত মহাসাগর হয়ে লোহিত সাগর। এরপর সুয়েজ খাল হয়ে ভূমধ্যসাগর, এরপর ইউরোপ। তবে গত অক্টোবর থেকে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা শুরু করে। এরপর গত তিন মাসে সুয়েজ খাল হয়ে বাণিজ্যিক জাহাজের যাতায়াত প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। এতে করে বাড়ছে পণ্যের দাম। ইউরোপ যেমন এতে বিপদে পড়েছে, তেমনি আমরাও বিপদে পড়েছি। মোটামুটি বলতে গেলে বিশ্বজুড়ে পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে এই হামলার কারণে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই হুতি বিদ্রোহীরা কারা। তারা কেনই-বা সেখানে হামলা চালাচ্ছে। এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে ফিলিস্তিনের দিকে একটু চোখ বোলাতে হবে।
এটা তো সবারই জানা যে দীর্ঘদিন ধরেই স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে আসছে ফিলিস্তিন। এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী হামাস গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়। এই হামলার মধ্য দিয়েই মূলত ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের যুদ্ধ শুরু। সেই যুদ্ধ এখনো চলছে। এই যুদ্ধে হামাস তথা ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। তারা চায় ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলা বন্ধ করতে হবে। এ জন্য ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়াতে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, এমন জাহাজগুলোর ওপর লোহিত সাগরে হামলা চালাচ্ছে হুতিরা। এসব হামলা চালানো হচ্ছে ইয়েমেন থেকে। এ জন্য ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ব্যবহার করছে তারা।
এবার আসা যাক হুতি প্রসঙ্গে। তারা আসলে কারা। এত শক্তি কোথা থেকে পায়। সিএনএন বলছে, ইয়েমেনে এক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের একটি পক্ষ হুতি, যারা আনসারুল্লাহ নামেও পরিচিত। ১৯৯০–এর দশকে তাদের উত্থান। তারা মূলত শিয়াপন্থী। ইরান তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। একসময় এই শিয়াপন্থীরা ইয়েমেন শাসন করলেও ১৯৬২ সালে গৃহযুদ্ধের পর সুন্নিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সুন্নিদের আবার সমর্থন করে সৌদি আরব।
১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একত্র হলে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। তিনি প্রথম দিকে হুতিদের একটি সংগঠনকে সমর্থন করতেন। তবে আন্দোলনটি জনপ্রিয় ও শাসকবিরোধী হয়ে উঠতে থাকায় তা সালেহর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে সমর্থন দেন সালেহ। যদিও ইয়েমেনের অধিকাংশ জনগণ ছিল এর বিরুদ্ধে। ফলে এই সুযোগটি কাজে লাগায় হুতিরা। জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তাদের রাস্তায় নামিয়ে আনে হুতিরা।
এখানে একটি বিষয় বলা দরকার, ১৯৯০–এর দশক থেকে হুতিদের নেতা ছিলেন হুসেইন আল-হুতি। সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে প্রেসিডেন্ট সালেহ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এরপর ইয়েমেনি সেনারা ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-হুতিকে হত্যা করেন।
নেতা ছাড়াও যে আন্দোলন এগিয়ে যেতে পারে, তার একটি বড় উদাহরণ হুতি। আল–হুতি মারা গেলেও আন্দোলনটির মৃত্যু হয়নি। হুতিদের সামরিক শাখায় ইয়েমেনি তরুণেরা দলে দলে যোগদান করেন। ২০১১ সালে হুতিরা দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ সাআদা দখলে নিয়ে সালেহর শাসনের অবসানের দাবি করে। ২০১৪ সালে ইয়েমেনের রাজধানী সানার বিভিন্ন অংশ দখলে নেয় হুতিরা। পরের বছরের শুরুতে তারা প্রেসিডেন্টের বাসভবনও দখল করে নেয়। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে ইয়েমেনের সেই সময়ের সরকারের পক্ষ নেয় সৌদি আরব। আর হুতিদের পক্ষ নেয় ইরান।
বলা হয়ে থাকে হুতি তৈরি করেছে ইরান। তার প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, অর্থ—সবই দেয় ইরান। ২০ হাজার প্রশিক্ষিত যোদ্ধা রয়েছে হুতিদের। এক হাজার কিলোমিটার দূরে হামলা চালানোর মতো ক্রুজ, ব্যালিস্টিকসহ নানা ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তাদের হাতে। এ ছাড়া ড্রোন ব্যবহার করেও হামলা চালাচ্ছে তারা। এমনকি দুই হাজার কিলোমিটার দূরে হামলা চালানোর মতো ড্রোনও তাদের রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্র এনে সেই অস্ত্র নিজেদের মতো করে বানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও এই হুতিদের রয়েছে।
লোহিত সাগরে হুতিদের হামলার স্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে গত ডিসেম্বরে হুতি মুখপাত্র মোহাম্মদ আবদুল সালাম আল–জাজিরাকে বলেছিলেন, ‘আমরা সবার উদ্দেশে এটা জোর দিয়ে বলতে চাই, এই অভিযান গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে। ইসরায়েলে আগ্রাসনের মুখে আমরা হাবার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না।’
হামলায় আছে হিজবুল্লাহও
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রশ্নে হুতিদের সঙ্গে একমত লেবাননের ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। বলতে গেলে হুতিদের চেয়ে ফিলস্তিনিদের সঙ্গে হিজবুল্লাহর সম্পর্ক গভীর। কারণ, লেবাননে অনেক ফিলিস্তিনি শরণার্থীর বসবাস। আবার ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীদের একসময় ঘাঁটি ছিল লেবানন।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় হামলা চালালে এর জবাবে ৮ অক্টোবর ইসরায়েলি সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালায় হিজবুল্লাহ। সেই হামলা এখনো চলছে।
এখানে হিজবুল্লাহ সম্পর্কেও একটু জানা দরকার।
১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে হিজবুল্লাহর যাত্রা শুরু। তারা ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। যেই সময় হিজবুল্লাহর জন্ম, সেই আশির দশকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ছিল ইসরায়েলের দখলে। হিজবুল্লাহর দাবি, তাদের হামলার জেরে ২০০০ সালে ইসরায়েল লেবানন ছাড়তে বাধ্য হয়।
এদিকে সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও হিজবুল্লাহ এখন লেবাননের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি। এখন লেবাননের পার্লামেন্টে হিজবুল্লাহর প্রতিনিধি রয়েছেন।
সামরিক শক্তিতেও মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অনেক সংগঠনের চেয়ে হিজবুল্লাহ শক্তিশালী। সিবিএস নিউজের খবরে বলা হচ্ছে, হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহর দেওয়া তথ্য অনুসারে, তাঁদের এক লাখ যোদ্ধা রয়েছে। হিজবুল্লাহর নিজস্ব বাহিনী লেবাননের সামরিক বাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলের গণমাধ্যম হারেৎজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, হিজবুল্লাহর হাতে প্রায় দেড় লাখ রকেট ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আছে। এসব অস্ত্র দিয়ে যেকোনো সময় ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালাতে পারে তারা।
গাজা যুদ্ধ শুরুর মাস খানেক পর হিজবুল্লাহর প্রধান সৈয়দ হাসান নাসরাল্লাহ বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজায় আগ্রাসন বন্ধ করতে পারে। কারণ, এটা তাদেরই আগ্রাসন।
গাজা যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দুষছে হিজবুল্লাহ। তবে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলে। মোটাদাগে বললে ইসরায়েল আসলে হিজবুল্লাহর চির শত্রু। এ কারণেই হুতিদের পাশে রয়েছে হিজবুল্লাহ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, লোহিত সাগরে হুতিরা যে হামলা চালাচ্ছে, তাতে সাহায্য করছে হিজবুল্লাহ। সঙ্গে রয়েছে ইরান। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের কর্পসও (আইআরজিসি) রয়েছে ইয়েমেনের মাটিতে। বলা হয়ে থাকে, কোন জাহাজগুলো লোহিত সাগর হয়ে চলাচল করবে এবং কোনগুলো ইসরায়েলে যাবে, সে তথ্য বিশ্লেষণের কাজে হুতিদের সাহায্য করছে আইআরজিসি। যদিও ইরান এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে।
মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমারা মুখোমুখি
ফিলিস্তিন যুদ্ধে অলিখিতভাবে জড়িয়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইরান, ইয়েমেন ও লেবাননের একটি বড় অংশ। উল্টোদিকে জাহাজ সুরক্ষা দিতে গিয়ে এ যুদ্ধে জড়িয়েছে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব। হুতিদের ড্রোন থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ২০টি দেশের বাহিনী ব্যয় করছে ৫১ কোটি মার্কিন ডলার (৫ হাজার কোটি টাকার বেশি)। এই ব্যয় সাগরে হুতিদের হামলা ঠেকাতে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা উন্নয়নে।
তবে লোহিত সাগরে হামলা থামানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের সুর খানিকটা নরম। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্বীকার করেছেন, তাঁর বাহিনীর হামলায় হুতিরা থামেনি। আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, তাঁরা হুতিদের সঙ্গে যুদ্ধ চান না।
যুদ্ধ না চাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ভৌগোলিক অবস্থান। লোহিত সাগরের তীরে হুতিদের শক্ত অবস্থান। আরেকটি কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে তথা ইয়েমেনের হুতি ও সৌদি আরবের মধ্যে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ চলছে।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, হুতির সঙ্গে নতুন করে সংঘাতে জড়াতে চান না সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ২০৩০ সালের মধ্যে সৌদি আরবকে বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যিক ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন তিনি। তাই মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো ধরনের সংঘাতের বিপক্ষে অবস্থান তাঁর।
অর্থাৎ হুতিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে পশ্চিমারা তাদের মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র সৌদিকে পাশে পাচ্ছে না।
এখন দেখার বিষয় হলো, পশ্চিমারা কী করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি হুতিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্র সেনা পাঠায়, তবে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় হবে। কারণ, ইয়েমেনে ৯ বছর গৃহযুদ্ধই তার প্রমাণ। সৌদি আরব সুসজ্জিত বাহিনী দিয়েও হুতিদের হারাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রও পারবে না।
কী হবে লোহিত সাগরে
যুক্তরাষ্ট্রের ফরচুন ম্যাগাজিন বলছে, প্রতিবছর বিশ্বে যে পরিমাণ জাহাজ চলাচল করে, তার ১৫ শতাংশই চলে সুয়েজ খাল দিয়ে। আর ৩০ শতাংশ কনটেইনার পরিবহন হয় এ পথে। এই খাল দিয়ে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় কী পরিমাণ খরচ বাড়ে তার একটি হিসাব দিয়েছে ফরচুন। তারা বলছে, ফিলিস্তিন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ৪০ ফুটের একটি কনটেইনার পরিবহনে এ পথে খরচ হতো ১ হাজার ৩৯০ মার্কিন ডলার। সম্প্রতি তা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ডলার। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, শিপিং প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকি নিয়ে লোহিত সাগর দিয়ে কনটেইনার পাঠাতে চাইছে না। ফলে জাহাজ ঘুরে যাচ্ছে আফ্রিকা হয়ে। এতে পরিবহন খরচ বাড়ছে।
সুয়েজ খালে পণ্য পরিবহনের এমন বিপর্যয় এর আগে দেখেনি বিশ্ব। জাতিসংঘ বলছে, শুধু পণ্য পরিবহনই নয়, জ্বালানি পরিবহন কমেছে এই পথে।
যুদ্ধের কারণে আরেকটি সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে বেশ ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে। সেটি হলো কৃষ্ণসাগর। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ সাগরে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। এরই মধ্যে লোহিত সাগর ও সুয়েজ খালে জাহাজে হামলার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে। অর্থাৎ একের পর এক যুদ্ধ সারা বিশ্বকেই ভোগাচ্ছে।