যেভাবে এল শব্দজব্দ বোর্ড গেম

শিরোনামটা দেখে একটু দ্বিধায় পড়ে যেতে পারো তোমরা। শব্দজব্দ? সেটা আবার কী? পত্রিকার পাতায় যারা শব্দভেদ বা শব্দজট দেখেছ, তারা কিছুটা বুঝতে পারবে। তবে পত্রিকার শব্দভেদের সঙ্গে এই শব্দজব্দের তফাতও অনেক। এই শব্দজব্দ খেলতে হয় বোর্ডে, বর্ণ মিলিয়ে তৈরি করতে হয় শব্দ। ইংরেজিতে ‘স্ক্র্যাবল’ যারা খেলেছ, তারা অবশ্য অনেকটাই ধরতে পারবে ব্যাপারটা। এই খেলায় মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ব্যাগের ভেতর থাকা বর্ণফলক হাতে নেওয়ার পর এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকা বর্ণফলকগুলো নিয়ে অর্থবোধক শব্দ তৈরি করা। যে যত বুদ্ধি দিয়ে শব্দ বানাতে পারবে, তার পয়েন্ট হবে তত বেশি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলায় এমন কিছুর ভাবনা কীভাবে এল? ইংরেজিতে স্ক্র্যাবল দারুণ জনপ্রিয়, নিউইয়র্ক টাইমস–এর মতো বড় বড় দৈনিকে নিয়মিত ছাপা হয়ে আসছে ক্রসওয়ার্ড গেমস। অনেক প্রতিযোগিতাও হয় এই স্ক্র্যাবল নিয়ে, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় তুমুল। কিন্তু এত সমৃদ্ধ একটা ভাষা হওয়ার পরও বাংলা ভাষায় এমন কোনো বোর্ড গেম কেন নেই? এই ভাবনাই আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

আসলে বাংলা ভাষার গড়নটা ইংরেজির চেয়ে অনেকটাই আলাদা। বাংলায় কার, ফলা, যুক্তবর্ণের মতো এমন কিছু উপাদান আছে, যা ইংরেজির চেয়ে বেশ ভিন্ন। তার চেয়ে বড় ব্যাপার, বাংলা ভাষায় কোনো বর্ণের সংখ্যা বেশি, কোনোটার কম, কোনোটার কার বা ফলা দিয়ে কয়টা শব্দ, সেটাই তো আমাদের সবার জানা নেই। এটা না জানা থাকলে ব্যাগে কোন বর্ণফলক কয়টি করে রাখা হবে, সেটাও জানা যাবে না। তাহলে উপায়?

এখানে ত্রাতা হয়ে এলেন কম্পিউটার প্রকৌশলীরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার কৌশলের দুই শিক্ষার্থী বাতলে দিলেন পথ। তাঁরা ৮০ হাজার শব্দের একটা তথ্যভান্ডার থেকে গবেষণা করে জানালেন অবাক করা একটা তথ্য। বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি শব্দ রয়েছে ‘র’ বর্ণ দিয়ে। এরপরই রয়েছে ‘ন’ বর্ণ। এভাবে শতকরা হিসাব করে আমাদের বাংলা শব্দভান্ডারে কোন বর্ণ কেমন আছে অর্থাৎ কোন বর্ণ কয়বার রাখা যেতে পারে, শব্দজব্দের ব্যাগে তা নিয়ে মোটামুটি একটা কাঠামো দাঁড় করাতে পারলাম।

এবার ঠিক করতে হবে যে কীভাবে খেলাটি খেলা যাবে? নিয়মকানুন অনেকটা ইংরেজি স্ক্র্যাবলের মতোই, তবে বাংলা ভাষার অনন্যতার কথা মাথায় রেখে কিছু রদবদল আনতে হয়েছে শব্দজব্দে। যেমন কোনো বর্ণের নিচে একই ঘরে অন্য একটি বর্ণফলক রেখে কার, ফলা বা যুক্তবর্ণ বানানো যাবে আমাদের শব্দজব্দে। এমন নিয়ম করায় দেখা গেল, নতুন নতুন শব্দ বানাতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। পাশাপাশি ফেসবুক ও ইউটিউবে আমরা বেশ কিছু টিউটোরিয়াল ভিডিও দিয়ে শব্দজব্দ খেলায় শব্দ বানানোর নিয়ম ও পয়েন্ট হিসাব করার পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে দিয়েছি।

নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে আরেকটা বড় প্রশ্ন চলে এল—শব্দের বানান ও অর্থে। সবার প্রথম প্রশ্ন, যেকোনো শব্দ কি ব্যবহার করা যাবে? বানান কোনটা গ্রহণযোগ্য হবে? এসব ক্ষেত্রে অভিধানকেই আমরা চূড়ান্ত ধরেছি অর্থাৎ বাংলা অভিধানে থাকা শব্দগুলোই শুধু ব্যবহার করা যাবে।

এই সবকিছুর পর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, ফলকগুলো বানানো হবে কী দিয়ে? এ ক্ষেত্রে আমরা পরিবেশবান্ধব উপাদানের ওপরই আস্থা রেখেছি। শিশু–কিশোরদের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে প্লাস্টিকজাতীয় উপাদান মোটামুটি বাদ দিয়ে কাঠ বা বোর্ড দিয়েই তৈরি করা হয়েছে শব্দজব্দ।

এসব ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে অবশেষে গত ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আলোর মুখ দেখল এই শব্দজব্দ। প্রথম দিনই আমরা গেলাম ঢাকার মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়; সেখানে উৎসাহী শিশু–কিশোরদের দারুণ উৎসাহ, রীতিমতো ভিড় জমে গেল শব্দজব্দ কর্নারে। কিশোর আলোর মাসিক সভা কিআড্ডাতেও হাজির হয়েছিলাম আমরা। কিআর পাঠকেরা দারুণ উপভোগ করেছে খেলাটা।

শিশু-কিশোরদের বিপুল সাড়া দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হলাম, বাংলা ভাষায় অনেক কিছুর চাহিদা সত্যিই আছে। সামনে শব্দজব্দের মতো আরও অনেক কিছু করার চেষ্টা থাকবে আমাদের।

আরও পড়ুন