‘ডাবল সেঞ্চুরি’ ব্যাপারটি শুনলেই প্রথমেই মুশফিকুর রহিমের কথা মাথায় আসে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ও সর্বোচ্চ ডাবল সেঞ্চুরি মুশফিকের। তবে আজকের গল্পটি মুশফিক কিংবা ক্রিকেট কোনোটি নিয়েই না। তবে ডাবল সেঞ্চুরির ব্যাপারটি আছে এ গল্পে। পুরস্কার জিততে জিততে ডাবল সেঞ্চুরি করা রাফসানের গল্প শোনাব আজ।
ঢাকার শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে মো. ইমরুল কায়েস রাফসান। বয়স মাত্র ১২। ছবি এঁকে এখন অবধি দুই শতাধিক পুরস্কার জিতেছে সে। শিগগিরই সংখ্যাটা ৩০০ হয়ে যাবে। আঁকাআঁকি শেখার বয়সেই এত এত পুরস্কার কীভাবে জিতল রাফসান?
আঁকাআঁকি ও পুরস্কারের গল্প
ছোট্ট রাফসান তখন আরও ছোট্ট। বয়স মাত্র তিন বছর ছুঁই ছুঁই। বাবা রংপেনসিল এনে দিলেন, কাগজ এনে দিলেন। সেই রংপেনসিল নিয়ে রাফসান সারাক্ষণ ঘোরে, কিন্তু কিছু আঁকে না। একদিন নানাবাড়িতে গিয়ে একটি মুরগি তার খুব পছন্দ হলো। বাবার দেওয়া রংপেনসিল দিয়ে সে এঁকে ফেলল মুরগিটির ছবি। প্রথম আঁকা দেখেই সবাই বেশ মুগ্ধ।
এর পর থেকে রাফসান সুযোগ পেলেই আঁকে। খাতার ওপরে, নিচে, সামনে, পেছনে—সব জায়গায়। আট বছর বয়সে রাফসান প্রথম কোনো আঁকার স্কুলে যায়। আস্তে আস্তে আরও ভালো হতে থাকে তার আঁকার হাত। আশপাশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে একটু একটু করে পুরস্কারও আসতে থাকে ঘরে।
ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে ২০২০–এ চলে আসি। করোনাকালের গোড়ার দিকের কথা বলছি। রাফসান তখন আরেকটু বড় হয়েছে। পড়াশোনা চতুর্থ শ্রেণিতে। লকডাউনে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাসায় থাকতে থাকতে খুব বিরক্ত লাগছিল রাফসানের। এই বিশাল সময়ে ইন্টারনেটের কল্যাণে অনলাইনে বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করে সে। একই সঙ্গে চলে নিজের আঁকা ভালো করার চেষ্টা। এ সময় রাফসান বেশ অবাক হয়ে খেয়াল করল, অংশ নেওয়া প্রায় সব প্রতিযোগিতায় সে পুরস্কার জিতে নিচ্ছে।
প্রথম পর্যায়ের করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করে রাফসান। যতই দিন যায়, রাফসানের আঁকা হয় আরও সুন্দর, আরও সৃজনশীল। ধীরে ধীরে আঁকা একদম পাল্টে যায়। স্কেচ আঁকতে শুরু করে সে। ২০২১ সালে এসে একের পর এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকে রাফসান।
দেশে পুরস্কার জিততে জিততে একসময় রাফসান অনলাইনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতেও অংশ নিতে শুরু করে। সেখানেও রাফসানের অর্জনের তালিকাটা অনেক বড়। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, গ্রিস, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ থেকে ৫০টির বেশি পুরস্কার ঢুকেছে রাফসানের ঝুলিতে, যার মধ্যে একটি পুরস্কার এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার স্পেস ফাউন্ডেশন থেকে! সেখান থেকে রাফসানের আঁকা ছবি কেনার অফারও এসেছিল!
রাফসানের পুরস্কারের সংখ্যাটা দুই শর ঘর ছুঁয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। রাফসানকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এত এত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে কী কী পেয়েছে সে। উত্তর শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছি বলা যায়। ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট ও বইয়ের পাশাপাশি প্রায়ই পুরস্কার হিসেবে বিশাল অঙ্কের প্রাইজমানি পায় সে। তবে দেশের বাইরে থেকে পাওয়া পুরস্কারগুলো রাফসানের বেশি পছন্দ। আইপ্যাড, স্মার্টফোন ও ল্যাপটপ পুরস্কার হিসেবে পেলে তোমারও নিশ্চয়ই সেগুলোই পছন্দের পুরস্কার হতো। ছোট্ট রাফসান এখনই কক্সবাজারের একটি হোটেলের একটি স্যুটের মালিক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটাও সে পুরস্কার হিসেবেই পেয়েছে!
কোডিং ও অন্যান্য
আঁকাআঁকি করে এত পুরস্কার পেলেও রাফসানের সবচেয়ে ভালো লাগে কোডিং করতে। ছয় বছর বয়সে চাচাতো ভাইবোনদের গেমস খেলতে দেখে রাফসানের মাথায় প্রশ্ন আসে, গেমস তৈরি হয় কীভাবে? আরেকটু বড় হয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে প্রোগ্রামিং ও কোডিংয়ের ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করে সে। এখন বেশ ভালোভাবেই চলছে কোডিং শেখা। শিখতে শিখতে ছোটখাটো ১৭টি গেমসও বানিয়ে ফেলেছে সে। এ ঝুলিতেও কিছু পুরস্কার আছে রাফসানের।
লেখালেখিতেও রাফসানের খুব আগ্রহ। গল্প ও কবিতা লিখেও বেশ কয়েকবার পুরস্কার জিতেছে সে। এত কিছু করেও পড়ালেখায় সব সময় ভালো করার চেষ্টা করে রাফসান। ক্লাসের সেরা ছাত্র না হলেও ক্লাসে রাফসানের অবস্থা বেশ ভালো।
রাফসানকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বড় হয়ে সে কী হতে চায়। উত্তরটা রাফসানের মুখে শুনি, ‘প্রথমে আর্মি হতে চেয়েছিলাম, তারপর সায়েন্টিস্ট, এখন আপাতত আর্কিটেক্ট হতে চাই। কারণ, ম্যাথ আমার খুব প্রিয়। আর আঁকাআঁকিটাও। এই দুটো মিলিয়ে আর্কিটেক্ট হতে চাই। সুযোগ পেলে প্রোগ্রামারও হয়ে যেতে পারি।’ তবে রাফসানের মা–বাবার চাওয়া, সন্তান যেন সবার আগে ভালো মানুষ হয়।