প্লাইস্টোসিন যুগের ম্যামথ কীভাবে ফিরে আসবে
সম্ভবত কিছুকালের মধ্যেই পৃথিবীতে আর কখনো কোনো প্রাণী হারিয়ে যাবে না। এমন নতুন এক জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি আবিষ্কার করা হয়েছে, যেখানে প্রাণীদের জিন সংরক্ষণ করে প্রাণীকে আবারও পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যাবে। নতুন এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে মাটির নিচে চাপা পড়া প্রাণীর দেহাবশেষ থেকে পুনরুদ্ধার করবেন জিন। যা দিয়ে তৈরি হবে প্রাচীন সেই প্রাণী। হাজার হাজার বছর আগে যে প্রাণী পৃথিবীতে চরে বেড়িয়েছে, সেই প্রাণী আবারও ফিরে আসবে প্রকৃতিতে। এমনই একটি প্রাণী ম্যামথ।
আইস এজ সিনেমায় প্লাইস্টোসিন যুগের (২৫ লাখ ৮০ হাজার বছর থেকে ১১ হাজার ৭০০ বছর আগে) প্রাণীরা টিকে থাকার জন্য নানা কিছু করে। এই প্রাণীর দলে বিশালাকার হাতির আকৃতির পশমযুক্ত যে দাঁতাল প্রাণীগুলোকে দেখা যায়, ওরাই ম্যামথ।
স্থানীয় বাসিন্দারা দেহাবশেষটি আবিষ্কার করেন যখন পুরোনো আগ্নেয়শিলার একটি অংশ ধসে পড়ে। এতে ম্যামথের সামনের অংশ গর্তের নিচে পড়ে যায়, আর পেছনের অংশ (যেমন পেছনের পা) স্থায়ী তুষারে আটকে থাকে। চেপ্রাসভ জানান, তাঁর সহকর্মীরা পরে পেছনের অংশটি সংগ্রহ করেন।
সম্প্রতি রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা একটি শাবক ম্যামথের দেহাবশেষ উপস্থাপন করেছেন, যেটি খুব ভালোভাবে প্রকৃতিতে সংরক্ষিত ছিল। সাইবেরিয়ার ইয়াকুটিয়া অঞ্চলে গত জুন মাসে এই ম্যামথের দেহাবশেষটি পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ম্যামথের দেহাবশেষ ৫০ হাজার বছরের বেশি পুরোনো।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তাস জানিয়েছে, তুন্দ্রা অঞ্চলের একটি স্থায়ী তুষারের নিচের মাটি ধসে যাওয়ার পরে স্থানীয় বাসিন্দারা এটি আবিষ্কার করেন। নর্থ-ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিভার্সিটির ম্যামথ মিউজিয়ামের ল্যাবরেটরি প্রধান ম্যাক্সিম চেপ্রাসভ বলেন, ‘আমরা বলতে পারি, এটি বিশ্বের সর্বকালের সেরা ম্যামথ আবিষ্কারগুলোর মধে৵ একটি।’
চেপ্রাসভের মতে, ম্যামথটি মারা যাওয়ার সময় প্রায় এক বছর বয়সের ছিল। এর ওজন ছিল প্রায় ৩৯৭ পাউন্ড (১৮০ কিলোগ্রাম)। রেডিওকার্বন বিশ্লেষণের ফলাফলের ভিত্তিতে এর ভূতাত্ত্বিক বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ হাজার বছর। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সে সময়ের কঠিন আবহাওয়ার কারণে ম্যামথ শাবকেরা আজকের দিনের ঘোড়া, বাইসন ও নেকড়েছানার তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেত। চেপ্রাসভ বলেন, ‘তাদের বড় হতে হতো শীতের কঠিন পরিস্থিতি সহ্য করে।’
ম্যামথের দেহাবশেষটি বাটাগাইকা ক্রেটার বা খাদে পাওয়া গেছে। এই খাদ রয়েছে একটি আগ্নেয়শিলা অঞ্চলে। এটি ১৯৬০ সাল থেকে ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। তাই এই অঞ্চলে নিয়মিত ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। এভাবে এই ক্রেটারে এর আগে অন্যান্য প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী, যেমন ঘোড়া ও বাইসনের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা দেহাবশেষটি আবিষ্কার করেন যখন পুরোনো আগ্নেয়শিলার একটি অংশ ধসে পড়ে। এতে ম্যামথের সামনের অংশ গর্তের নিচে পড়ে যায়, আর পেছনের অংশ (যেমন পেছনের পা) স্থায়ী তুষারে আটকে থাকে। চেপ্রাসভ জানান, তাঁর সহকর্মীরা পরে পেছনের অংশটি সংগ্রহ করেন।
এই শাবক ম্যামথ আবিষ্কারের আগে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মোট ছয়টি সম্পূর্ণ ম্যামথের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে পাঁচটি রাশিয়ায় এবং একটি কানাডায়। নর্থ-ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিভার্সিটির রেক্টর আনাতোলি নিকোলায়েভ বলেন, ‘এটি শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাশিয়ান বিজ্ঞান নয়; বরং বিশ্ব বিজ্ঞানেও একটি অনন্য আবিষ্কার।’
ম্যামথের একটি প্রজাতি উলি ম্যামথ, পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে চার হাজার বছর আগে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন সেটি আবার সৃষ্টি করার। একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা।
ডালাসভিত্তিক কোম্পানি কলোসাল বায়োসায়েন্সেস, উলি ম্যামথের মতো দেখতে একটি হাইব্রিড তৈরি করতে এশিয়ান হাতির কোষ জেনেটিক রি-ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে। কারণ, এশিয়ান হাতি উলি ম্যামথের নিকটতম জীবন্ত আত্মীয়।
সংশোধিত এই কোষগুলো ভবিষ্যতে এমন একটি হাইব্রিড ম্যামথ তৈরি করতে সাহায্য করবে, যা উলির মতো চামড়া এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে, যা তাকে আর্কটিকে বেঁচে থাকতে সক্ষম করবে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বাস করে, উলি ম্যামথ পুনরুজ্জীবিত করা আর্কটিক তুন্দ্রা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
জেনেটিসিস্ট বা জিনবিজ্ঞানীরা জিন নিয়ে গবেষণা করেন। জিন দিয়ে তৈরি হয় আমাদের ডিএনএ। জিনোম দেহের নির্দিষ্ট অংশকে বেড়ে উঠতে এবং কাজ করতে নির্দেশ দেয়। বিজ্ঞানীরা রোগ নিরাময় এবং বার্ধক্যের প্রভাব কমাতে জিনের বিজ্ঞান ব্যবহার করেন। উলি ম্যামথের এখন ডিএনএ কোড লিখে ফেলা সম্ভব। এই কোড থেকে বরফযুগের তৃণভোজী প্রাণীকে আবারও পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।
একদল বিজ্ঞানী উলি ম্যামথ (Mammuthus primigenius) ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। উলি ম্যামথ বরফযুগে বাস করত। দেখতে লোমশ হাতির মতো এই ম্যামথ সর্বশেষ প্রায় চার হাজার বছর আগে মারা গেছে।
বেন মেজরিচ উলি: দ্য ট্রু স্টোরি অব দ্য কুয়েস্ট টু রিভাউভ অন অব হিস্টরিজ মোস্ট আইকনিক এক্সটিংক স্পেসিস নামে একটি বই লিখেছেন। তিনি সেসব বিজ্ঞানীকে অনুসরণ করেছেন, যাঁরা উলি ম্যামথ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক মেজরিচের সঙ্গে কথা বলেছে। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কেন কিছু মানুষ মনে করেন উলি ম্যামথ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে পারে। তিনি নতুন ম্যামথ তৈরি করার বিষয়ে উদ্বেগের কথাও বলেছেন। উলি ম্যামথ ফিরিয়ে আনার কথা শুনলে মনে হয়, জুরাসিক পার্ক সিনেমার মতো। আসলেই কি ফিরে আসছে উলি ম্যামথ?
বেন মেজরিচ জানান, মানুষের কাছে এখন নতুন জেনেটিক প্রযুক্তি রয়েছে। আগে শুধু ডিএনএ পড়া যেত। এখন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে কোড লেখা যায়। এই প্রযুক্তির হাত ধরে আগামী ৩০ বছরে পৃথিবী সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে পরিণত হবে। জীবন্ত প্রাণীর বিজ্ঞান আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
জিনবিজ্ঞানী জর্জ চার্চ উলি ম্যামথ পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চান। এই বিজ্ঞানী দেখতে অনেকটা সিনেমার চরিত্রের মতো। তাঁর বয়স প্রায় ৭০ বছর। তিনি দ্রুত মানব জিন ম্যাপিং এবং পড়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। তাঁর গবেষণাগারে উলি ম্যামথ প্রকল্পের কাজ চলছে। তাঁর নেতৃত্বে একটি দল ম্যামথ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন হলো, কেন উলি ম্যামথ তৈরি করা হবে? এর একটি উত্তর রাশিয়ায় পাওয়া যায়। সাইবেরিয়ার সমভূমি উত্তরের বিশাল তৃণভূমি। এগুলো স্থায়ী তুষারে (যে তুষার দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে জমে আছে) ঢাকা। হাজার হাজার বছর ধরে এই বরফ জমে আছে। সেখানে এখন আগের মতো আর প্রাণী নেই।
প্রথমে বরফ থেকে প্রাণীর জমাটবাঁধা দেহ তোলা হয়। এরপর এর একটি অংশ নিয়ে জিন ম্যাপ করা হয়। একবার জিন পাওয়া গেলে শুধু ম্যামথের জিন আলাদা করা হয়। ম্যামথের প্রায় সব জিন এশিয়ান হাতির মতো। প্রথমে ল্যাবে ম্যামথের জিন তৈরি করা হবে।
কার্বন তুষারে আটকা পড়ে। কার্বনমুক্ত হলে বায়ুমণ্ডল আরও উষ্ণ হয়ে উঠবে। সমস্যা হলো পৃথিবী এরই মধ্যে উষ্ণ হয়ে উঠছে। যদি এই তুষার গলে যায়, তবে সব কার্বন মুক্ত হয়ে যাবে। সের্গেই জিমভ এবং তাঁর ছেলে নিকিতা রাশিয়ার বিজ্ঞানী। তাঁরা একটি পরীক্ষা চালিয়েছেন। তাঁরা সমভূমির একটি অংশ আটকে দিয়েছেন। সেখানে পুরোনো প্রাণীদের ফিরিয়ে এনেছেন। রেইনডিয়ার, বাইসন ও ইয়াকুট ঘোড়া ফিরিয়ে আনা হয়েছে এই এলাকায়।
রাশিয়ার ওই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, প্রাণীরা স্থায়ী তুষারকে আরও ঠান্ডা করে। এদের কারণে তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) কমে যায়। কারণ, বড় তৃণভোজীরা তৃণমূল জন্মাতে সাহায্য করে। এই হালকা রঙের তৃণমূল সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে, যা তাপ কমায়। ম্যামথ যোগ করা হলে এটি আরও কার্যকর হবে।
সাইবেরিয়ায় ম্যামথের অনেক হাড় পাওয়া যায়। মানুষ সেখান থেকে এর দাঁত সংগ্রহ করে। কারণ, এই অঞ্চলে স্থায়ী তুষার ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে। উলি ম্যামথের জীবাশ্ম সেখানে প্রায়ই পাওয়া যায়। এর দাঁতের মূল্য প্রায় আড়াই লাখ ডলার। হাতির দাঁত বিক্রি নিষিদ্ধ; কিন্তু ম্যামথের দাঁত বিক্রি করা বৈধ। কারণ, ম্যামথ বিলুপ্ত প্রজাতি। এটি বিপন্ন নয়। ইয়াকুট একটি নৃগোষ্ঠী। তাঁরা ছোট ছোট দ্বীপে যায়, যেখানে ম্যামথের অনেক হাড় পাওয়া যায়। তারা বরফ খুঁড়ে দাঁত বের করে আনে। একটি দাঁত পেলে একটি ইয়াকুট গ্রামের পুরো বছরের খরচ চালানো যায়।
প্রথমে বরফ থেকে প্রাণীর জমাটবাঁধা দেহ তোলা হয়। এরপর এর একটি অংশ নিয়ে জিন ম্যাপ করা হয়। একবার জিন পাওয়া গেলে শুধু ম্যামথের জিন আলাদা করা হয়। ম্যামথের প্রায় সব জিন এশিয়ান হাতির মতো। প্রথমে ল্যাবে ম্যামথের জিন তৈরি করা হবে। এরপর এগুলো এশিয়ান হাতির ভ্রূণে স্থাপন করা হবে। ভ্রূণ হাতির গর্ভে ম্যামথ শাবকের মতো বেড়ে উঠবে। হাতি একটি ম্যামথ জন্ম দেবে। ল্যাবে কৃত্রিম গর্ভেও ম্যামথকে বড় করে তোলা যাবে।
এভাবে প্রাণী সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।
সূত্র: সিএনএন ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক