ক্ষমতায় টিকে থাকতে আর কত শিশু হত্যা করবেন নেতানিয়াহু

গাজা যুদ্ধে নিহতদের বড় একটি অংশ শিশুফাইল ছবি: রয়টার্স

আমরা যারা বাংলাদেশে থাকি, তারা কি কখনো কল্পনা করতে পারি, এই যে আমরা বাসার ভেতরে আছি বা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, যেকোনো সময় আকাশ থেকে বোমা পড়েতে পারে; যেকোনো সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এসে আমাদের গুলি করতে পারে! কিংবা ধরা যাক, কাউকে উদ্ধার করার জন্য একদল স্বেচ্ছাসেবী একটা জায়গায় যাচ্ছে, রাস্তায় মধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই একটা দল এসে গুলি করে তাদের মেরে ফেলবে!

শুধু বাংলাদেশ কেন, কোনো স্বাধীন দেশেই এটা সম্ভব নয়। তবে কল্পনাকে হার মানানো এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটে ফিলিস্তিনে। সেখানে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে কিংবা ঘরের মধ্যে থাকা অবস্থায় বোমার আঘাতে নিহত হন। হাঁটতে বের হয়ে গুলি খেয়ে মারা যায় মানুষ। এমনকি যাঁরা উদ্ধারকাজ করেন, গুলি খেয়ে মারা যান তাঁরাও। যদিও যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে কোনো স্বেচ্ছাসেবী, বিশেষ করে যাঁরা চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন, তাঁদের হত্যা, গ্রেপ্তার কোনো কিছুই করার নিয়ম নেই।

অথচ সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে ফিলিস্তিনের গাজায়। দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায় গত ২৩ মার্চ রাতে ১৫ জন জরুরি সেবাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েল। এই ভিডিওতে দেখা গেছে, জরুরি সেবাকর্মী গাড়ি নিয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাচ্ছিলেন। কোনো ধরনের সতর্কসংকেত বা কোনো ধরনের কথাবার্তা ছাড়াই তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ভিডিও প্রকাশের পর নিজেদের সেনাদের ‘ভুল’ স্বীকার করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। কিন্তু ভুল স্বীকার করলে কি আর মানুষের জীবন ফিরে আসবে?

আরও পড়ুন

কেউ মারা গেলে সে আর ফিরে আসে না। যেমন ফিরে আসবে না গাজার ১৫–২০ হাজার শিশু। ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় যে হামলা শুরু করেছে, সেই যুদ্ধে এই শিশুরা প্রাণ হারিয়েছে। নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের। হিসাবটা জাতিসংঘের। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হয়। এই শিশুদের হত্যা করা হয়েছে কেন? বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই সত্য, শুধু একজন মানুষের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এই হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে। গত ১৮ মার্চের পর থেকে এটা একেবারেই সত্য যে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শুধু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী পদে টিকে থাকার জন্য নতুন করে গাজায় হামলা শুরু করেছেন।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এ যুদ্ধের পটভূমি জানা দরকার। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এতে নিহত হয়েছিল এক হাজারের বেশি ইসরায়েলি। আর দুই শতাধিক ইসরায়েলিকে বন্দী করেছিল সংগঠনটি। এর পাল্টা জবাব হিসেবে সেদিনই হামলা শুরু করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ। হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই যুদ্ধ হামাসের বিরুদ্ধে। তাদের গাজা থেকে সমূলে উৎপাটন করা হবে। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, সেই হামলা এখনো চলছে। তবে আইডিএফের হামলায় শুধু হামাসের যোদ্ধারা মারা যাচ্ছেন, এমনটা নয়। যুদ্ধ শুরুর পর ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর অধিকাংশই নারী–শিশুসহ নিরস্ত্র মানুষ।

আরও পড়ুন

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে আন্তর্জাতিক মহলের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা হয়েছে। সর্বশেষ জানুয়ারিতে দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সম্মত হয়। ১৯ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয় এই যুদ্ধবিরতি। অর্থাৎ কেউ আর হামলা চালাবে না। হামাস ইসরায়েলি বন্দীদের ছেড়ে দেবে। বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারে যেসব ফিলিস্তিনি বন্দী আছে, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে।

কিন্তু গত ১৭ মার্চ দিবাগত রাত বা ১৮ মার্চ প্রথম প্রহরে থেকে গাজায় আবারও হামলা শুরু করে ইসরায়েল। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বেশ কিছু কারণে ইসরায়েল হামলা শুরু করেছে। একটি কারণ হিসেবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা চেয়েছিল, হামাসের হাতে বন্দী সব ইসরায়েলিকে ছেড়ে দিতে হবে। এই শর্ত না মানায় তারা হামলা শুরু করেছে।

তবে ইসরায়েলের এই দাবি খারিজ করেছে হামাস। তারা বলছে, মার্চ থেকেই যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে ঢোকার কথা। এই ধাপে গাজার পুরো নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার কথা ইসরায়েলি বাহিনীর। তবে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা ছেড়ে যাবে না বলে হামলা শুরু করেছে।

২০০৭ সাল থেকে গাজা শাসন করছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এখন প্রশ্ন হলো, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ কেন গাজার নিয়ন্ত্রণ ছড়তে চায় না? এর কারণ হলো, তারা যাদি গাজা ছেড়ে চলে যায়, তাহলে হামাস আবার শক্তিশালী হবে। তারা নতুন যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেবে। আর হামাস শক্তিশালী হওয়ার অর্থ হলো, তারা আবারও ইসরায়েলে হামলা চালাতে পারে। এ কারণে তারা গাজা ছেড়ে যেতে চায় না।

যুদ্ধবিরতি ভাঙার আরেকটি কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ইসরায়েলের এ অভিযান বা নতুন করে হামলা শুরুর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আর এ কারণেই হামলা শুরু করেছে আইডিএফ।

আরও পড়ুন

এর বাইরে নেতানিয়াহুর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার বিষয়টিও রয়েছে। মার্চের শেষের দিকে বা এপ্রিলের শুরুতে পার্লামেন্টে ভোট হওয়ার কথা ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, পার্লামেন্টের ওই ভোট জিততে পারতেন না নেতানিয়াহু। তাই ভোটে কট্টর ডানপন্থীদের সমর্থন পেতে নেতানিয়াহুর নির্দেশে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।

মার্চে হামলা শুরুর আরেকটি বড় কারণ আছে। সেটি হলো, দুর্নীতির অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিচার চলছে। গত ১৮ মার্চ এ মামলায় আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল নেতানিয়াহুর। এ মামলায় সাজা হলে তাঁকে জেলে যেতে হতো এবং তাঁর প্রধামন্ত্রিত্ব চলে যেত। এ কারণে ১৭ মার্চ রাতে হামলা শুরু করেছেন। আর পরদিন তিনি আদালতকে জানিয়ে দিয়েছেন, এখন যুদ্ধ চলছে। তাই বিচারে অংশ নেওয়া সম্ভব নয়।

শুধু নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য গাজায় আবারও হামলা শুরু করেছেন নেতানিয়াহু। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, নতুন করে হামলা শুরুর পর প্রতিদিনি ১০০ শিশু মারা যাচ্ছে। নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এখন নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছেন তিনি। এই হত্যাযজ্ঞ কবে থামবে, কেউ জানে না।

আরও পড়ুন