নীল আকাশে ডানা মেলা পাখির মতো বিমান উড়তে দেখলে সেই বিমান ওড়ানোর শখ জাগে অনেকেরই। সেই কিশোর বেলায় আমার ভেতরেও শখটা বেশ ভালোভাবেই মনে গেঁথে গিয়েছিল। সেই ইচ্ছের জোর ধরেই আমি এখন বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একজন ক্যাডেট পাইলট। তোমরা যারা ভাবছ যে বড় হয়ে পাইলট হবে, তোমাদের বলব এখন থেকেই সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাও।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুই ধরনের বিমানের পাইলট হওয়া যায়। ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট পাইলট বা পরিবহন বিমান আর আরেকটি হচ্ছে যুদ্ধবিমানের পাইলট বা ফাইটার এয়ার ক্রাফট পাইলট। যুদ্ধবিমানের পাইলট হওয়ার জন্য বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিমানবাহিনীতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া যায়। সেই পরীক্ষার পর আছে মেডিকেল টেস্ট এবং আরও কিছু সামরিক নিয়মকানুন। সেগুলোতে উত্তীর্ণ হতে পারলেই তুমি যুদ্ধবিমানের পাইলট হতে পারবে।
এ ছাড়া সেনাবাহিনী কিংবা নৌবাহিনীতেও এভিয়েশন কোর আছে এখন। এ ক্ষেত্রে প্রথমে সেনাবাহিনী কিংবা নৌবাহিনীতে যোগ দিয়ে পরে এভিয়েশন কোরের মাধ্যমে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানের পাইলট হওয়া যায়। তবে যুদ্ধবিমানের পাইলট হওয়ার সহজ পন্থা হলো সরাসরি বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়া।
এ তো গেল যুদ্ধবিমানের পাইলট হওয়ার নিয়মের কথা, তোমরা চাইলে বেসামরিক বিমানও চালাতে পারো। বোয়িং ৭৭৭, এয়ারবাস কিংবা যত এয়ারক্রাফট আছে, এগুলোর সবই ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট। যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের জন্যই এসব ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট কাজ করে। এই বিমান চালানোর জন্য লাগে কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স। যখন কেউ সামরিক বিমানবাহিনীতে পাইলট হিসেবে থাকে, তখন সে কোনো মিশন ছাড়া দেশের বাইরে বিমান নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু কারও যদি কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স থাকে, তাহলে সে সারা বিশ্বেই বিমান নিয়ে যেতে পারবে। আন্তর্জাতিকভাবে এই লাইসেন্স দেয় (icao international civil aviation organization) নামের একটি সংগঠন। বাংলাদেশে এই লাইসেন্স অ্যাপ্রোভ করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। এক দেশের বিমান, মালামাল কিংবা যাত্রী অন্য দেশের ওপর দিয়ে যাবে এই বিষয়টি নিয়ে সারা বিশ্বে ১৯৪৪ সালে এই আইসিএও চুক্তিটা হয়। ১৯৪টি দেশ এই চুক্তির আওতাভুক্ত।
বাংলাদেশে বেসামরিক বিমানের পাইলট হতে হলে প্রথমত বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি অথবা ‘ও’ লেভেল ‘এ’ লেভেল পাস থাকতে হবে এবং অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিত থাকতে হবে। এবং এর সঙ্গে মেডিকেলি ফিট হওয়া আবশ্যকীয়। মেডিকেলি ফিট হওয়া বলতে হার্টের সমস্যা আছে কি না, কালার ব্লাইন্ড কি না, উচ্চতাভীতি আছে কি না, সেসব ব্যাপার যাচাই করা হয়ে থাকে। অনেকের মনে একটা দ্ব্বিধা থাকে যে চশমা পরলে পাইলট হওয়া যায় কি না? বেসামরিক বিমানের পাইলট হওয়ার ক্ষেত্রে চশমা পরা তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। এ ক্ষেত্রে চশমা পরার পর কারও চোখ যদি ৬/৬ হয়, তাহলে সিভিল এভিয়েশন বিমান চালানোর অনুমতি দেয়। মেডিকেলি কোনো সমস্যা না থাকলে বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশনের অধীনে তিনটি ফ্লাইং স্কুলের যেকোনোটায় ভর্তি হওয়া যায়। এগুলোতে ভর্তি হওয়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। ভর্তি পরীক্ষায় টেকার পর নেওয়া হয় ভাইভা। আরিরাং ফ্লাইং স্কুল, গ্যালাক্সি ফ্লাইং একাডেমি এবং বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাব নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান এই কাজটা করে থাকে।
এখানে ফ্লাইং কোর্সে দুই বছরে বাইশটি বিষয় পড়ানো হয়। যেগুলো বিশ্বের সব ফ্লাইং কোর্সেই পড়ানো হয়। কেউ চাইলে অনার্সের পাশাপাশিও ফ্লাইং কোর্স সম্পন্ন করতে পারবে। তবে সেটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। অনার্স শেষ করেও ফ্লাইং কোর্সে ভর্তি হওয়া যায়। তবে সব থেকে ভালো হয় এইচএসসি পরীক্ষার পরে দুই বছরের এই কোর্স সম্পন্ন করলে। তবে এই কোর্সের মান বাংলাদেশে অনার্স কিংবা ডিপ্লোমা হিসেবে ধরা হয় না। এই কোর্স শুধু বিমান চালানোর ছাড়পত্র দেয়। এসব ফ্লাইং কোর্সের পাস মার্কস শতকরা ৭৫। কিছু সাবজেক্টে পাস মার্কস শতকরা ৯০। সুতরাং এসব কোর্স পড়তে হলে সময় দিতে হবে অনেক।
সব কোর্সে উত্তীর্ণ হলেই কেবল বিমান চালানোর লাইসেন্স পাওয়া যায়। এই লাইসেন্স পাওয়ার পরে এয়ারলাইনে অ্যাপ্লাই করতে হয়। মোটামুটি এসব পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধ্যমেই তুমি হয়ে উঠতে পারো একজন সফল বিমানচালক। বিমানচালক হতে হলে তোমাকে অবশ্যই সাহসী, অধ্যবসায়ী এবং প্রচুর পড়াশোনা করতে পারার মানসিকতা নিয়ে তবেই এগোতে হবে।