এক জার্মান শেফার্ডের নতুন জীবন
গত ৫০ বছরে পৃথিবীর মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্যোগ কী? উত্তর নিশ্চয়ই কোভিড-১৯। এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি কোনো না কোনোভাবে এই মহামারিতে আক্রান্ত হননি। কারও নিকটজন মারা গেছেন, কেউ হারিয়েছেন চাকরি। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েছেন বহু মানুষ। মানুষ লকডাউনে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। ফলে প্রকৃতিতে দেখা গেছে বড় পরিবর্তন। যেমন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে দেখা গেছে গোলাপি ডলফিন। বিশ্বের অনেক দেশের রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে বন্য প্রাণী। একটু ভাবলেই বুঝবে, এত দিন মানুষ ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের সবচেয়ে বড় প্রভাবক। মানুষের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ফলে প্রকৃতি এমনভাবে নিয়মের মধ্যে ছিল, যেখানে বন্য প্রাণী মানুষের কার্যক্রমে প্রভাবিত হয়ে জীবন কাটায়। বন্য প্রাণীর বাইরে আরও কিছু প্রাণী আছে, যারা ঠিক বন্য নয়। মানুষের কাছাকাছিই বাস করে। কখনো সুযোগ পেলে মানুষের ঘরে থাকে। কখনো মানুষের ফেলে দেওয়া খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। যেমন কুকুর ও বিড়াল। মানুষের ঘরে বাস করলে এরা খাবার পায়। কিন্তু মালিকানা না থাকা কুকুর–বিড়াল, যাদের বলা হয় স্ট্রে ক্যাট বা ডগ, এরা মানুষের আশপাশে থাকে। মানুষের দেওয়া বা ফেলে দেওয়া খাবারে নির্ভর করে বেঁচে থাকে এরা।
কোভিডকালের কথা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে। অনেকেই অন্যদের সাহায্য করেছে কঠিন এই সময় পার করতে। এমনই একজন মো. আবু বকর সিদ্দিক। এখন বোরহানুদ্দীন কলেজে বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। কোভিডকালে তিনি ছিলেন নটর ডেম কলেজের ছাত্র। লকডাউন শুরু হলো। কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। আবু বকর দেখলেন, পথে থাকা কুকুর-বিড়াল অসহায় হয়ে পড়েছে। মানুষ অন্যের কাছে সাহায্য চাইতে পারে। কিন্তু এসব প্রাণীকে কে খাওয়াবে? এই ভাবনা থেকে আবু বকর ফান্ড ও খাবার জোগাড় করার চেষ্টা শুরু করেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার প্রাণীকে উদ্ধার করেছে আবু বকর।
শুরুর গল্পটা হলো, স্কুলে থাকতে একবার মা–বাবার সঙ্গে রিকশায় যাওয়ার সময় পথে বিড়াল দেখে মায়া হয়েছিল আবু বকরের। বিড়ালটা ছিল পক্ষাঘাতগ্রস্ত। পানিতে ভেজা ছোট্ট বিড়াল। একপলক দেখে সেবার চলে যায় আবু বকর। তখন কিছু করতে না পারলেও স্মৃতিতে বিষয়টা থেকে যায়। আবু বকরের ছোট ভাই ওমর ফারুক বাড়ির নিচে থাকা একটি বিড়ালকে খাবার দিত। তখন রমজান মাস। বিড়ালটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিড়ালকে নিয়ে দুই ভাই ছোটে কাছের একটি ভেটেরিনারি বা পশু হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসক ইনজেকশন দেন। কিন্তু ইনজেকশনের ডোজ হয়ে যায় অনেক বেশি। বাসায় নিতে নিতে বিড়ালের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। কী করব কী করব ভাবতে ভাবতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন কমিউনিটিতে বিড়ালটিকে বাঁচানোর জন্য সাহায্য চেয়ে পোস্ট করেন আবু বকর। অন্যরা প্রথমে বলেন, কেমন করে এই বিড়ালটিকে ওভারডোজ দেওয়া হলো? ঈদের দুদিন পর বিড়ালটি মারা যায়। এরপর বিড়ালের চিকিৎসা নিয়ে জানতে শুরু করেন আবু বকর। এরপর নিজের এলাকার কুকুর–বিড়ালের উদ্ধারকারী হয়ে ওঠেন তিনি।
যেভাবে উদ্ধার করা হয়
আবু বকরকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন করে একটা অসুস্থ প্রাণীকে উদ্ধার করেন?—কয়েকভাবে, আবু বকরের উত্তর। যেমন স্পট ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়। যেখানে প্রাণী আছে, সেখানেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। খাবার সরবরাহ ঠিকঠাক আছে কি না, যেটা খেয়ে প্রাণী এত দিন বেঁচে ছিল, সামনেও থাকবে, এটা দেখেন উদ্ধারকারীরা। তারপর ওষুধ লাগিয়ে বা চিকিৎসা দিয়ে স্থানীয় লোকজনের কাউকে বলা হয়, আক্রান্ত প্রাণীকে যেন দেখাশোনা করেন।
আরেক রকম উদ্ধার হলো, রাস্তায় কোনো প্রাণী যদি আঘাত পেয়ে পড়ে থাকে, দুর্ঘটনা ঘটে বা মাথা ফেটে গেছে এমন হলে রাস্তায় প্রাণীটিকে রেখে আসা হয় না। উদ্ধার করে শেল্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রেখে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এমন একটি শেল্টার আবু বকর নিজের বাসায় করেছেন। শেল্টারে দীর্ঘদিন প্রাণীকে রাখা হয় না। প্রাণীর অবস্থা বুঝে ফস্টার হোমে যোগাযোগ করা হয়। ফস্টার হোম হলো প্রাণীকে নিজের পরিবেশে অবমুক্ত করা বা কারও কাছে পালার জন্য দিয়ে দেওয়া পর্যন্ত যেখানে প্রাণী থাকে। প্রাণীকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা হয় এখানে। প্রাণীকে চাইলেই কোনো এক ফস্টার হোমে পাঠিয়ে দেওয়া যায় না। দেখতে হয়, ফস্টার হোম খালি আছে কি না। যেহেতু অনেক প্রাণী আহত হয় বা অসুস্থ হয়, যাদের মালিক নেই। এদের সবাইকে ফস্টার হোমে জায়গা দেওয়া হয় না। খোঁজ নেওয়া হয়, খালি আছে কি না। শুধু খালি থাকলেই হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। আবু বকরের মতো উদ্ধারকারীদের উদ্ধার করা প্রাণীকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য টাকা জোগাড় করতে হয়। ওষুধ ও পথ্য জোগাড় করতে হয়।
ধরা যাক, একটা বিড়াল উদ্ধার করা হবে। বিপদাপন্ন বিড়ালটিকে অবস্থা বুঝে উদ্ধার করা হয়। যদি পূর্ণবয়স্ক বিড়াল হয়, তাহলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। বিড়াল বা কুকুরকে চেষ্টা করা হয় নিজের পরিবেশেই চিকিৎসা দিতে। কিন্তু খুব ছোট বিড়াল, যার মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাকে ফস্টার হোমে নিয়ে এসে চিকিৎসা দেওয়া হয়। যদি কোনো মা বিড়াল পাওয়া যায়, বিচিত্র হলেও সত্য, মা বিড়ালের কাছে বাচ্চাকে দত্তক দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। দত্তক দেওয়ার পদ্ধতিও একটু বিচিত্র। প্রথমে একটি গামছা নিয়ে মা বিড়ালের গায়ে অনেকক্ষণ ডলাডলি চলে। পরে ওই গামছায় মা বিড়ালের গায়ের গন্ধ নিয়ে বাচ্চা বিড়ালটির গায়ে ভালো করে ডলা হয়। যেন মায়ের গন্ধ বাচ্চা বিড়ালের গায়ে লেগে যায়। পরে মা বিড়াল বাচ্চার গন্ধ শুঁকে কখনো বাচ্চাটিকে দত্তক নেয়, কখনো নেয় না। মায়ের সঙ্গ না পেলে বাচ্চা বিড়ালকে বাঁচানো কঠিন। মা যেভাবে বাচ্চা বিড়ালকে খাওয়ায়, পরিষ্কার করে, রক্ষা করে, মানুষের পক্ষে সেভাবে যত্ন নেওয়া সম্ভব হয় না। বিশেষ করে পরিষ্কার করা। ফলে ফস্টার মাদার না পেলে বাচ্চা বিড়াল বাঁচে না।
জার্মান শেফার্ড উদ্ধারের গল্প
আগেই বলেছি, নিজের বাসায় আবু বকর একটি ফস্টার হোম চালান। বিপদে পড়া কুকুর–বিড়াল এনে রাখেন। চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ছোট বিড়াল হলে কারও কাছে অ্যাডপ্টেশন বা পালতে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ওষুধ–পথ্য জোগাড় করেন। পুরান ঢাকার চকবাজারে থাকেন আবু বকর। ১৭ মাস আগের ঘটনা। আরমানিটোলায় বন্ধুর দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন আবু বকর। সঙ্গে ছিলেন আরেক উদ্ধারকারী বন্ধু। তখন একটি কুকুরকে রাস্তায় দেখতে পান তাঁরা। কুকুরটার ছবি দেখে বুঝতেই পারছ এর দুর্দশার কোনো শেষ নেই। পশম উঠে গেছে রোগে। পুরো শরীরের চামড়া রোগাক্রান্ত। পায়ে পোকা হয়ে গেছে। এক পায়ের শিরা কাটা। সম্ভবত অন্য কুকুরের আক্রমণে। সম্ভবত পোষা কুকুর কেউ রাস্তায় ফেলে গেছেন অসুস্থ হওয়ার কারণে। কুকুরটিকে দেখে দুই বন্ধু মিলে ঠিক করেন যে কুকুরটিকে উদ্ধার করবেন। হাতে কোনো টাকা নেই। এক হাজার টাকা ধার করে ধানমন্ডি, পূর্বাচলসহ কয়েক জায়গার ফস্টার হোমে ঘুরে জায়গা না পেয়ে শেষে গেলেন বছিলায়। সোনার বাংলা অ্যানিমেল ফস্টার হোমে।
শুরু হলো বিশেষ এক কুকুরকে বাঁচানোর লড়াই। ১৭ মাসে যার ভেতর দেখা যায় অসম্ভব সুন্দর পরিবর্তন। চর্মরোগে ভোগা কুকুর হয়ে যায় উজ্জ্বল পশমের এক অভিজাত কুকুর। চিকিৎসকের কথামতো এই কুকুরের জন্য দামি ওষুধ কিনতে হয় আবু বকরকে। কোভিডের সময় টাকা ও সময় দিয়ে যেসব ভাই সাহায্য করতেন, তাঁরা চলে গেছেন বিদেশে। এখন নিজে নিজে বিভিন্নজনের কাছ থেকে সাহায্য চান। এভাবেই বিশেষ এই কুকুরের জন্য কেনা হয় ‘ব্রাভিটরো’ নামের একটি বিশেষ ওষুধ, যার দাম ৫ হাজার ২০০ টাকা। কুকুরটির নাম রাখা হয় শিমু। পশম উঠে যাচ্ছিল। ঘা হয়ে গেছে। ফস্টার হোমের আপন হাসান নিরব নিয়মিত শ্যাম্পু দিয়ে শিমুকে গোসল করান। ধীরে ধীরে শিমুর অবস্থা ভালোর দিকে যাচ্ছিল। উদ্ধারের তিন মাস পর তার চামড়ার রোগ আবার বাড়তে থাকে। চতুর্থ মাসে আবার চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। চিকিৎসক পরামর্শ দেন যে পশমগুলো ফেলে দিতে হবে। কারণ, পশমে বাসা বেঁধেছে পোকা ও জীবাণু। আটকে আছে পথের ধুলাবালু। চিকিৎসক বলেন যে পশম ফেলে দিলে গরমের সময় আবার নতুন পশম গজাবে। তা–ই হলো। নিরব ভাইদের যত্নে সুস্থ হয়ে উঠল শিমু। ফিরে এল জার্মান শেফার্ড কুকুরের সৌন্দর্য। শিমু এখনো পুরোপুরি সুস্থ না হলেও অনেকটাই সুস্থ। আবু বকরের অনুমান, শিমুর বয়স ছয় থেকে নয় বছর, যেকোনোটিই হতে পারে।
মিলেছে স্বীকৃতি
অনেকগুলো উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন আবু বকর। মোহাম্মদপুর অ্যানিমেল রেসকিউ অ্যান্ড অ্যাডপশন সোসাইটি, মিরপুরের সেভ দ্য অ্যানিমেল, প ফাউন্ডেশনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করায় মিলেছে স্বীকৃতি। প ফাউন্ডেশন আবু বকরকে দিয়েছে ‘প্রাণবিক বন্ধু অ্যাওয়ার্ড ২০২১’। আবু বকরের দাবি, ছয় বছরে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার প্রাণী উদ্ধার করেছেন তিনি। নিজের এলাকায় কুকুর–বিড়ালের যত্ন নিয়ে দিন কাটে আবু বকরের। উদ্ধারের কাজ করে এলাকায় পরিচিতি এসেছে। লোকে কোনো অসুস্থ কুকুর-বিড়াল দেখলে খোঁজ করেন আবু বকরের। খোঁজ পেলেই ছুটে যাওয়া একরকম অভ্যাস হয়ে গেছে তাঁর। মানুষের মধ্যে সচেতনতা এসেছে। অন্তত উদ্ধারকারীর কাছে খবরটা পৌঁছে দেন তাঁরা। আবু বকর বন বিভাগের সঙ্গে কাজ করেছেন। একসময় সিটি করপোরেশন কুকুর নিধন কার্যক্রম শুরু করেছিল। এই কার্যক্রম বন্ধ করা নিয়ে আদালতের রায় পাওয়ার আগপর্যন্ত প্রাণী রক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন আবু বকর। সিটি করপোরেশনের সামনে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। এভাবেই প্রাণীদের প্রতি মায়া নিয়ে সামনে এগোতে চান তিনি। সচেতন হয়ে সবাই যেন প্রাণীদের সাহায্য করেন, এটাই আবু বকরের চাওয়া।