ছোটবেলায় সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করত, ‘তোমার সমুদ্র পছন্দ, না পাহাড়?’ আমি তখনো সমুদ্র বা পাহাড় দেখিনি। বানিয়ে একেক সময় একেক রকম উত্তর দিতাম। কখনো বলতাম, সমুদ্র পছন্দ করি। কখনো বলতাম পাহাড়। যখন সমুদ্রে প্রথম গেলাম, তখন বিশাল ঢেউয়ে খেলাম হাবুডুবু। তখন বুঝলাম, সাগরের পানি ভয়ংকর লবণাক্ত। তখন মনে প্রশ্ন জাগল, পুকুর, খাল, বিল, নদী বা বৃষ্টির পানি সবই মিষ্টি। কিন্তু সব নদ-নদীই তো আবার গিয়ে মেশে সাগরে। তবে এর রহস্যটা কী, কেন শুধু সমুদ্রের পানি লবণাক্ত?
প্রশ্নটির উত্তর আছে সাগরের পানিতেই লুকিয়ে আছে। আমরা জানি, পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় ৭১ শতাংশ পানি এবং ২৯ শতাংশ স্থল। পৃথিবীর বেশির ভাগ অঞ্চলজুড়ে আছে বিস্তৃত সাগর। এই সাগরের তলদেশে রয়েছে খনিজ পদার্থসমৃদ্ধ পাথর। আবার এই পাথর ইচ্ছে হলেই যে সাগরের পানিতে এসে মেশে, বিষয়টা মোটেও তা নয়। একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সমুদ্রের পানি লবণাক্ত হয়ে উঠেছে।
প্রথমে আমাদের বায়ুমণ্ডলের বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃষ্টির পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে তৈরি করে কার্বনিক অ্যাসিড। এই কার্বনিক অ্যাসিডসমৃদ্ধ জলীয় কণা বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে পৃথিবীতে। বৃষ্টির পানি ভাসিয়ে দেয় পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালা, সমুদ্র। তবে বৃষ্টির পানিতে কার্বনিক অ্যাসিডের পরিমাণ সামান্য, বেশি থাকে বিশুদ্ধ পানি। এই বৃষ্টির পানি থেকে আমরা পাই বিশুদ্ধ পানি। যার জন্য নদ-নদীর পানি মিষ্টি, লবণাক্ত নয়।
আবার সমুদ্রের পানি নোনতা হওয়ার পেছনে রয়েছে একধরনের অ্যাসিড বৃষ্টি। সাগরে প্রায়ই এ ধরনের অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। ফলে সমুদ্রের পানি হয়ে পড়ে অ্যাসিডিক। আবার সাগরের তলদেশে রয়েছে ক্ষারীয় খনিজসমৃদ্ধ মাটি ও পাথর। এরা এই অ্যাসিডের সংস্পর্শে এলে ক্ষয়ে যায়। আমরা জানি, সাগরের তলদেশে আগ্নেয়গিরি অবস্থিত, যা থেকে প্রতিনিয়ত উত্তপ্ত ম্যাগমার লাভা বের হচ্ছে। এ ছাড়া সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে বিশাল খাত, গিরিখাত ও বিশালাকারের গর্ত।
সাগরের তলদেশের পানি যখন এসব খাত ও গিরিখাত ও গর্ত ঢুকে পড়ে, তখন ম্যাগমার তাপে উত্তপ্ত হয়। এই উত্তপ্ত পানিও সাগরতলের পাথর ক্ষয় করে থাকে। ফলে ক্ষারীয় খনিজ এসে মেশে সমুদ্রের পানিতে। ঘটে অ্যাসিড-ক্ষারের বিক্রিয়া। আমরা জানি, অ্যাসিড ও ক্ষার বিক্রিয়া করে তৈরি হয় লবণ ও পানি। এভাবে সাগরের পানি হয়ে উঠেছে লবণাক্ত।
এখানেও আরেকটা মজার ব্যাপার আছে সেটা হলো, নদীর তলদেশেও তো রয়েছে ওরকম খনিজ পাথর। নদীতেও কিন্তু অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। ফলে এসব পাথর গলে লবণ ঠিকই মেশে নদীর পানিতে। তবু নদীর পানি মিষ্টি। এর কারণ রয়েছে নদীর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। নদী কিন্তু স্থির নয়। মানে সদা বহমান। সেই বিশাল পাহাড় থেকে বইতে বইতে এসে পড়ে সাগরে।
নদী প্রবাহিত হওয়ার সময় মাটির লবণ ও খনিজ পদার্থ ধুয়ে সাগরে নিয়ে যায়, নদীর পানিতে এসব পদার্থ জমে থাকার সুযোগ কম। সাগরের পানি বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে ওঠে ও বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। এভাবে সাগরে লবণের অনুপাত বাড়তে থাকে। নদীতে সে রকম হতে পারে না। সাগরের পানি জমা হচ্ছে চার থেকে পাঁচ শ কোটি বছর ধরে, কিন্তু সে তুলনায় নদীর পানি মাত্র কয়েক লাখ বছর ধরে বয়ে চলেছে।
এই প্রবাহই পানিকে রাখে বিশুদ্ধ, লবণমুক্ত। আর সমুদ্রের বিশাল এলাকাজুড়ে ঢেউ বয়ে গেলেও, বিশাল এই সামুদ্রিক খাঁচায় বন্দীই রয়ে যায় লবণাক্ত পানি। সে জন্যই সমুদ্রের পানি লবণাক্ত আর নদীর পানি সুপেয়।
তবে বাংলাদেশে খুলনার ভৈরব, রূপসা প্রভৃতি নদীর পানি কিছুটা লবণাক্ত। এর কারণ মূলত জোয়ারের সময় নদীর মোহনায় সাগরের পানি চলে আসে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে, এ জন্য আমাদের দেশের কিছু নদীর পানি মোহনার পরও উজানে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত লবণাক্ত হয়ে পড়ছে।