এই দ্বীপে হাসপাতাল, চিকিৎসক বা পুলিশ নেই, আছে শুধু পাখি

পৃথিবীর যেকোনো দ্বীপ, দেশ বা জনপদে পাখিরা দূরদূরান্ত থেকে উড়ে এসে আবাস গড়ে। কিন্তু তোমরা কি জানো, পাখিদেরও নিজস্ব দ্বীপ আছে? আর সেই দ্বীপের রূপে মুগ্ধ হয়ে বহুদূর পাড়ি দিয়ে আবাস গড়েছে মানুষ। গ্রিমসে নামের এই দ্বীপে পাখির সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। আর কিচিরমিচিরে মুখর দ্বীপটিতে বর্তমানে মানুষের সংখ্যা মাত্র ২০। আইসল্যান্ডের উত্তর উপকূল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে এই দ্বীপ অবস্থিত। বলা হয়ে থাকে, ইউরোপের সবচেয়ে দূরবর্তী জনবসতির দ্বীপ গ্রিমসে।

৬ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের হিমশীতল দ্বীপ গ্রিমসে আইসল্যান্ডের সবচেয়ে উত্তরের জনবসতিপূর্ণ এলাকা। এটি আর্কটিক সার্কেলের মধ্যে অবস্থিত আইসল্যান্ডের একমাত্র অংশ। এ কারণে পাখিপ্রেমী পর্যটকদের কাছে ভ্রমণের জন্য দ্বীপটি বেশ আকর্ষণীয়।

১৯৩১ সাল পর্যন্ত গ্রিমসে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় ছিল একটি ছোট্ট নৌকা। বছরে দুবার এই নৌকায় চড়ে দ্বীপে চিঠি পৌঁছে দেওয়া হতো। তবে বর্তমানে আইসল্যান্ডের আকুরেরি শহর থেকে উড়োজাহাজে মাত্র ২০ মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যায়। এ ছাড়া ডালভিক গ্রাম থেকে তিন ঘণ্টার ফেরি যাত্রা করে এই পাথুরে প্রত্যন্ত দ্বীপে পৌঁছে যাওয়া যায়। দুঃসাহসিক অভিযাত্রীদের কাছে দ্বীপটি বেশ জনপ্রিয়। পর্যটকেরা বিপুল ও বিচিত্র সামুদ্রিক পাখি ও বন্য প্রাণী দেখতে আগ্রহী। গ্রিমসেতে কমলা ঠোঁটের পাফিন পাখির সংখ্যাই বেশি। এ ছাড়া এ দ্বীপটি কালো পায়ের কিটিওয়াকস, রেজারবিল ও গিলেমোটস পাখিরও আবাসস্থল। এসব সামুদ্রিক পাখি দেখতে অপূর্ব সুন্দর। দ্বীপজুড়ে আইসল্যান্ডিক ঘোড়া ও ভেড়ার বিচরণও আছে।

আছে একটি হস্তশিল্পের গ্যালারি ও একটি ক্যাফে। এই ক্যাফেতে ঘরে তৈরি আইসল্যান্ডিক জিনিসপত্র ও পোশাক বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া দ্বীপে মাত্র একটি ছোট্ট মুদিদোকান আছে। বাজার করার জন্য প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টা খোলা থাকে এই মুদিদোকান।

গ্রিমসে দ্বীপের বাসিন্দা ও স্থানীয় ট্যুর গাইড হাল্লা ইঙ্গলফসডোটির বলেছেন, ‘আপনার বিশ্বাস হবে না যে এখানে আমরা ২০ জন মানুষ পুরো সময় বাস করি।’

হাল্লার জন্ম আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকজাভিকে। দক্ষিণ-পূর্ব আইসল্যান্ডে বেড়ে ওঠা হাল্লা ২০ বছরের বেশি সময় গ্রিমসে দ্বীপে আসা–যাওয়া করেছেন। এই আসা–যাওয়ার মাঝে স্থানীয় এক জেলের প্রেমে পড়েন এই নারী। একে তো দ্বীপের প্রতি ভালোবাসা, তার ওপর জেলের প্রতি প্রেম তাঁকে এই দ্বীপে স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। তবে ওই জেলেকে বিয়ে করার পর তিনি নিজ শহরে ফিরে গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে এই দ্বীপের স্থায়ী বাসিন্দা হন তিনি। এরপর আর ফিরে যাননি।

হাল্লা বলেন, ‘মানুষের ধারণা, প্রেমের টানে আমি এখানে এসেছি। কিন্তু আমি আসলে এই দ্বীপের প্রেমে পড়েছি। এখানে জাদু আছে, এখানে মানুষ কীভাবে বাস করে, দ্বীপবাসী এবং পুরো প্রকৃতির প্রেমে পড়েছি। প্রকৃতি এখানে খুব শক্তিশালী; শীতের রাতে অন্ধকারের পাশাপাশি এখানে মায়াবী রহস্যময় আলোর ঝলকানি আসে। এই আলোর ঝলকানি আসলে মেরুজ্যোতি (নর্দার্ন লাইটস বা অরোরা বোরিয়ালিস—সূর্য থেকে নির্গত একটি জিওম্যাগনেটিক বা ভূচৌম্বকীয় ঝড়। এর প্রভাবে পৃথিবীর কিছু অঞ্চল থেকে আকাশে চমৎকার সবুজ আভা দেখা যায়)। আর বসন্তে আসে আলো ও পাখি। এখানে প্রতিটি ঋতুই বিশেষ কিছু। থাকে আশ্চর্য নিসর্গদৃশ্য।’

হাল্লা একটি ট্যুর কোম্পানি পরিচালনা করেন। এ ছাড়া এই দ্বীপে একটি ৯ কক্ষের গেস্টহাউসের মালিক তিনি। গ্রিমসে শহর থেকে এতটাই দূরে যে এটি জাতীয় পাওয়ার গ্রিডের বাইরে। এ কারণে পুরো দ্বীপে একটি একক ডিজেলচালিত জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। আর এই পাওয়ার স্টেশনের দেখভালও করেন হাল্লা।

অল্পসংখ্যক মানুষের এই দ্বীপে থাকতে বিরক্ত লাগে না? এমন প্রশ্নের জবাবে হাল্লা বলেন, ‘আমার এখানে অনেক কিছু করার আছে। আমরা মূল ভূখণ্ডে বসবাসকারীদের মতো একই কাজ করি। আমরা কাজ করি, জিমে যাই, ব্যায়াম করি। প্রকৃতিই আমাদের এখানে দেখে রাখে।’

গ্রিমসে দ্বীপে কোনো হাসপাতাল, চিকিৎসক বা পুলিশ স্টেশন নেই। জরুরি পরিস্থিতিতে কোস্টগার্ড ও জরুরি পরিষেবাগুলো দ্বীপবাসীদের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছে। হাল্লা বলেন, ‘আপনি যখন এখানে বাস করেন, আপনাকে অবশ্যই নমনীয় হতে শিখতে হবে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। আমরা এখানে যেকোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত। এখানে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রথম প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতি তিন সপ্তাহে একবার উড়োজাহাজে করে একজন চিকিৎসক এই দ্বীপে আসেন।’

দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি বাড়ি আছে। স্যান্ডভিক নামে পরিচিত এই বসতিতে একটি স্কুলও আছে। স্কুলটি একটি কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আছে একটি হস্তশিল্পের গ্যালারি ও একটি ক্যাফে। এই ক্যাফেতে ঘরে তৈরি আইসল্যান্ডিক জিনিসপত্র ও পোশাক বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া দ্বীপে মাত্র একটি ছোট্ট মুদিদোকান আছে। বাজার করার জন্য প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টা খোলা থাকে এই মুদিদোকান। একটি বারসহ একটি রেস্তোরাঁ, একটি সুইমিংপুল, লাইব্রেরি, গির্জা ও একটি উড়োজাহাজ অবতরণ ও উড্ডয়নের জন্য ছোট্ট একটি এয়ারস্ট্রিপ, পাখিদের বসার জন্য বিশাল জায়গা আছে দ্বীপটিতে।

আইসল্যান্ডের অনেক ছোট শহর এবং গ্রামের মতোই গ্রিমসেরও একটি ইতিহাস আছে। এই দ্বীপের নাম গ্রিমুর নামের একজন বসতি স্থাপনকারীর নামের সঙ্গে মিল রেখে রাখা হয়েছে। গ্রিমুর, যিনি পশ্চিম নরওয়ের সোগন জেলা থেকে প্রথমে এই দ্বীপে যাত্রা করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন আইসল্যান্ডিক ইতিহাস হিমসক্রিংলাতে গ্রিমসে দ্বীপের পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ১০২৪ সালে তৎকালীন নরওয়ের রাজা ওলাফুর গ্রিমসেকে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে নেওয়ার দাবি করেছিলেন। কিন্তু মাছ ও পাখির প্রাচুর্যের কারণে স্থানীয় নেতারা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৮ শতকের শেষের দিকে নিউমোনিয়া ও মাছ ধরা-সংক্রান্ত এক দুর্ঘটনার কারণে গ্রিমসের জনসংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল।

২০০৯ সালে গ্রিমসি আকুরেরি পৌরসভার অংশ করে নেওয়া হয়। গ্রিমসের পর্যটন প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মারিয়া এইচ ট্রিগভাডোত্তির বলেন, বর্তমানে বাসিন্দাদের কাছে গ্রিমসের জমির মালিকানা আছে। তাঁরাই মূলত এ দ্বীপটি সংরক্ষণের কাজ করে যাচ্ছেন। এ যেন পাখির রাজ্যে মানুষ প্রজার মতো।

ট্রিগভাডোত্তির গ্রিমসে সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই দ্বীপের যা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে, তা হলো এর দূরত্ব, অনন্য আলো এবং অবিশ্বাস্য পাখিপ্রাণ। এই ঘাসযুক্ত দ্বীপের খাড়া পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো, হাজার হাজার সামুদ্রিক পাখি ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের গভীর প্রশান্তি অনুভব করার মধ্যে সত্যিই ব্যতিক্রম কিছু আছে। এখানকার মানুষেরা অনেক আন্তরিক।’

তথ্যসূত্র: বিবিসি ও আইসল্যান্ড রিভিউ

আরও পড়ুন