বর্ষবরণ উৎসব হয় প্রায় সারা পৃথিবী জুড়েই। বিভিন্ন দেশ ও জাতির মানুষ তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জীবনযাপন, ইতিহাস, ঐতিহ্য অনুযায়ী পালন করে এই উৎসব। আবার সকল দেশে এই উৎসবের দিন ক্ষণও এক নয়। তবে বিশ্বব্যাপী সুন্দর দিনের আশায় মানুষ ভেদাভেদ ভুলে নানান আয়োজনে পালন করে বর্ষবরণ।
আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনটি তাই হয়ে ওঠে বর্ণিল। যুগযুগ ধরে আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা হাতি, ঘোড়া, গরু, বাঘ, পেঁচা, ধান, নৌকা নানান কিছুর প্রতীক নিয়ে হয় আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রকৃতিকে রক্ষা করার মাঝে নিহিত রয়েছে মানব জাতির মঙ্গল— এ যেন তারই এক বার্তা, আগামী দিনের মঙ্গল কামনায়।
পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই পহেলা জানুয়ারিতে পালিত হয় বর্ষবরণ উৎসব। ৩১ ডিসেম্বর মধ্য রাত থেকে শুরু হয়ে অনুষ্ঠান গড়ায় পরদিন পর্যন্ত বা তারও বেশি। আতশবাজি, নাচ-গান, খাবার-দাবার, আলোকসজ্জা প্রভৃতির মাধ্যমে বর্ষবরণ হয়ে ওঠে সকল মানুষের মিলনমেলা। আবার আমাদের মত যাদের নিজেদের রয়েছে বর্ষ গণনার নিজেস্ব নিয়ম, তারা সে অনুযায়ী বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। তবে দিন যা-ই হোক না কেন, প্রতিটি দেশ ও জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য ফুটে উঠে তাদের বর্ষবরণে।
চীনে বর্ষবরণ উৎসব আবার প্রতি বছর একই দিনে হয় না। সাধারণত একুশে জানুয়ারি থেকে বিশ ফেব্রুয়ারির মধ্যকার একটি দিনে শুরু হয় তাদের ‘চন্দ্রবর্ষ’। মোট বারটি প্রাণী থেকে প্রতি বছর একটি প্রাণীকে কেন্দ্র করে সাজানো হয় উৎসব।মানুষ সাজায় তাদের বাড়ি-ঘর, পরে নতুন পোশাক। নানান ধরন ও আকৃতির পাপেট ড্রাগনে ছেয়ে যায় শহর থেকে গ্রাম। হয় ড্রাগন নৃত্য। ১৯৯০ সাল থেকে চীনের মানুষ সপ্তাহব্যাপী ছুটি উপভোগ করে এই উৎসব পালনের জন্য।
এশিয়ার উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ সকল দেশেই বর্ষ বরণে দেখা মেলে সবার নিজস্ব ঐতিহ্যের। সিঙ্গাপুরে নানা রকম বাঁশি, বাদ্যযন্ত্র আর রঙ-বেরঙের পোশাক পরে হয় শোভাযাত্রা।
ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন করার মাধ্যমে শুরু হয় ইরানের নওরোজ বা বর্ষবরণ উৎসব। সাতটি নির্দিষ্ট উপাদানকে কেন্দ্র করে হয় তাদের বর্ষবরণ, যেগুলোকে তাদের রক্ষাকারী পবিত্র উপাদান মনে করা হয়। সূর্য হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনটি তারা উৎযাপন করে নতুন পোশাক পরা, আগুনের উপর দিয়ে ঝাঁপ দেওয়া, আতশবাজিসহ নানান আয়োজনে।
ইন্দোনেশিয়ায় হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনটি পালন করা হয় রোজা রাখা, প্রার্থণাসহ বিবিধ আয়োজনে। এ দিনে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশেষ কুচকাওয়াজ, সেখানে থাকে অ্যালবিনো মহিষের পাল। এদের স্পর্শ করার মাধ্যমে মানুষ আশা করে নতুন বছরে পবিত্র কিছু পাওয়ার।
যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয় ৩০ ডিসেম্বর থেকে। হাজারো মানুষ আগুনের মশাল নিয়ে পার্লামেন্ট স্কয়ার থেকে ক্যাল্টন হিল পর্যন্ত তৈরি করে ‘রিভার অব ফায়ার’ বা আগুনের নদী। নিজেদের ঐতিহ্যের নাচ-গানতো হয়ই, সঙ্গে থাকে হিমশীতল জলে সাঁতার কাটার দুঃসাহসিক আয়োজন।
বছরের শুরুর দিনটিতে যদি ভাঙা কাঁচের প্লেট পাওয়া যায় দরজার সামনে, তবে তা শুভ সূচনা বলে ধরে নেয়া হয় ডেনমার্কে। তাই ড্যানিশরা প্লেট ভেঙে রাখে প্রতিবেশীর দরজায়। এমন করে পৃথিবীর নানান প্রান্তে নানান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের সংস্কৃতি অনুযায়ী পালিত হয় নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষ পালনও বাঙালীর ঐতিহ্যের অংশ। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’— সকল অন্ধকার দূর করার এক দৃঢ় প্রত্যয়। যেখানে যেটুকু অন্ধকার আছে তা দূর হয়ে যাবে, নতুন বছর নিয়ে আসবে আলোর মিছিল, ১৪৩১ বর্ষটি হয়ে উঠবে আরো সুন্দর, আরো আলোকময়— এটাই সবার প্রত্যাশা।