মালয়েশিয়ার উধাও হওয়া উড়োজাহাজ ফ্লাইট ৩৭০-এর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। ২৩৯ যাত্রী, ক্রু–সহ নিখোঁজ হওয়ার নানা তত্ত্ব নিয়ে কিশোর আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। জানো কি, ওই বিমানের এত মানুষ নিয়ে নিখোঁজ হওয়ার ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে। তবু উড়োজাহাজটির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এর কোনো রহস্যও উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। আর যাত্রী ও ক্রুদের ভাগ্যেই-বা কী ঘটেছে, তা-ও থেকে গেছে অজানা। এ কারণে আধুনিক এই সময়ে উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার মধ্যে এটিকে সবচেয়ে বড় রহস্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
২০১৪ সালের ৮ মার্চ। রাত ১২টা ৪১ মিনিট। মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৩৭০-এ ১২ জন ক্রুসহ চেপে বসেন ২৩৯ জন যাত্রী। গন্তব্য কুয়ালালামপুর থেকে চীন। রানওয়ে পেরিয়ে আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছে বোয়িং ৭৭৭-২০০ইআর উড়োজাহাজটি। সকালের অপেক্ষায় সবাই ঠিকঠাকমতো সিটবেল্ট বেঁধে নেন। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় বেইজিংয়ে অবতরণ করলেই এই ওড়ার যাত্রায় যাত্রীদের ছুটি।
রাত ১টা ১৯ মিনিট। বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ থেকে ‘সবকিছু ঠিক আছে’ বোঝাতে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারে পাঠানো নিয়মিত বার্তায় বলা হয়, ‘শুভরাত্রি মালয়েশিয়ান থ্রি সেভেন জিরো’। এরপরই এয়ারক্রাফ্ট কমিউনিকেশনস অ্যাড্রেসিং অ্যান্ড রিপোর্টিং সিস্টেম বা এসিএআরএস বন্ধ হয়ে যায়। ভিয়েতনামের দক্ষিণে জলসীমায় যাওয়ার পর রহস্যজনকভাবে বোয়িং ৭৭৭-২০০ইআর উড়োজাহাজটি নিখোঁজ হয়। আন্তর্জাতিকভাবে অনুসন্ধান চালিয়েও বিমানটির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। বিমানটি সর্বশেষ দক্ষিণ ভিয়েতনামের কামাও প্রদেশের আকাশসীমা থেকে হো চি মিন সিটির বিমান নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর আর কোনো সাড়া মেলেনি।
‘শুভরাত্রি মালয়েশিয়ান থ্রি সেভেন জিরো’ বার্তাটি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারে কে পাঠিয়েছিলেন, তা নিয়ে শুরুতে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। বিমানের ক্যাপ্টেন, তাঁর প্রথম সহকারী, নাকি ককপিটে তাঁদের সঙ্গে থাকা অন্য কেউ কথাগুলো বলেছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। মালয়েশীয় কর্মকর্তারা আগে বলেছিলেন, শেষ কথাটি কার, তা তাঁরা জানেন না। পরে তাঁরা বলেছেন, তাঁদের ধারণা, এটি সহপাইলট ফারিক আবদুল হামিদের। কিন্তু এত দিন পর জানা গেল যে ওই বার্তা পাঠিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন জাহারি আহমদ শাহ। মালয়েশিয়ার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে বিদায় জানানোর সময় ক্যাপ্টেন ওই বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এর পরই দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট উড়োজাহাজটি কুয়ালালামপুর ছেড়ে যাওয়ার প্রায় ৪০ মিনিট পর ৮ মার্চ ভোরে ভিয়েতনামের আকাশসীমায় চলে যায়। তারপর এটির আর কোনো খোঁজ মেলেনি। সে সময় সূত্র জানিয়েছিল, উড়োজাহাজটি রাডার ফাঁকি দিয়ে তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকা আফগান সীমান্তের দিকে গিয়ে থাকতে পারে।
উড়োজাহাজটি নিখোঁজ হওয়ার ১০ দিন পর জানানো হয়, যাত্রীবাহী বিমানটি নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হওয়ার পর অন্তত আট ঘণ্টা আকাশে উড়েছিল। দীর্ঘ এই সময়ে বাণিজ্যিক রাডারগুলো ফাঁকি দিতে অস্বাভাবিক নিচ দিয়ে উড়ছিল এটি।
শুরুতে দক্ষিণ চীন সাগরে উড়োজাহাজটির অনুসন্ধান চালানো হয়। এখানে ব্যর্থ হয়ে পরে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের একটি দুর্গম অংশে উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। সে সময় স্যাটেলাইট পরামর্শ দিয়েছিল যে জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় উড়োজাহাজটি এই অঞ্চলে নিচে নেমে আসতে পারে। ভারত মহাসাগরের দ্বীপ ও পূর্ব আফ্রিকার সমুদ্রসৈকতে উড়োজাহাজটির ডানার একটি অংশ পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছিল। তবে ওই ডানার অংশ নিখোঁজ উড়োজাহাজের কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কোটি কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করে সাগরে তল্লাশি চালানো হলেও উড়োজাহাজটির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
কারা ছিলেন উড়োজাহাজে
মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, উড়োজাহাজটিতে ১৫টি দেশের নাগরিকেরা ছিলেন। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি চীনের নাগরিক—১৫৩ জন।
উড়োজাহাজটিতে চীনা শিল্পীদের একটি দল ছিল। কুয়ালালামপুরে তাঁদের ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী চলছিল। ইরানের দুজন নাগরিক ভুয়া ইউরোপীয় পাসপোর্টে ভ্রমণ করছিলেন, একজন ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক নতুন চাকরিতে যোগ দিতে বেইজিংয়ে যাচ্ছিলেন, এক মালয়েশিয়ান দম্পতি যাচ্ছিলেন মধুচন্দ্রিমায়। এ ছাড়া সন্তানদের নিয়ে একটি পরিবারও ছিল ওই উড়োজাহাজে।
ককপিটে ছিলেন ক্যাপ্টেন জাহারি আহমদ শাহ। ৫৩ বছর বয়সী জাহারির তিন সন্তান। ১৯৮১ সালে তিনি মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসে যোগ দেন। দেশটির শীর্ষ পাইলটদের একজন ছিলেন জাহারি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহপাইলট ফারিক হামিদ আহমদ। ২৭ বছর বয়সী ফারিক সবে ৭৭৭ চালানোর যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন।
কেবিনে মালয়েশিয়ান ক্রুদের নেতৃত্বে ছিলেন সুপারভাইজার প্যাট্রিক গোমেজ। তিনি ৩৫ বছর ধরে এয়ারলাইনসে কাজ করছিলেন।
নিখোঁজ হওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তারা উড়োজাহাজটির কার্গোও পরীক্ষা করে দেখেছেন। হোল্ডে লিথিয়াম ব্যাটারি, ওয়াকিটকিসহ ইলেকট্রনিকস সরঞ্জামের চালান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ম্যাঙ্গোস্টিনের একটি বড় চালানও ছিল। ম্যাঙ্গোস্টিন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মিষ্টি ফল।
নিখোঁজ হওয়ার সময় যা ঘটেছিল
উড়োজাহাজটি নিখোঁজ হওয়ার খবর চাউর হলে হতবাক হয়ে যান মালয়েশিয়ানরা। হৃদয়বিদারক এই ঘটনার বিষয়ে কারও কোনো ধারণা ছিল না। যাত্রীদের স্বজনেরা খবর জানার অপেক্ষায় মরিয়া হয়ে বেইজিংয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু কেউ কোনো জবাব দিতে পারেননি। এ কারণে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের কর্মকর্তা, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও মালয়েশিয়ান সরকার নজিরবিহীনভাবে আন্তর্জাতিক তদন্তের আওতায় আসে।
এরপর স্পষ্ট হয় যে উড়োজাহাজটি কখনোই ভিয়েতনামের আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি। জাহারির বার্তা পাঠানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু অন্ধকারে চলে যায়। উড়োজাহাজের ট্রান্সপন্ডারগুলো বন্ধ করা হয়েছিল। ট্র্যাকিং সিস্টেমও সচল ছিল না।
সামরিক রাডারে দেখা গেছে, উড়োজাহাজটির উত্তর মালয়েশিয়া ও পেনাং দ্বীপের ওপর দিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে উড়োজাহাজটি আন্দামান সাগরে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের সামনের দিকে চলে যায়। ৮ মার্চ স্থানীয় সময় রাত ২টা ২২ মিনিট পর্যন্ত তা দেখা গিয়েছিল। এরপর সেখান থেকে উড়োজাহাজটি দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে চলে যায়।
উদ্ধারে যা করা হয়েছিল
উড়োজাহাজটি নিখোঁজ হওয়ার পরপরই মালয়েশিয়া দুই ডজনের বেশি দেশের সমন্বয়ে একটি অনুসন্ধান দল গঠন করে।
প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ চীন সাগর ও আন্দামান সাগরে তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু ১২ মার্চ সামরিক রাডারের ফলাফল দেখে এখানে তল্লাশি বন্ধ করে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে তল্লাশি শুরু হয়। ১৮ মার্চ দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের ৪৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে তল্লাশি কার্যক্রম শুরু হয়। অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে বহুজাতিক এই তল্লাশি কার্যক্রমে উড়োজাহাজটির কোনো হদিস না পাওয়ায় ছয় সপ্তাহ পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এরপর অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রতলের দিকে মনোযোগ দেয় অনুসন্ধানকারী দল। এখানে ১ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়। এই তল্লাশি কার্যক্রমে জাহাজ, সাবমেরিন ও উড়োজাহাজ অংশ নেয়। এতে প্রায় ১৪ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়। কিন্তু এতে কোনো ফল আসেনি।
এরপর মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওশান ইনফিনিটি উড়োজাহাজটি উদ্ধারে চ্যালেঞ্জ নেয়। ‘উদ্ধার না হলে কোনো ফি নেই’ শর্তে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ১ লাখ ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় তল্লাশি চালায় তারা। শেষ পর্যন্ত উড়োজাহাজটির কোনো ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে তারাও ব্যর্থ হয়।
উড়োজাহাজটির ভাগ্যে কী ঘটতে পারে
উড়োজাহাজটি নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া সরকার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় সম্ভবত ‘ফাউল প্লে’ জড়িত ছিল। অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে কেউ। তবে ট্রান্সপন্ডারগুলো কে বন্ধ করে উড়োজাহাজটিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন, তা বলা সম্ভব নয়।
এমএইচ ৩৭০ নিরাপত্তা তদন্ত দলের প্রধান কোক সো চোন বলেন, যদি ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, তাহলেই কেবল সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে।
এরপর এ ঘটনায় জাহারিকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ান ট্রান্সপোর্ট সেফটি ব্যুরো (এটিএসবি) ৪৪০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, এমএইচ ৩৭০ নিখোঁজ হওয়ার ছয় সপ্তাহ আগে পাইলট তাঁর হোম ফ্লাইট সিমুলেটর উড্ডয়ন করেছিলেন। অভ্যন্তরীণ একটি ফ্লাইট একই গতিতে একইভাবে চালিয়েছিলেন জাহারি, যা আসলে ৮ মার্চ উড্ডয়নের সঙ্গে ‘প্রাথমিকভাবে একই’ ছিল।
কোক বলেন, তদন্তকারীরা পাইলট ও প্রথম অফিসারের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করেছেন। তদন্তকারীরা তাঁদের পটভূমি, প্রশিক্ষণ ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘পাইলটরা এটি ঘটিয়েছেন, তা আমরা মনে করি না। তবে তদন্তকারীরা কোনো সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কারণ, উড়োজাহাজটি পথ ঘোরানোর কাজটি ম্যানুয়ালি করা হয়েছিল এবং সিস্টেমগুলোও ম্যানুয়ালি বন্ধ করা হয়েছিল।’
কোক আরও বলেন, ‘তৃতীয় কোনো পক্ষ বেআইনিভাবে এমনটা ঘটাতে পারে, এমন ভাবনা আমরা বাদ দিচ্ছি না।’ তবে সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে এ ঘটনা নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে চলে এসেছে।
উড়োজাহাজ হারানোর রহস্য
১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর ফ্লোরিডা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল পাঁচটি প্রশিক্ষণ বিমান। উড্ডয়নের দেড় ঘণ্টা পরে পাইলটরা জানান যে তাঁরা বিভ্রান্তি বোধ করছেন এবং নিচের কিছুই চিনতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত বিমানগুলো সাগরে বিধ্বস্ত হয়। ফ্লাইট ১৯ নামে পরিচিত এ ঘটনায় পাঁচটি প্রশিক্ষণ বিমান হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’ কাহিনির জন্ম দেয়, যে রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি।
আরেকটি রহস্যময় ঘটনার নায়ক মার্কিন কৃতী নারী বৈমানিক অ্যামিলিয়া ইয়ারহার্ট। বিশ্ব প্রদক্ষিণ করতে বেরিয়ে ১৯৩৭ সালের ২ জুলাই মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরে হারিয়ে যান ইয়ারহার্ট। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়। বেশির ভাগ গবেষকই মনে করেন, জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় তাঁর বিমান সাগরে বিধ্বস্ত হয়। তবে মার্কিন গুপ্তচর সন্দেহে জাপানিদের হাতে আটক হওয়া থেকে শুরু করে ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের হাতে বন্দী হওয়ার মতো বহু চমকপ্রদ গল্প চালু আছে ইয়ারহার্টকে নিয়ে।
এ রকম মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৩৭০-এর পরিণতি নিয়েও কয়েকটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে। সেগুলো হলো—
চালকের আত্মহত্যা তত্ত্ব
একটি তত্ত্ব রয়েছে যে একজন চালক অন্য চালককে নিষ্ক্রিয় করে উড়োজাহাজটি ভূপাতিত করে সব যাত্রী নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের প্রধান নির্বাহী আহমাদ জাহারি এ ধারণা নাকচ করে দিয়েছেন।
ককপিটে অতিথি তত্ত্ব
বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ চালানোর অভিজ্ঞতা থাকা আমেরিকান এয়ারলাইনসের সাবেক পাইলট মার্ক উইসের ধারণা, বিমানটি বিপন্ন হওয়ার পরপর ভেতরে একটি ধস্তাধস্তি বা সংঘাত হয়েছিল। ওই ফ্লাইটের সহযোগী চালক আবদুল হামিদ ২০১১ সালে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া পথে একবার ককপিটে এক নারী ও তাঁর বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানান। উইসের মতে, এ ধরনের ঘটনা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বাড়িয়ে দেয়। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলেছেন, এমএইচ ৩৭০-এর ককপিটে কোনো তৃতীয় পক্ষ থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
ছিনতাই তত্ত্ব
গোপন কোনো উদ্দেশ্যে উড়োজাহাজটি ছিনতাই হয়েছে বলেও একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তবে এ ধারণা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কেননা ঘটনার পর কোনো দল বা সন্ত্রাসী সংগঠন দায় স্বীকার করেনি।
কাজাখস্তান তত্ত্ব
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, রুশ কোনো ব্যক্তি চীন, পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্তঘেঁষা কাজাখস্তানের এক ক্ষুদ্র বিমানবন্দরে নিয়ে গেছেন উড়োজাহাজটিকে। ওই বন্দর রাশিয়ার কাছে লিজ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানবিষয়ক সাংবাদিক ও বিমানচালক জেফ ওয়াইজ এই তত্ত্ব দিয়েছেন।
যান্ত্রিক গোলযোগ তত্ত্ব
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, উড়োজাহাজটি যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে। বৈদ্যুতিক কোনো কারণে বা বড় ধরনের আগুন লাগার কারণে চালক যোগাযোগ করতে পারেননি। আমেরিকান এয়ারলাইনসের সাবেক চালক জিম টিলমন বলেন, একসঙ্গে পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা কারণ হতে পারে। তবে এটার সম্ভাবনা খুব কম। কেননা উড়োজাহাজের বিভিন্ন স্থানে থাকা জেনারেটর থেকে বিদ্যুতের সরবরাহ হয়ে থাকে। একটিতে ত্রুটি হলে অন্যটি থেকে বিদ্যুতের সরবরাহ হয়।
উড়োজাহাজটির হদিস আদৌ কি মিলবে
বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজটি প্রায় ২১০ ফুট দীর্ঘ, ২০০ ফুট ডানা ও ৬১ ফুট উঁচু লেজ নিয়ে কীভাবে নিখোঁজ হতে পারে, তা এখনো কেউ বুঝতে পারছেন না।
তবে ভারত মহাসাগর হলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। এর গভীরতাও অবিশ্বাস্য রকম। যেসব জায়গায় অনুসন্ধান করা হয়েছে, সেখানে প্রায় চার হাজার মিটার গভীরতা ছিল।
ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার কোস্টাল ওশানোগ্রাফির অধ্যাপক চারিথা পাট্টিয়ারাতচিসহ গবেষকদের একটি দল পানির প্রবাহ বিশ্লেষণ করে পরামর্শ দিয়েছিলেন, উড়োজাহাজটির ধ্বংসাবশেষ পূর্ব আফ্রিকান দেশগুলোর উপকূলের দিকে প্রবাহিত হয়ে যাবে।
অধ্যাপক চারিথা পাট্টিয়ারাতচির বিশ্বাস, গত ১০ বছরে প্রযুক্তির অনেক অগ্রগতি হয়েছে। একই সঙ্গে সমুদ্রের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তাই শেষমেশ উড়োজাহাজটির খোঁজ পাওয়ার ‘উচ্চ সম্ভাবনা’ দেখা যাচ্ছে।
চলতি মাসে এক নিউজলেটারে চারিথা পাট্টিয়ারাতচি বলেছেন, যে এলাকায় অনুসন্ধান চালানো হবে, সেখানে সমুদ্রের গভীরতা প্রায় চার হাজার মিটার। পানির তাপমাত্রাও হালকা স্রোতসহ এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর অর্থ হলো ১০ বছর পরও ধ্বংসাবশেষক্ষেত্র তুলনামূলকভাবে অক্ষত থাকবে।
সমুদ্রের তলদেশে এত বছর পর উড়োজাহাজের ব্ল্যাক বক্স পাওয়া গেলেও তা বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে কি না, তা ঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে উড়োজাহাজটির কোনো হদিস পাওয়া গেলে বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কিছু স্বস্তি হয়তো পাবে। সেটাই বা কম কিসে!
এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি অনলাইন, আল–জাজিরা ও টেলিগ্রাফ অবলম্বনে