পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিকে যেভাবে সাহায্য করছে এআই
এআই এখন প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত করছে। যেমন এখন এআই মস্তিষ্কের সিগন্যালের পরিবর্তন বুঝতে পারে। এআইয়ের সাহায্যে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তি মস্তিষ্কের নির্দেশনা দিয়ে একটি কৃত্রিম হাত নড়াচড়া করতে সফল হয়েছে। মস্তিষ্ক কী বলতে চাইছে, সে নির্দেশনা গ্রহণ করে এআই এমনভাবে কাজ করেছে, যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী হাত নড়াচড়া করা যায়।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকোর গবেষকেরা এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য এমন একটি রোবোটিক বাহু তৈরি করেছেন, যেটি এআই ব্যবহার করে কৃত্রিম হাত নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছেন ওই ব্যক্তি। রোবোটিক হাতটি মস্তিষ্ক থেকে সংকেত গ্রহণ করে কম্পিউটারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তিনি কল্পনায় বস্তুকে ধরা, সরানো ও ফেলে দেওয়ার চিন্তা করেই হাতটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন।
এই যন্ত্র ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) নামে পরিচিত। সাত মাস ধরে যন্ত্রটি কোনো পরিবর্তন করা ছাড়াই কাজ করেছে। এত লম্বা সময় কাজ করা রোবোটিক বাহুর রেকর্ড এটি। আগে এ ধরনের ডিভাইস সাধারণত এক বা দুই দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকত।
গবেষণাকালে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী একজন বারবার নির্দিষ্ট নড়াচড়ার কল্পনা করেছিলেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মস্তিষ্কের এই পরিবর্তনের সঙ্গে মেলাতে প্রোগ্রাম করা হয়েছে
বিসিআই একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই মডেলের ওপর নির্ভর করে। যেটি মস্তিষ্কে ছোট পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। যখন কেউ বারবার কোনো নড়াচড়ার চিন্তা করেন, এই কল্পিত নড়াচড়া থেকে এআই আরও নিখুঁতভাবে নির্দেশনা মেনে নড়াচড়া করতে শেখে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকোর ওয়েইল ইনস্টিটিউট ফর নিউরোসায়েন্সের সদস্য এবং স্নায়ুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নিউরোলজিস্ট ড. করুনেশ গাঙ্গুলি এই গবেষণা করছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে এই শেখার সমন্বয়ই ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের পরবর্তী ধাপ। বাস্তবে কাজ করে এমন সাফল্য পেতে এই প্রযুক্তি প্রয়োজন।’
এই গবেষণা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ অর্থায়ন করেছে। গবেষণাটি ৬ মার্চ সেল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণার মূল বিষয় ছিল মস্তিষ্কের কার্যকলাপ প্রতিদিন কীভাবে পরিবর্তিত হয়, তা বের করা। এই গবেষণাকালে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী একজন বারবার নির্দিষ্ট নড়াচড়ার কল্পনা করেছিলেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মস্তিষ্কের এই পরিবর্তনের সঙ্গে মেলাতে প্রোগ্রাম করা হয়েছে। ফলে এটি কয়েক মাস ধরে কার্যকর থাকতে পেরেছে।
তাঁর মস্তিষ্কের পৃষ্ঠে ছোট ছোট সেন্সর লাগানো হয়েছিল, যা তাঁর কল্পনায় নড়াচড়া করার সময় মস্তিষ্কের কার্যকলাপ শনাক্ত করতে পারে। গবেষকেরা দেখতে চাইলেন, সময়ের সঙ্গে তাঁর মস্তিষ্কের সংকেত কীভাবে পরিবর্তিত হয়।
করুনেশ গাঙ্গুলি প্রাণীদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপের ধরন নিয়ে গবেষণা করেন, যা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট নড়াচড়ার চিন্তাকে বাস্তবে কার্যকর করে। তিনি দেখেছেন, প্রাণীদের শেখার সময় প্রতিদিন চিন্তার ধরন পরিবর্তন হয়। তিনি মনে করেন, মানুষের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। এই পরিবর্তনের কারণেই ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস দ্রুত মস্তিষ্কের সংকেত চিনতে অক্ষম হয়ে পড়ে। তাই এআই–চালিত রোবোটিক বাহুগুলো বেশি দিন কার্যকর থাকে না।
গাঙ্গুলি এবং স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষক ড. নিখিলেশ নটরাজ এমন একজন গবেষণা অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে কাজ করেছেন, যিনি কয়েক বছর আগে স্ট্রোকের ফলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছিলেন। তিনি কথা বলতে বা নড়াচড়া করতে পারেন না।
তাঁর মস্তিষ্কের পৃষ্ঠে ছোট ছোট সেন্সর লাগানো হয়েছিল, যা তাঁর কল্পনায় নড়াচড়া করার সময় মস্তিষ্কের কার্যকলাপ শনাক্ত করতে পারে। গবেষকেরা দেখতে চাইলেন, সময়ের সঙ্গে তাঁর মস্তিষ্কের সংকেত কীভাবে পরিবর্তিত হয়। তাই তিনি অংশগ্রহণকারীকে কল্পনায় শরীরের বিভিন্ন অংশ, যেমন হাত, পা বা মাথা নড়ানোর কথা ভাবতে বলেন।
যদিও তিনি বাস্তবে নড়তে পারতেন না, তবু তাঁর মস্তিষ্ক কল্পিত নড়াচড়ার সংকেত তৈরি করতে পারত। ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস এই মস্তিষ্কের সংকেতগুলো সেন্সরের মাধ্যমে রেকর্ড করেছিল। গবেষক দল দেখতে পান, মস্তিষ্কের এই সংকেতগুলোর আকৃতি একই থাকে। তবে সংকেতের অবস্থান প্রতিদিন সামান্য পরিবর্তন হয়।
এরপর গবেষকেরা অংশগ্রহণকারীকে দুই সপ্তাহ ধরে কল্পনায় তাঁর আঙুল, হাত বা বৃদ্ধাঙ্গুলির সহজ নড়াচড়া করার কথা ভাবতে বলেন। তখন সেন্সরগুলো তাঁর মস্তিষ্কের কার্যকলাপ রেকর্ড করে এবং এআই শেখে। এরপর অংশগ্রহণকারী রোবোটিক বাহু ও হাত নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তখনো নড়াচড়াগুলো খুব সুনির্দিষ্ট ছিল না।
কয়েক মাস পরে মাত্র ১৫ মিনিটের অনুশীলন করে অংশগ্রহণকারী রোবোটিক বাহু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন। এই অনুশীলনটি তাঁর মস্তিষ্কের নড়াচড়ার সংকেতগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে।
তাই গাঙ্গুলি তাঁকে ভার্চ্যুয়াল একটি রোবোটিক বাহুর সঙ্গে অনুশীলন করান, যা তাঁর কল্পিত নড়াচড়ার সঠিক প্রতিক্রিয়া দিত। ধীরে ধীরে তিনি ভার্চ্যুয়াল বাহুকে নিজের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন।
যখন তিনি আসল রোবোটিক বাহুর সঙ্গে অনুশীলন শুরু করলেন, তখন মাত্র কয়েকটি সেশনেই তিনি তাঁর দক্ষতা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারলেন। তিনি রোবোটিক বাহুর সাহায্যে ছোট ব্লক তুলতে, ঘোরাতে এবং নতুন জায়গায় সরিয়ে নিতে সক্ষম হন। এমনকি তিনি একটি ক্যাবিনেট খুলে, ভেতর থেকে একটি কাপ বের করে ওয়াটার ডিসপেন্সারের (খাওয়ার পানির ট্যাপ) সামনে ধরতেও সক্ষম হন।
কয়েক মাস পরে মাত্র ১৫ মিনিটের অনুশীলন করে অংশগ্রহণকারী রোবোটিক বাহু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন। এই অনুশীলনটি তাঁর মস্তিষ্কের নড়াচড়ার সংকেতগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে। যে সংকেত সময়ের সঙ্গে সামান্য পরিবর্তিত হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য করার কাজে ব্যবহার করা হয়।
গবেষকেরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলগুলোর উন্নয়ন করছেন। যেন রোবোটিক বাহু আরও দ্রুত এবং মসৃণভাবে নড়াচড়া করতে পারে। তাঁরা এই ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস পারিবারিক পরিবেশে পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করছেন।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য নিজে নিজে খাওয়া বা এক গ্লাস পানি নেওয়ার ক্ষমতা হয়তো তাঁদের জীবন বদলে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে করুনেশ গাঙ্গুলি বলেছেন, ‘আমি খুব আত্মবিশ্বাসী যে আমরা এখন এই সিস্টেম তৈরি করতে শিখেছি এবং এটি ঠিকঠাক কাজ করবে।’
সূত্র: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকো ডট এডু