যে লবণের সমুদ্রে বাসা বানায় ফ্লেমিংগো
কল্পনা করো তো, তুমি হাঁটছ মাটিতে, তবে মনে হচ্ছে, তুমি আকাশের ওপরে ভাসছ! তোমার পায়ের নিচে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আয়না, যেখানে মেঘ, তারা আর সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। ভূমির ওপরে আর নিচে একই ছবি, আয়নার মতো প্রতিফলিত হচ্ছে। স্বপ্নের মতো এমন জায়গা বাস্তবেও আছে। এর নাম সালার দে ইউনি।
বলিভিয়ায় অবস্থিত আলতিপ্লানো মালভূমির একটি অংশ সালার দি ইউনি নামে পরিচিত। এটি এমন এক বিস্ময়কর লবণসমুদ্র, যেখানে মাটি আর আকাশের সীমানা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। শুষ্ক মৌসুমে এখানে দেখা যায় ধবধবে সাদা লবণের মরুভূমি। যত দূর চোখ যায়, চকচকে কাদামাটির মতো লবণের স্তর। কাজেই কেউ চাইলে দিব্যি হেঁটে বেড়াতে পারে এই লবণের সমুদ্রে!
আজ থেকে ৩০–৪০ বছর আগে বলিভিয়ার এ অঞ্চল ছিল এক বিশাল প্রাগৈতিহাসিক হ্রদ, যার নাম মিনচিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি শুকিয়ে যায়। রেখে যায় এক পুরু লবণের স্তর। বর্তমানে এটি ১০ হাজার ৫৮২ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক সাদা লবণের চাদর, যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সল্ট ফ্ল্যাট বলা হয়। সালার দে ইউনির নামকরণ করা হয়েছে স্প্যানিশ শব্দ ‘সালার’ থেকে। এর অর্থ লবণের সমতল। কথিত পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, আয়মারা সম্প্রদায়ের দেবী তনুপার নামানুসারে এ জায়গার নাম স্থানীয়দের কাছে সালার দে তনুপা।
ঋতুভেদে এই অদ্ভুত জায়গা দুই ধরনের রূপ ধারণ করে। শুষ্ক মৌসুমে (মে থেকে নভেম্বর) সালারের সমতল থাকে ধবধবে সাদা। লবণের এক বিশাল মরুভূমির মতো। স্থলভাগ শক্ত হয়ে ষড়্ভুজ আকৃতিতে ফেটে ফেটে একেকটি লবণের খণ্ডের সৃষ্টি হয়, যা দেখতে অনেকটা মৌমাছির চাকের মতো।
বর্ষাকালে (ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল) সালার দে ইউনি একটি জাদুকরি রূপ নেয়। পুরো সালারের ভূমিতে যখন বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে নামে আর আশপাশের হৃদের পানি এসে জড়ো হয়, তখন সেখানে পানির প্রায় ২০ ইঞ্চি পরিমাণ পাতলা স্তরের জলাশয় তৈরি হয়। এই স্তরই একটি নিখুঁত আয়নার মতো কাজ করে, যে আয়নার ওপর দাঁড়ালে মনে হয়, যেন পুরো আকাশ চারপাশে ছড়িয়ে গেছে। পুরো অঞ্চল তখন কাচের তৈরি বলে বিভ্রম হয়!
তবে এ জায়গা কেবল সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত নয়, গবেষণার জন্যও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর নিচে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাতু ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রাণশক্তি লিথিয়াম, যা দিয়ে মোবাইলের ব্যাটারি থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক গাড়ি—সবকিছু চলে। ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, পৃথিবীর ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ লিথিয়াম মজুদ রয়েছে এখানে। পরিমাণের হিসাবে ধরা হয় সারা বিশ্বে থাকা লিথিয়ামের অর্ধেকটা এখানে রয়েছে। এ ছাড়া এখানে রয়েছে বহু খনিজ পদার্থের খনি। আছে প্রায় ১১ কোটি টন লবণ। এই লবণ স্থানীয়দের অর্থ উপার্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
এই শুষ্ক লবণভূমিতেও প্রাণের অস্তিত্ব আছে! এখানে প্রতিবছর হাজার হাজার গোলাপি ফ্ল্যামিংগো এসে জড়ো হয়। এ জায়গায় ফ্লেমিংগো বাসা বানায়। এই কঠিন পরিবেশেও এরা বেঁচে থাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এভাবেই চলছে। এ ছাড়া এখানে প্রায় ৮০ প্রজাতির পাখি, হাজার বছরের পুরোনো প্রবালের জীবাশ্ম, কয়েক শত বছরের পুরোনো ক্যাকটাসগাছ আছে। এই ক্যাকটাস আকারে প্রায় ৩৩ ফুট লম্বা হয়। বহু বিচিত্র প্রজাতির প্রাণীও এখানে দেখতে পাওয়া যায়।
সালার দে ইউনির ট্যুর অপারেটরদের মতে, জুন থেকে আগস্ট সময়কে পর্যটন মৌসুম ধরা হয়। তবে বছরের কিছু সময় ও পরিস্থিতি বাদে সারা বছরই পর্যটকদের উপস্থিতি থাকে এখানে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে সালারের পথগুলো দুর্গম হয়ে ওঠে। তাই সে সময় কর্তৃপক্ষ পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ রাখে। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি না হলে সেখানে হেঁটে বেড়ানো সম্ভব। এ ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে চাইলেই নির্দিষ্ট গাড়ি ভাড়া করে চষে বেড়ানো যায় লবণের ভূমিতে।
সারা বিশ্ব থেকে আসা পর্যটকদের আতিথেয়তার জন্য রয়েছে বেশ কিছু হোটেল। এর মধ্যে অন্যতম হলো ২০০৭ সালে নির্মিত প্যালাসিও দে স্যাল অথবা লবণের প্রাসাদ। এর বিশেষত্ব হলো এই হোটেলের ছাদ, মেঝে, দেয়াল থেকে শুরু করে সব আসবাব লবণের খণ্ড দিয়ে তৈরি। দৃষ্টিনন্দন ও ব্যতিক্রমী এই ভবন নির্মাণে প্রচলিত নির্মাণসামগ্রীর বদলে ব্যবহৃত হয়েছে লবণের ১৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের প্রায় ১০ লাখ ইট!
এর বাইরেও সালারের আরও অনেক বিস্ময়কর মজার বিষয় রয়েছে। যেমন নাসার বিজ্ঞানীরা তাঁদের স্যাটেলাইটের ক্যালিব্রেশন বা মানচিত্র নির্ধারণের জন্য এই অঞ্চল ব্যবহার করেন। এ ধরনের সমতল অঞ্চল স্যাটেলাইটের সেন্সর ও পরিমাপের নির্ভুলতা যাচাই করতে সহায়তা করে। নাসার স্যাটেলাইট সিচুয়েশন সেন্টার ওয়েব স্যাটেলাইটের কক্ষপথ এবং এদের অবস্থান–সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করে, যা স্যাটেলাইট ম্যাপিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
‘স্টার ওয়ার্স: দ্য লাস্ট জেডাই’ চলচ্চিত্রে ক্রেইট নামের লাল লবণাক্ত সমতল ভূমির দৃশ্যগুলো বলিভিয়ার সালার দে ইউনিতে চিত্রায়িত হয়েছে। তাই এই লবণভূমি হতে পারে তোমার পরবর্তী ভ্রমণ গন্তব্য।