গ্রীষ্মে কেন গরম লাগে? প্রচণ্ড গরমকালে কুকুর কেন জিব বের করে রাখে? আম-কাঁঠাল কেন গরমেই পাকে? এসব প্রশ্ন কি তোমার মাথা গরম করে দিচ্ছে? তাহলে এই লেখাটা পড়ে ফেলো। উত্তর পেয়ে যাবে।
আমাদের যে গরম বা ঠান্ডা লাগে, এর উৎস হলো তাপ। তাই প্রথমে বুঝতে হবে তাপ কী। তোমার দুই হাতের তালু দ্রুতগতিতে কয়েকবার ঘষা দাও। হাত গরম হয়ে গেছে, তাই না? তার মানে তাপ উৎপন্ন হয়েছে। তুমি যখন এক হাতের তালুর সঙ্গে আরেক হাতের তালু ঘষেছ, হাতের চামড়ার সঙ্গে অন্য হাতের চামড়া ঘষা লেগেছে। তখন চামড়ার অণুগুলোর গতিশক্তি একটু বেড়ে গেছে। সেটাই তাপকে বাড়িয়ে দিয়েছে। কীভাবে বাড়াচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিচ্ছি।
তোমরা তো জানোই, সবকিছু তৈরি হয় অণু-পরমাণু দিয়ে। খুব ক্ষুদ্র এই অণু-পরমাণুগুলো কিন্তু স্থির থাকে না। জায়গায় দাঁড়িয়ে দুলতে থাকে। অনেকটা দোলনায় দোল খাওয়ার মতো। তোমার শরীরের প্রতিটি অণুই কিন্তু সব সময় দুলছে। তাহলে তুমি টের পাচ্ছ না কেন? কারণ, অণুগুলো এতই ছোট যে আমরা বুঝতে পারি না তার দুলুনি।
কোনো কিছু দুলতে হলে তো শক্তি লাগবে। যেমন একটা দোলনা কি একাই দুলতে শুরু করবে? কখনোই না, এর জন্য তোমাকে ধাক্কা দিতে হবে। অণুগুলোর দুলুনিও তেমনি ধাক্কা দিয়ে বাড়ানো যায়। আর ওই দুলুনির কারণে তার মধ্যে যে শক্তিটা জমা হয়, সেটাকেই আমরা বলি তাপ।
তুমি যখন ঘষা দিয়ে হাতের তালু কিছুটা গরম করেছ, তখন সেখানের অণুগুলোর দুলুনি একটু বেড়ে গেছে। তাই কোনো কিছুর অণুগুলোর দুলুনি বাড়ালে তা গরম হয়ে যায়।
এবার আসল প্রশ্নে আসা যাক, আমাদের গরম লাগে কেন? তুমি কি কখনো রান্নার সময় হাঁড়ির মধ্যে রেখে দেওয়া চামচে হাত দিয়ে দেখেছ? অনেক গরম লাগে, তাই না? এমনকি হাতও পুড়ে যেতে পারে। এখানে কী হয়? চামচটা থাকে অনেক গরম। তোমার হাতের তুলনায় চামচের অণু-পরমাণুর গতিও থাকে অনেক বেশি। তুমি যখন হাত দিয়ে ধরতে যাচ্ছ, তখন হাত আর চামচের অণু-পরমাণুগুলো খুব কাছাকাছি চলে আসে। তখন কী হয় বুঝতে হলে তোমার ক্লাসের কথা চিন্তা করো।
ধরা যাক তোমরা বন্ধুরা একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছো। এক পাশের একটা বন্ধু ডানে-বাঁয়ে দুলছে। তার পাশে বসা বন্ধু যদি ওই বন্ধুর খুব কাছ ঘেঁষে বসে, তাহলে সে-ও দুলতে শুরু করবে না? এটাই ঘটে তোমার হাত আর চামচের মধ্যে। চামচের অণু-পরমাণু দুলতে থাকে অনেক দ্রুত, হাতের অণুগুলো ধাক্কা খেয়ে দুলতে থাকে আরও জোরে। এভাবেই গরম হয়ে যায় তোমার হাত। আর দুলুনি যদি অনেক অনেক বেশি হয়, তাহলে তোমার শরীরের কোষের অণুগুলো এদিক-সেদিক ছিটকে পড়ে কোষের গঠনটাই ভেঙে ফেলতে পারে। একে বলি আমরা পুড়ে যাওয়া। তখন আমাদের হাতে জ্বলুনি হয়, আমরা ব্যথা পাই।
এখন কোন বস্তুর অণু বেশি দুলছে, এটা কীভাবে বোঝা যাবে? দুলুনি বোঝার উপায় হলো তাপমাত্রা। কোনো বস্তুর তাপমাত্রা বেশি মানে তার দুলুনি বেশি। তোমার যখন জ্বর হয়, তখন শরীরের অণুগুলোর ছোটাছুটি বেড়ে যায়। তাই তাপমাত্রাও খানিকটা বাড়ে। তখন ডাক্তার তোমার শরীরে একটা থার্মোমিটার দিয়ে দেখেন কত জ্বর হলো। তিনি আসলে দেখেন তোমার শরীরের তাপমাত্রা কত হলো। মানুষের শরীরের সুস্থ অবস্থায় তাপমাত্রা ৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তাপমাত্রা এর চাইতে বেড়ে গেলেই আমরা বলি জ্বর হয়েছে। ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর হলে আমাদের ওষুধ খেতে হয়।
ডাক্তাররা তাপমাত্রা মাপেন ফারেনহাইট এককে। অন্য আরেকটা একক আমরা সব সময় ব্যবহার করি, সেটাকে বলে ডিগ্রি সেলসিয়াস। সে হিসাবে আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রার গুরুত্ব নিশ্চয় তোমরা বুঝতে পারছ। কম তাপমাত্রার কোনো বস্তু বেশি তাপমাত্রার বস্তুর কাছে এলে কিছু তাপ গরম বস্তু থেকে ঠান্ডা বস্তুতে যাবে। ঠান্ডা বস্তুর তাপমাত্রা তাতে কিছুটা বেড়ে যাবে আর গরম বস্তুর তাপমাত্রাও কিছুটা কমবে।
প্রশ্ন হলো কত দ্রুত গরম বস্তু তাপ ঠান্ডা বস্তুকে দেবে? উত্তরটা হলো তাদের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য যত বেশি হবে। এক গ্লাস পানির কথা ভাবো, সাধারণ অবস্থায় পরিবেশের তাপমাত্রা মোটামুটি ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই এক গ্লাস পানি নিলে তার তাপমাত্রাও হবে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার ফ্রিজ থেকে খুব ঠান্ডা এক গ্লাস পানি নিলে তার তাপমাত্রা হবে মোটামুটি ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তুমি এই দুটি গ্লাসে হাত দিলে কোনটা বেশি ঠান্ডা লাগবে? অবশ্যই ফ্রিজের পানি। কেন? কারণ তোমার শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রথম গ্লাসের জন্য তাপমাত্রার পার্থক্য (৩৭-২৫) বা ১২ ডিগ্রি। দ্বিতীয় গ্লাসে এ জন্য (৩৭-৩) বা ৩৪ ডিগ্রি। তাপমাত্রার পার্থক্য বেশি হওয়ায় দ্বিতীয় গ্লাসের পানিতে তোমার শরীর থেকে সহজে তাপ চলে যাবে। তুমি যেহেতু দ্রুত তাপ হারাবে, তোমার তাই বেশি ঠান্ডা লাগবে।
এবার আসা যাক আমাদের চারপাশের তাপমাত্রায়। শীতকালে পরিবেশের তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। ১৯ বা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হয়, মাঝে মাঝে তা কমে ১৫ বা ১৬ ডিগ্রিও হতে পারে। পার্থক্য বেশি হওয়ায় তখন আমাদের শরীর থেকে তাপ খুব দ্রুত বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে, এ জন্যই আমাদের তখন ঠান্ডা লাগে।
এবার দেখা যাক গরমকালে গরম লাগে কেন। খুব গরমের দিনে তাপমাত্রা হয় মোটামুটি ৩৩-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেখতেই পাচ্ছ, তখনো বাইরের তাপমাত্রা আমাদের শরীরের থেকে কম। সে হিসাবে তো আমাদের শরীর থেকে বাইরে তাপ যাওয়ার কথা, তাহলে গরম লাগে কেন?
একটু খেয়াল করলে দেখবে, তখন আমাদের শরীরের থেকে বাইরের তাপমাত্রা মাত্র ৩-৪ ডিগ্রি কম। তাই তাপ যায় খুবই আস্তে আস্তে। এদিকে সারা দিন কিন্তু আমাদের শরীরে কোষগুলো কাজ করতে গিয়ে সব সময় কিছু পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করতে থাকে। ওই তাপ বাইরে দ্রুত না দিয়ে দিতে পারলে আমাদের গরম লাগে।
গরম লাগলে তোমরা নিশ্চয় ফ্যানের বাতাসের নিচে বসে থাকো বা পাখা দিয়ে বাতাস করো। তখন কেন ঠান্ডা লাগে?
বাতাসের তাপমাত্রা আমাদের শরীরের চেয়ে কম। তাই খুব আস্তে হলেও শরীর থেকে কিছু তাপ বাতাসে চলে যায়। তাতে আমাদের শরীরের সঙ্গে লাগানো বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে আমাদের শরীরের সমান হয়ে যায়। তখন তাপ আর সহজে বাতাসে যেতে পারে না। আমরা পাখা দিয়ে বাতাস করার সময় ওই গরম বাতাসটা ধাক্কা দিয়ে শরীরের পাশ দিয়ে সরিয়ে দিই। তখন নতুন বাতাস এসে আমাদের চারপাশে জমা হয়। এই বাতাসের তাপমাত্রা যেহেতু কম থাকে, তাই তারা আবার তাপ নিতে পারে। কিন্তু সেই বাতাসও গরম হয়ে গেলে আবার পাখা দিয়ে বাতাস করে তাকে সরিয়ে দিতে হয়, নতুন বাতাসকে জায়গা করে দিতে হয়। এভাবেই আমরা বাতাস দিয়ে নিজেকে ঠান্ডা রাখি।
তুমি যখন মাঠের মধ্যে জোরে দৌড় দাও, তখন কিন্তু তোমার শরীরের কোষগুলোকে বেশি কাজ করতে হয়। তাই সেগুলোতে তাপও বেশি উৎপন্ন হয়। এ জন্য তখন কিন্তু বেশি গরম লাগার কথা। দৌড়ানো অবস্থায় কিন্তু তোমার বেশি গরম লাগে না। কারণ তখন তোমার চারপাশে প্রতি মুহূর্তে নতুন বাতাস আসে, গরম বাতাসগুলো সরে যায়। কিন্তু যেই তুমি দৌড় থামাও, তোমার চারপাশের বাতাস আর নড়ে না, তখন প্রচণ্ড গরম লাগতে শুরু করে।
মানুষ কিন্তু গরমে অন্য অনেক প্রাণী থেকে বিশেষ সুবিধা পায়। আমাদের শরীরের বাইরের দিকে প্রায় পুরোটাজুড়েই আছে ত্বক। এই ত্বক থেকে সহজেই বাইরে তাপ বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু অনেক প্রাণীর প্রায় সব ত্বকই পশমে ঢাকা। পশমজাতীয় জিনিস সহজে তাপ পরিবহন করে না। তাই ওই সব প্রাণীর দেহ থেকে সহজে তাপও বেরোতে পারে না। তাই তাদের গরমও লাগে বেশি। গরমের সময় দেখবে কুকুর হাঁ করে জিব বের করে রেখেছে। কারণ, ওর পুরো শরীর পশমে ঢাকা। তাই তাপ বাইরে বের করতে মুখটা খুলে জিব বের করে রাখে। যাতে সেখান থেকে কিছু তাপ বাতাসে চলে যেতে পারে।
গরমের মধ্যে আমরা যখন বাইরে বেরোই, তখন উজ্জ্বল ও হালকা রঙের কাপড় পরলে আরাম লাগে। তুমি যদি গরমকালে কালো একটা জামা পরে বাইরে বের হও, দেখবে তোমার বেশি গরম লাগবে। আচ্ছা, চিন্তা করে দেখো তো, কালো বিড়াল তো সারা দিন কালো পশমে ঢাকা থাকে। সাদা বিড়ালের চাইতে কি কালো বিড়ালের গরম বেশি লাগে?
তাপের আরেকটা মজার ব্যাপার আছে। কোনো বস্তুর তাপমাত্রা বাড়ালে তার অণু-পরমাণুগুলোর মধ্যে যে কাঁপাকাঁপি বা ছোটাছুটি বেড়ে যায়, তা তো জানোই এতক্ষণে। কোনো কিছু ছোটাছুটি বেশি করলে তার যে একটু বেশি জায়গা লাগবে, তা নিশ্চয় বুঝতে পারছ। তাই কোনো কিছুর তাপ বাড়লে তা কিছুটা ফুলে ওঠে বা বড় হয়ে যায়। যেমন ধরো, তুমি যদি এক মিটার লম্বা একটা লোহার রড গরম করো, দেখবে ওই রডের দৈর্ঘ্য এক মিটারের চাইতে একটু বেশি হয়েছে। যেকোনো কিছুই গরম করলে তার আকার একটু বেড়ে যায়। তাই গরমকালে ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা কিছুটা বেড়ে যায়। যখন সবচেয়ে বেশি গরম পড়ে, তখন এর উচ্চতা ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়তে পারে!
তোমার কি কখনো মনে হয়ছে মোবাইল ফোনে গেম খেললে কেন গরম হয়ে যায়? এর কারণ দুটি। মোবাইলের ব্যাটারির মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন হয়। যে বিদ্যুৎ দিয়ে মোবাইলটা চলে। এ সময় কিছু পরিমাণ তাপও উৎপন্ন হয়, যে কারণে মোবাইলটা গরম হতে পারে। আরেকটা কারণ হলো, কোনো যন্ত্রের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে গেলে তা বাধা পায়, যে বাধার জন্য কিছু তাপ উৎপন্ন হয়। তুমি যখন মোবাইল ফোনে গেম খেল, তখন মোবাইলের প্রসেসরকে অনেক বেশি কাজ করতে হয়। এই কাজের জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। ফলাফলে উৎপন্ন হয় অনেক তাপ।
এবার শেষ একটা ব্যাপার দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক। তুমি নিশ্চয় শুনেছ, রাশিয়া বা আমেরিকার চাইতে বাংলাদেশে গরম বেশি। কেন?
পৃথিবীতে তাপ আসে সূর্য থেকে। দিনের বেলায় সূর্য থেকে আসা তাপ পৃথিবীকে গরম করে, রাতের বেলায় পৃথিবী তাপ ছেড়ে দিয়ে ঠান্ডা হয়। এখন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরে বেড়ানোর সময় কিছুটা ঝুঁকে ঘোরে। এপ্রিল-মে মাসে পৃথিবীর উত্তর মেরু সূর্যের দিকে ঝুঁকে থাকে। তাই উত্তর মেরুর দেশগুলোতে তখন রাতের চেয়ে দিনগুলো বড় হয়। অর্থাৎ, গরম হওয়ার জন্য দিনের বেলায় বেশি সময় পায়। ঠান্ডা হওয়ার জন্য রাতে কম সময় পায়। কোনো কিছুকে তুমি যদি বেশি সময় ধরে গরম করো, আর অল্প সময় ঠান্ডা করো, তাহলে তা যে গরম হয়ে যাবে। তাই না? পৃথিবীর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়।
ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে শীতকালে পৃথিবীর উত্তর মেরু সূর্যের উল্টো দিকে ঝুঁকে থাকে। তখন রাত হয় বড়, দিন হয় ছোট। দিনের বেলায় যতক্ষণ গরম হয়, রাতে ঠান্ডা হয় তার চাইতে বেশি সময়। তাই দেখা দেয় শীতকাল।
বাংলাদেশ অবস্থিত উত্তর মেরুতে। তা-ও প্রায় মাঝামাঝিতে। তাই এপ্রিল-মে মাসে দিনের আকার হয় অনেক বড়। গরমও হয় অনেক বেশি।
দিনের আকার বড় হওয়ার প্রভাব পড়ে গাছের ওপরও। গাছদের খাদ্য বানাতে সূর্যের আলো লাগে। কিছু গাছের ফল ফলাতে অনেক বেশি সূর্যের আলো লাগে। দিনের আকার ছোট হওয়ায় যা শীতকালে পায় না গাছেরা। তাই সেই সব গাছে ফলও হয় না তখন। গরমকালে যখন অনেক বড় দিনে অনেক সূর্যের আলো পায়, তখন মজাদার সব ফলে গাছগুলো ভরে যায়। তাই গরমকালে আম-কাঁঠাল-লিচু-তরমুজসহ মজাদার অনেক অনেক ফল পাওয়া যায়। ফল পাকার প্রক্রিয়াকেও সহায়তা করে গরম আবহাওয়া।
তাই তো মজাদার সব ফল খেতে পারি আমরা। স্কুলেও ছুটি থাকে। গরম থেকে বাঁচার বুদ্ধি তো পেয়েছ। এবার ফল খাও, আর সুস্থ থাকো।