ইন্টারনেট ঠিক কীভাবে কাজ করে (প্রথম পর্ব)
ছোট মামার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে দারুণ মজা। সঙ্গে শীতের পিঠা হলে তো কথাই নেই। ষোলো আনার বদলে আঠারো আনা উশুল। বড় মামি ভাপা পিঠা বানিয়েছেন। সঙ্গে খেজুরের রস। ওদের এলাকায় বলে রাব। নানাবাড়ির আঙিনায় বসে আড্ডা দিচ্ছে ওরা। মামার হাতে একটা ল্যাপটপ। পিঠা খেতে খেতে কী যেন কাজ করছেন। রাফির হাতে ওর স্মার্টফোন। ইউটিউবে একটা গান শুনছে সে।
হঠাৎ গানটা পজ করে রাফি ছোট মামাকে বলল, ‘মামা, এই যে আমরা ইউটিউবে গান শুনি, ভিডিও দেখি—এসবই তো ইন্টারনেট ব্যবহার করে করি। আবার গুগলে সার্চ করলেই সব তথ্য চলে আসে চট করে। এই ইন্টারনেট জিনিসটা কীভাবে কাজ করে? এত কিছু কীভাবে সম্ভব?’
মামা ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকালেন। হেসে বললেন, ‘ভালো প্রশ্ন করেছিস। তুই কিন্তু অনেকের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেছিস, বুঝলি?’
‘মানে?’
‘সবাই তো ইন্টারনেট চালায়। জিনিসটা এখন বাতাসের মতো হয়ে গেছে বলতে পারিস। আমরা সবাই ইন্টারনেট-সমুদ্রে ডুবে আছি, কিন্তু জিনিসটা আলাদা করে চোখে পড়ে না। তোর চোখে পড়েছে, এটা একটা বড় ব্যাপার!’
রাফি থতমত খেয়ে গেল। বড় মানুষেরা প্রশংসা করলে ছোটরা যেমন বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকে, সেভাবে তাকিয়ে রইল।
মামা শব্দ করে হেসে ফেললেন ওর মুখভঙ্গি দেখে। তারপর ল্যাপটপের ডালাটা নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইন্টারনেট কীভাবে কাজ করে, শুধু সেটাই শুনবি, নাকি গল্প শুনবি?
এবারে রাফির মুখভঙ্গি খানিকটা সহজ হয়ে এল। সে হেসে বলল, ‘গল্প শুনব।’
‘ঠিক আছে, চল, তোকে একটা মজার গল্প বলি।
‘সেটা প্রায় ৬০ বছর আগের কথা। ১৯৬২ সালের আগস্ট মাস। যুক্তরাষ্ট্রে একটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় আছে, নাম এমআইটি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছিলেন জে সি আর লিকলাইডার নামে এক ভদ্রলোক। তিনি প্রথমবারের মতো গ্যালাক্টিক নেটওয়ার্ক নামে একটি ধারণার কথা বলেন। তিনি ভাবলেন, পৃথিবীর সব কম্পিউটারকে যদি একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত করা যায়, তাহলে মানবসভ্যতা অনেক দূর এগিয়ে যাবে। পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের যে কারও কম্পিউটারে রাখা বিভিন্ন তথ্য বা প্রোগ্রাম মুহূর্তের মধ্যে সংগ্রহ করে নিতে পারবে। এই ভদ্রলোক তিন মাস পর, মানে অক্টোবরে ডারপা (DARPA) নামে একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন।’
‘ডারপা কী, মামা?’
‘ডারপা মূলত মার্কিন সেনাবাহিনীর গবেষণা শাখা। এর পুরো নাম, দ্য ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট। ওরা নিয়মিতই নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। বিভিন্ন প্রযুক্তি উন্নয়নও করে। শুনে যে রকম মহৎ মনে হচ্ছে, ওদের উদ্দেশ্য অবশ্য অত মহৎ নয়। ওদের আসল উদ্দেশ্য হলো, আরও উন্নত প্রযুক্তি যদি থাকে, তা যেন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই আগে আসে। কিন্তু উদ্দেশ্য যা-ই হোক, তোকে স্বীকার করতেই হবে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এত উন্নতির পেছনে ওদের অবদান অনেক।’
‘লিকলাইডার পরে কী করলেন, সেটা বলো, মামা।’
‘আরে, এত অধৈর্য হলে হবে? বলছি তো।
‘ডারপায় গিয়ে উনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মানে বসদের বোঝালেন, এ রকম নতুন ধরনের নেটওয়ার্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ওদিকে এমআইটিতে তখন আরেক গবেষক তথ্য আদান–প্রদানের দারুণ একটা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিলেন। এর নাম প্যাকেট সুইচিং। তিনি তখনো প্র্যাক্টিক্যালি, মানে হাতে-কলমে কাজ শুরু করেননি। তাত্ত্বিকভাবে কাজ করছিলেন। এই গবেষকের নাম লরেন্স জি রবার্টস। তাঁর সঙ্গেও কথা বললেন লিকলাইডার। শুরু হলো তাঁদের গবেষণা।
এখন তোকে খানিকটা জটিল কথাবার্তা বলব। বুঝতে পারবি?’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘কম্পিউটার তো বোকা যন্ত্র, বুঝলি? সে শুধু ০ আর ১ বোঝে, আর কিছু বোঝে না। এই ০ আর ১-কে বলে বাইনারি ডিজিট, সংক্ষেপে বলে বিট। বাই মানে দুই, আর ডিজিট মানে সংখ্যা। তো, বাইনারি ডিজিট বা বিট মানে হচ্ছে, এখানে শুধু দুটি সংখ্যা দিয়েই সব কাজ করতে হবে। আমরা আজকাল কম্পিউটার বা ইন্টারনেটে যত রকম তথ্য আদান–প্রদান করি, আমরা তো বাংলা বা ইংরেজিতে লিখি; কম্পিউটার এসব শব্দ বা অক্ষরকে বাইনারি বানিয়ে ফেলে। এসবের নিয়মকানুন আছে। সেটা অনেক বড় আলাপ, আজ থাকুক। আপাতত তোর এটুকু মনে রাখলেই হবে।’
‘এর সঙ্গে প্যাকেট সুইচিং না কী, ওটার আবার কী সম্পর্ক?’
‘সম্পর্ক আছে। প্যাকেট সুইচিং তথ্য আদান–প্রদানের দারুণ এক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় যেসব তথ্য তুই পাঠাতে চাস, তার সবটাকে বাইনারি প্যাকেট আকারে ভেঙে ফেলা হয়। একেকটা অক্ষর বা শব্দের জন্য অনেকগুলো করে প্যাকেট হয়। এখন তোর কাজ হলো, তুই সব কটা প্যাকেটকে আলাদা আলাদা করে পাঠিয়ে দিবি। কীভাবে পাঠাবি? পৃথিবীর যেকোনো দুটি কম্পিউটারের মধ্যে হাজার হাজার নেটওয়ার্ক পথ আছে। কথাটা জটিল মনে হলে তুই ভাবতে পারিস, অনেকগুলো তার দিয়ে কম্পিউটার দুটি যুক্ত। এই হাজারো তার বা নেটওয়ার্ক পথ ধরে আলাদা আলাদা করে প্যাকেটগুলো তোর গন্তব্যের কম্পিউটারে পৌঁছে যাবে। পথ যেহেতু অনেক, কাজেই ঝামেলা কম, জ্যাম কম। তাই অল্প সময়েই সব কটি প্যাকেট পৌঁছে যাবে। তারপর প্যাকেটগুলো একটার পর একটা বসে একসঙ্গে জুড়ে গিয়ে আবার মূল তথ্যটা তৈরি করবে। মজার না বিষয়টা?’
‘হ্যাঁ। বাস্তবে এটা ব্যবহার করা হয়?’
‘হয় তো! তুই যখন গুগলে কোনো ছবি সার্চ করিস, তখন কিন্তু ওই ছবি এভাবেই তোর হাতের মোবাইলে এসে পৌঁছায়। কিন্তু এই তত্ত্ব আমি তো খুব সহজ করে বললাম, বিষয়টা আরও জটিল। আর এখন এটাকে আরও উন্নতও করা হয়েছে। এ জন্য ইউটিউবের মতো ভিডিও সাইটগুলোতে সব কটা প্যাকেট এসে পৌঁছাতে হয় না। যে কটা প্যাকেট পৌঁছালে ভিডিওটা প্লে হতে পারবে, সেটুকু এলেই ভিডিওটা চলতে শুরু করে। আর কোনো প্যাকেট না পৌঁছালে ভিডিও লোড হতে থাকে—ওই প্যাকেটের জন্য অপেক্ষা আরকি। আমরা বলি বাফারিং। এর মানেটা কী, বুঝতে পারছিস?’
‘হ্যাঁ, বুঝেছি! পুরো ভিডিওর সবটা একেবারে আসার পর প্লে হলে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হতো আমাদের, তাই না?’
‘এই তো, বুঝেছিস। তখন একদম দিন ফুরিয়ে যেত।’
‘তুমি তো অন্য কথায় চলে গেলে। ইন্টারনেটের কথা বলো, মামা।’
‘আরে, বলছি তো। এই যে প্যাকেট সুইচিংয়ের কথা বললাম, ১৯৬১ সালে প্রথম লেওনার্ড ক্লেইনরক নামের এক ভদ্রলোক একটা গবেষণাপত্রে এটার কথা লিখেছিলেন। এই ভদ্রলোকও এমআইটির। তিন বছর পর এ নিয়ে তিনি একটা বইও লিখে ফেললেন। কিন্তু জিনিসটা আসলেই কাজ করে কি না, সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে না?’
তাঁর তত্ত্ব পরীক্ষা করে দেখেন রবার্টস এবং থমাস মেরিল নামে দুজন বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রে দুটি শহর আছে—ম্যাসাচুসেটস ও ক্যালিফোর্নিয়া। ওনারা একধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করে প্রথম এই প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতিতে তথ্য আদান–প্রদান করে দেখলেন। এভাবে বোঝা গেল, জিনিসটা আসলেই কাজ করে। কম্পিউটারবিজ্ঞানের ভাষায় এই নেটওয়ার্কের একটা গালভরা নাম আছে, ওয়াইড-এরিয়া-কম্পিউটার নেটওয়ার্ক। সংক্ষেপে বলে ওয়ান (WAN)।’
মামা একটু থেমে বললেন, ‘বেশি তত্ত্বকথা বলে ফেলছি, না? কিন্তু এই কাহিনি বলার কারণ আছে।’
রাফি বলল, ‘বলো, সমস্যা নেই। বুঝতে পারছি।’
‘আচ্ছা। তো, প্যাকেট সুইচিং তত্ত্ব তো হলো, কিন্তু এটা ব্যবহারের জন্য একটা নেটওয়ার্ক তো লাগবে। ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে এ নিয়েই কাজ করছিলেন রবার্টস। এত দিন পর এসে তিনি এই নেটওয়ার্ক নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন ডারপাকে। এই নেটওয়ার্কের নাম দেওয়া হলো অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি নেটওয়ার্ক, সংক্ষেপে আরপানেট (ARPANET)। এটাকে তুই বলতে পারিস ইন্টারনেটের বাবা।’
‘তারপর?’
‘১৯৬৯ সালে বিজ্ঞানীরা এটা পরীক্ষা করে দেখলেন। এবারে একটা যন্ত্র বসানো হলো যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরেকটা যন্ত্র বসানো হলো স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। দুটি জায়গার দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার। এখন তথ্য পাঠানো হবে। ওনারা ভাবলেন, ইংরেজিতে লগইন (LOGIN) শব্দটা লিখে পাঠাবেন। বিষয়টা একবার ভাব—টানটান উত্তেজনা নিয়ে একদল বিজ্ঞানী দাঁড়িয়ে আছেন। ইন্টারনেটের প্রথম তথ্য পাঠাতে যাচ্ছেন তাঁরা।’
চলবে...