সাফারিতে বন্যপ্রাণী আক্রমণ করে না কেন
তানজানিয়ায় অবস্থিত সেরেঙ্গেটি ন্যাশনাল পার্ক বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। পার্কটি প্রায় ১৪ হাজার ৭৬৩ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি সিংহের আবাসস্থল এখানে। পাশাপাশি আরও রয়েছে নীল ওয়াইল্ডবিস্ট, জেব্রা, আফ্রিকান হাতি, চিতা, আফ্রিকান মহিষসহ আরও অনেক প্রাণী। এখানেই দেখা মেলে গ্রেট মাইগ্রেশনের। যা দেখার জন্য হাজার হাজার পর্যটক ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার আসেন প্রতিবছর। পৃথিবীজুড়ে এমন বেশ কয়েকটি ন্যাশনাল পার্ক রয়েছে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ও ডিসকভারি টিভি চ্যানেলে প্রায়ই এই ন্যাশনাল পার্কগুলো নিয়ে ডকুমেন্টারি দেখায়। যেখানে পর্যটকরা জিপ গাড়িতে জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণ করেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর লাগে যখন জিপের ভেতরে থাকা ব্যক্তিরা নির্দ্বিধায় বন্যপ্রাণীদের সামনে বসে থাকেন। বন্যপ্রাণীরাও তাঁদের সামনে বসে বা শুয়ে থাকে। দেখে মনে হয় মানুষের উপস্থিতিতে এদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আমার মতো এখন অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন নিশ্চয়ই এসেছে, কীভাবে পর্যটকরা সাফারিতে সিংহ বা অন্যান্য বন্যপ্রাণীর এত কাছাকাছি গিয়েও নিরাপদে থাকেন? কেন বন্যপ্রাণী আক্রমণ করে না?
আমরা ডকুমেন্টারিতে যে দৃশ্য দেখি তা মাসের পর মাস ধরে ধারণ করা হয়। অনেক কম পর্যটকই সাফারিতে গিয়ে প্রথম বারেই কাছ থেকে বন্যপ্রাণীর দেখা পেয়েছেন। কারণ, এরা বন্য পরিবেশে মিশে থাকে।
এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়াটা মুশকিল। কেননা প্রতিটি প্রাণীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে এবং সঙ্গে অনেক কারণও থাকতে পারে কেন এরা জিপ গাড়িতে বসে থাকা মানুষদের শিকার মনে করে না। বন্য পরিবেশের বেশিরভাগ প্রাণীই সহজাতভাবে মানুষের প্রতি আক্রমণাত্মক নয়। এদের বেঁচে থাকার জন্য দরকার খাবার খোঁজা, নিজেদের এলাকা রক্ষা করা এবং ছানাদের বড় করা। এদের একটি নিদিষ্ট শিকারের তালিকা রয়েছে। সেই তালিকাতে মানুষ নেই। এটা একটা কারণ।
আরেকটা কারণ হতে পারে, অনেক ন্যাশনাল পার্কে প্রাণীরা সাফারির গাড়ির উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সে জন্য জিপগুলোকে হুমকি হিসেবে দেখে না। কেননা প্রতিটা ন্যাশনাল পার্ক কিছু সাফারির নিয়মকানুন মেনে চলে। যাতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ওপর কোনো প্রভাব না পরে। পর্যটকেরা সে সব নিয়ম মেনে চলে। এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করে, যেন কোনো বন্যপ্রাণী ন্যূনতম বিরক্ত না হয় তাঁদের উপস্থিতিতে। বন্যপ্রাণীরা সবসময় চেষ্টা করে মানুষের থেকে দূরে থাকতে।
সাফারি গাইডরা প্রায়ই পর্যটকদের বলেন, বন্যপ্রাণীরা গাড়িতে থাকা ব্যক্তিদের আলাদা কোনো বস্তু হিসেবে দেখে না। বরং, এরা গাড়িটিকে একটি বিশাল বস্তু হিসেবে দেখে, যা শিকারি বা শিকার নয়। ভ্রমণের গাড়িগুলো গাছের মতো প্রাকৃতিক দৃশ্যের অংশ হয়ে যায়। সেজন্য বন্য সিংহ বা অন্যান্য প্রাণীরা এত কাছাকাছি চলে আসে। এই অসাধারণ প্রাণীগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখতে হলে অনেক ধৈর্য ধরে থাকতে হয়। কেননা আমরা ডকুমেন্টারিতে যে দৃশ্য দেখি তা মাসের পর মাস ধরে ধারণ করা হয়। অনেক কম পর্যটকই সাফারিতে গিয়ে প্রথম বারেই কাছ থেকে বন্যপ্রাণীর দেখা পেয়েছেন। কারণ, এরা বন্য পরিবেশে মিশে থাকে।
যখন কোনো পর্যটকদল ন্যাশনাল পার্ক ভ্রমণে যান, তখন তাঁদের নিরাপত্তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সাফারি গাইডরা সঙ্গে অস্ত্র রাখেন, যেন কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটে। গাইডরা সবসময় ওয়াকিটকির মাধ্যমে এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে যোগাযোগ রাখেন। কোনো গাইড যদি কোনো সিংহ বা অন্য প্রাণীর দেখা পান, তখন অন্য গাইডদের জানালে তাঁরাও সাফারি নিয়ে সেখানে আসেন। যাতে তাঁর সঙ্গে থাকা পর্যটকদল কাছ থেকে বন্যপ্রাণীর দেখতে পায়।
তবে সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণী কিন্তু চিড়িয়াখানার প্রাণীদের মতো নয়। সাফারি পার্কে প্রাণীরা এদের প্রাকৃতিক পরিবেশে অবাধে বিচরণ করে, যা এদের স্বাভাবিক আচরণ বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে চিড়িয়াখানায় প্রাণীরা সবসময় খাঁচায় বন্দী থাকে। এখানে এদের পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয়, সেজন্য শিকারের প্রবৃত্তি কমে যায়।
মাঝে মাঝে হাতি, গন্ডার, জিরাফ, জলহস্তী সাফারির গাড়ি দেখে তেড়ে আসে আক্রমণ করতে। এরা সাফারির গাড়িকে নিজেদের শত্রু মনে করে। কিংবা অনেক সময় বিরক্ত হওয়ার কারণে এরা আক্রমণ করে। তবে গাড়ির গতির সঙ্গে পেরে ওঠে না এরা। ২০২৪ সালে জুন মাসে জাম্বিয়ায় সাফারি পার্কে একটি হাতির আক্রমণে নিউ মেক্সিকোর একজন মার্কিন পর্যটক নিহত হয়। গত বছর আফ্রিকায় সাফারির সময় জলহস্তীর আক্রমণে নিহত হন এক নারী। এই ধরনের ঘটনা মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। এই ঘটনাগুলোর বেশিরভাগ করণ হয় পর্যটকরা গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে বন্যপ্রাণীদের কাছে চলে গিয়েছে বা প্রাণীদের বিরক্ত করেছে। সে জন্য এ ধরনের ভ্রমণে গাইডের কথা মেনে চলা উচিত।
সূত্র: ডিস্কোভার আফ্রিকা, টিসি ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফি, সিবিএস নিউজ, বিবিসি, উইকিপিডিয়া