নিরাপদ বাংলাদেশ চাই

আমরা কোনো রক্তপাত চাই না। আমরা সব শিশুর মুখে হাসি দেখতে চাই
অলংকরণ: মেহেদী হক

আমরা তোমাদের কাছে ক্ষমা চাই।

জানি, তোমাদের কারোরই এখন মন ভালো নেই, মন মরে আছে আমাদেরও। এই শ্রাবণে কাঁদছে মানুষের মন। মানুষের জন্য কাঁদছে মানুষ।

গত কয়েক দিনে আমাদের দেশে অনেক অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন। বড়দের পাশাপাশি প্রাণ হারিয়েছে অনেক শিশু–কিশোরও।

কেন এমন হবে? আমরা তোমাদের জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারিনি। বলেছিলাম, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব…।’ আমাদের অঙ্গীকার আমরা রাখতে পারিনি। তোমরা আমাদের ক্ষমা করো।

এখন তো কাঁঠালচাঁপা ফুল ফোটার সময়। তোমাদের চারপাশে হয়তো ফুটে আছে সুন্দর সে ফুল! ‘আম্মা বলেন, পড়রে সোনা/ আব্বা বলেন, মন দে;/ পাঠে আমার মন বসে না/ কাঁঠালচাঁপার গন্ধে…।’ কাঁঠালচাঁপা দেখে তার ঘ্রাণ নিতে নিতে কবি আল মাহমুদের কবিতাটা কি মনে পড়ে? মনটা কি পড়ার বই থেকে একটু পালিয়ে যায়? তারপরও আমরা তোমাদের বলি, পড়ো—মন দিয়ে পড়ো।

এতকাল তো এমনই হয়ে এসেছে। তোমরা স্কুলে যেতে, আবার স্কুল থেকে বাসায় ফিরে পড়াশোনা শেষে একটু গেম খেলতে, কম্পিউটারে গুগল সার্চ করে হয়তো জেনে নিতে কোনো তথ্য। আর বড় কোনো ছুটিছাটা পেলে একছুটে হয়তো চলে যেতে দাদাবাড়ি কি নানাবাড়ি। তোমাদের দিনগুলো ছিল বড়ই আনন্দময়। আমরা সব সময় তোমাদের উচ্ছ্বাসমাখা এক শৈশবই দিতে চেয়েছি।

যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে ১১ তলা বাড়ির ৮ তলায় মা–বাবার সঙ্গে থাকত চার বছরের ছোট্ট আহাদ। একই দিনে তাদের বাড়ির সামনেই চলছিল সংঘর্ষ। আহাদ এ সময় বাড়িতেই ছিল, মা–বাবার পাশে। হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে।

কিন্তু আমরা তা পারিনি। তোমাদের কাছে আমাদের মাথা নিচু হয়ে গেছে। মুখে কোনো ভাষা নেই। আদতে কথা বলার মুখই নেই আমাদের। আমাদের কাছ থেকে তোমাদের শেখার কথা। আমাদেরই নিরাপত্তা দেওয়ার কথা তোমাদের। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আমরাও যে খুব অসহায়!

আরও পড়ুন

সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের পটভূমিতে কয়েক দিনের সহিংস ঘটনায় অনেক শিশু–কিশোরের বুকে গুলি বিঁধল এবং সব কটি ঘটনায় তোমাদের কচি মনে গভীর দাগ রয়ে গেল। যে অমোচনীয় ক্ষতের সৃষ্টি হলো হৃদয়ে, তার ভার কীভাবে আমরা বহন করব? কী জবাব দেব তোমাদের?

তোমরা আমাদের মাফ করে দাও।

তোমাদের স্কুলে থাকার কথা ছিল, বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি করার কথা ছিল। কিন্তু আচমকা বন্ধ হলো স্কুল–কলেজ। বরাবর স্কুল–কলেজ ছুটি হওয়ায় খুশিই হতে তোমরা। কিন্তু এবার সবার মনেই ছিল উৎকণ্ঠা। তোমাদের অনেকে রাস্তায় নেমে এলে। আমরা আরও উৎকণ্ঠিত হলাম। পাখির ছানার মতো ঘরে আগলে রাখতে চাইলাম তোমাদের। তবে ঘরের মধ্যে থেকেও কেন তোমাদের কেউ কেউ অকালে ঝরে গেল?

এ প্রশ্নের জবাব আমরাও খুঁজছি। বড় হয়ে ইতিহাসে নিশ্চয় এর জবাব তোমরা খুঁজে পাবে।

আমরা তোমাদের বলতাম, জগৎটাকে দেখতে হবে। বলতাম, ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে।’ তবে ১১ বছরের ছোট্ট ছেলে সিয়াম সেদিন জগৎটাকে দেখার জন্য জানালা খোলেনি, বরং জানালাটা সে বন্ধই করতে গিয়েছিল।

ঢাকার মিরপুরের কাফরুল এলাকার চারদিকে গত ১৯ জুলাই, শুক্রবার ছিল মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। বিকট শব্দে আকাশে উড়ছিল হেলিকপ্টার। কাঁদানে গ্যাসের শেলের ধোঁয়াও ঢুকছিল ঘরে। নিরাপত্তার জন্য এ সময় জানালা বন্ধ করা ছাড়া উপায় কী! সিয়াম তাই জানালা বন্ধ করতে গিয়েছিল। এমন সময় বাইরে থেকে গুলি এসে তার মাথায় লাগে। জানালার পাশে সিয়ামের পড়ার টেবিলে থাকা বইপত্র আর প্লাস্টিকের খেলনা রক্তে ভেসে যায়…!

আরও পড়ুন

ঢাকায় যখন এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে, সেদিনই বাবার নিরাপদ কোলে থাকার পরও মারা যায় সাড়ে ছয় বছর বয়সী শিশু রিয়া গোপ। রিয়ারা থাকত নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকার চারতলা এক বাড়ির একেবারে ওপরের তলায়। সেদিন রিয়া আপন মনে ছাদে খেলছিল। এর মধ্যে হঠাৎই ওদের এলাকায় শুরু হলো সংঘর্ষ। মেয়েকে ঘরে আনতে ছাদে গেলেন তাঁর বাবা দীপক কুমার গোপ। রিয়াকে মাত্রই কোলে নিয়েছেন, এ সময় কোথা থেকে ছুটে এল ঘাতক বুলেট। বাবার কোলে ঢলে পড়ল মেয়েটি।

যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে ১১ তলা বাড়ির ৮ তলায় মা–বাবার সঙ্গে থাকত চার বছরের ছোট্ট আহাদ। একই দিনে তাদের বাড়ির সামনেই চলছিল সংঘর্ষ। আহাদ এ সময় বাড়িতেই ছিল, মা–বাবার পাশে। হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। তার বাবা আবুল হাসান ভাবলেন, ছেলেটা মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। কিন্তু খানিক বাদেই বুঝলেন, ছেলের ডান চোখে গুলি বিঁধেছে। রক্তাক্ত ছেলেকে হাসপাতালে নেওয়ার সময়ও বাঁধা দিল অস্ত্রধারীরা। পরে হাসপাতালে ছেলে মারা গেল।

ঘটনাগুলো কি সিনেমার মতো? টম আর জেরির কার্টুনে তোমরা যেমন দুষ্টুমিভরা মারামারি দেখো, এগুলো তা নয়। কোনো হরর ছবির দৃশ্যও নয় এগুলো। গত কয়েক দিনে আমাদের দেশে সত্যি সত্যিই ঘটেছে এসব ঘটনা। ১৬ থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে তোমাদের রক্তে লাল হয়েছে বড়দের হাত। প্রথম আলোসহ নানা সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে ঘটনাগুলোর কথা।

ঘটনাগুলো অবিশ্বাস্য লাগে, তাই না? কিন্তু এসব ঘটনা এখন বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তব।

আরও পড়ুন

২১ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে রিকশাচালক ওবায়েদুল হাসান প্রতিদিনের মতো রুটিরুজির খোঁজে পথে বেরিয়েছিলেন। তোমাদের মতোই তাঁর ১৬ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ আমিনও ছিল ক্রিকেট আর ফুটবলের পোকা। সংঘর্ষ দেখে আমিনের বাবা ওবায়েদুল হাসান যখন রিকশা নিয়ে বাড়ির পথে ফিরে আসছিলেন, সে সময় একদল মানুষ তাঁকে বলল, একজনকে হাসপাতালে নিতে হবে।

পরে সবাই মিলে যখন সেই কিশোরকে রিকশায় তুলল, ওবায়েদুল দেখলেন, সে আর কেউ নয়, তাঁরই ছেলে। আমিনের গুলি লেগেছিল নিজের বাসার সামনে। খানিক বাদেই সে মারা যায়।

৩০ জুলাই এ ঘটনার কথা জানিয়ে মোহাম্মদ আমিনের মা–বাবার জবানিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিসি বাংলা। সেখানে আমিনের মা সেলিনা বেগম কাঁদেন।

ওদিকে সিয়ামের বাবা সাকিবুর রহমানের চোখের পানিও থামে না। আর রিয়ার বাবা দীপক কুমার গোপ তো একেবারেই চুপ হয়ে গেছেন। এদিকে আহাদের বাবা আবুল হাসান আহাজারি করে বলছেন, ‘এ নিয়ে আমি আর কী বলব!’

হ্যাঁ, কারোরই বলার কোনো ভাষা নেই। প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৩১ জুলাই দুপুর পর্যন্ত ২১২ জন মানুষ মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে দেড় শ জনের মৃত্যুর বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করে পত্রিকাটি ২৯ জুলাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, তাঁদের ১১৩ জনের বয়স ত্রিশের নিচে। তাঁদের মধ্যে ১৯ জন একেবারেই শিশু বা কিশোর।

কত যে নাম তাঁদের—নাইমা সুলতানা, ইব্রাহীম, তাহমিদ ভূঁইয়া, ইমরান, সাগর...আমরা শুধু নাম পড়ি—নামের পরে নাম। নামগুলো চোখের সামনে যত ভাসে, ততই ব্যথায় কুঁকড়ে যাই। রাতে এখন ঠিকমতো ঘুম হয় না আমাদের, দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠি বারবার। ভাবি, দায় কার? এত মৃত্যু—মানুষগুলো যে মারা গেল, তোমাদের বয়সী অনেকের জীবন যে অকালে শেষ হয়ে গেল, এর কি বিচার হবে না? আসলেই হবে?

আরও পড়ুন

বিচার যদি হয়ও, তারপরও পরিবারগুলোয় যে ভয়ংকর শূন্যতা তৈরি হলো, তোমাদের মধ্যে হাহাকারের যে ঢেউ উঠল, তা আমরা কেমন করে চাপা দেব?

তোমাদের আমরা অনেক কথা বলেছি। বলেছি, মানবিক হতে হবে। কিন্তু হায়! তোমরাই আমাদের অমানবিক হতে দেখলে।

কয়েক বছর আগে সিরিয়ায় বোমা হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে নিরুপায় এক শিশু বলেছিল, ‘আল্লাহকে সব বলে দেব।’ এত এত নির্মম মৃত্যুর পর অসহায় আমরাও কি তা–ই বলব?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মীর মাহফুজুর রহমানের (মুগ্ধ) ভিডিও তোমরা হয়তো দেখেছ। টগবগে এই তরুণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পানি খাওয়াতে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘পানি লাগবে…পানি।’ তাঁরও রক্ত ঝরেছে, নিথর হয়েছে দেহ।

সবকিছু মিলিয়েই আমরা হতভম্ব। বেদনায় মুষড়ে পড়েছি। তবে এত কিছুর পরও আমরা আবার আশায় বুক বাঁধি, আশাবাদী হই তোমাদের দেখেই। কারণ, একদিন তোমরাই চালাবে এই ‘দেশ’ নামের ট্রেনটি। ‘ট্রেন’ বললেই তোমাদের মনে পড়তে পারে কবি শামসুর রাহমানের একটি ছড়ার কথা:

‘ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে

রাতদুপুরে অই

ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে

ট্রেনের বাড়ি কই?’

‘পারবে কি’ শিরোনামে এই কবির আরেকটি অসাধারণ ছড়া আছে। সেখানে তোমাদের তিনি বলছেন:

‘আকাশটাকে পালটে দিতে পারবে কি ভাই তুমি?

পারবে কি আজ করতে তাকে নীলচে কোনো ভূমি?’

আমরা পারিনি। তোমরা পারবে। তোমরাই পারবে। তোমাদের হাতেই গড়ে উঠবে নিরাপদ বাংলাদেশ। কেননা, আমাদের চেয়ে তোমরা অনেক দ্বিধাহীন, অনেক বেশি মানবিক। মানুষ তো বটেই, পশুপাখিকেও তোমরা ভালোবাসো। স্পষ্টভাবে ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বলতে পারো তোমরাই। তাই লাল–সবুজ পতাকার এই দেশকে একদিন তোমরাই বাসযোগ্য করে তুলবে, সবার জন্য নিরাপদ করে তুলবে।

তোমাদের নিরাপত্তা আমরা দিতে পারিনি। সত্যিকারভাবে বলতে পারিনি, ‘শাপলা ফুলের শীতল সবুজ পালিশে/ থাকবে খোকন ঘুমিয়ে ফুলের বালিশে।’

আমরা অনেক কিছুই পারিনি। তোমরা আমাদের ক্ষমা করো।

(কিশোর আলোর আগস্ট ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)

আরও পড়ুন