জেট স্ট্রিম : গরমের জন্য দায়ী বায়ুপ্রবাহ

ছবি: আনিস মাহমুদ

ঢাকা ও দেশের অন্যান্য প্রধান শহরের বেশির ভাগ এলাকায় গাছপালা তেমন নেই। বিল্ডিংগুলো ইট, সিমেন্ট, কাচ, ইস্পাতের মতো উপকরণ দিয়ে তৈরি। এগুলো আবার খুব গাঢ় রঙের। কালো, বাদামি আর ধূসর রং অহরহ দেখা যায়। কালো বস্তু আলোকশক্তির সব তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে তাপে রূপান্তরিত করে উত্তপ্ত হয়। বিপরীতে সাদা বস্তু আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে। আলো তাপে রূপান্তরিত হয় না। তাই রোদে সাদা বস্তুর তাপমাত্রা তেমন বাড়ে না। শহরের রাস্তা কালো। ছাদগুলো ধূসর আবরণ দেওয়া। উত্তাপের বড় অংশ আসে এসব রাস্তাঘাট ও স্থাপনা থেকে। ভবনের উপকরণ শহর এলাকায় তাপ আটকানোর আরেকটি কারণ। ভবনে বা রাস্তার বাধায় তাপ ও বৃষ্টির পানি ভূমিতে প্রবাহিত হতে পারে না। তাই পুরো পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। এখানেই গ্রামের সঙ্গে শহরের পার্থক্য। গ্রামে গাছের মাধ্যমে এলাকা ঠান্ডা হয়। বড় পুকুর, নদী, খাল-বিল, সমুদ্রের মতো জলাধার বা পানির জায়গা থাকলে তাপ কমে। কারণ, পানি সবচেয়ে ভালোভাবে তাপ ধারণ করতে পারে। মাটি ও পানি সবচেয়ে বেশি তাপ শোষণ করে নেয়।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেডক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর যৌথভাবে ঢাকা শহরের দাবদাহ নিয়ে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অন হিট ওয়েভ ইন ঢাকা’ নামে এক গবেষণা পরিচালনা করে। এতে ঢাকার ২৫টি এলাকাকে তাপদ্বীপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট এলাকার তাপমাত্রা কম। তবে কামরাঙ্গীরচর বা গাবতলী এলাকায় গরম বেশি। এর কারণ এক এলাকায় প্রচুর গাছপালা ও খোলা জায়গা আছে বলে তেমন তাপ অনুভব হয় না। কিন্তু অন্য এলাকায় গাছপালা কম থাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি।

আরও পড়ুন

গরমের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় ইদানীং দাবদাহ আর খরা বেড়ে গেছে। গড় তাপমাত্রা বাড়লে বায়ুর প্রবাহ বদলে যায়। সমুদ্রের স্রোতের পরিবর্তন হয়। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল মৌসুমি বায়ু দিয়ে প্রভাবিত হয়। এই বায়ু ভারত মহাসাগর থেকে আর্দ্র ও উষ্ণ বায়ু বয়ে আনে। আর্দ্রতা বাড়লে একই তাপমাত্রায় যে গরম লাগার কথা, তার তুলনায় বেশি গরম লাগে। গ্রীষ্মকালে বঙ্গোপসাগরে উষ্ণ পানির স্রোত এখানকার আর্দ্রতা বাড়ায় বলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়।

গরম বেড়ে যাওয়ার আরেক কারণ জেট স্ট্রিম। আমাদের দেশে সাধারণত এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। এখন সেটি ৩৭ থেকে ৪০ ডিগ্রিতেও উঠছে। জেট স্ট্রিম নামে বড় আকারের বায়ুমণ্ডলীয় মৃদু বায়ুর তরঙ্গস্রোত ভারতীয় উপমহাদেশে বয়ে চলছে। জেট স্ট্রিম বায়ুপ্রবাহের একটি সরু ব্যান্ড। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যায়। ব্যান্ডটি বাংলাদেশের ওপরে থাকায় এত গরম। এর জন্য পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দায়ী। বাংলাদেশ নিরক্ষরেখার ওপরে থাকা একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গও। এর মানে এ অঞ্চলের দেশগুলো সারা বছর উচ্চমাত্রার সৌর বিকিরণ পায়। আর্দ্রতার মাত্রা বেশি থাকা এবং অবস্থানের কারণে এখানে গরম বেশি পড়ে। একদিকে শীতল সামুদ্রিক বাতাসের অভাব, সঙ্গে পশ্চিম দিক থেকে আসা জেট স্ট্রিম মিলিত হয়ে বাংলাদেশের উচ্চ তাপমাত্রায় প্রভাব রাখে। পশ্চিম থেকে যে মৌসুমি বায়ু আসে, সেটা বেশ শুষ্ক থাকে। এর সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বায়ু এসে মিশলে, মেশার জায়গায় কালবৈশাখী হয়। প্রচণ্ড এই গরমে কালবৈশাখী না হওয়ার কারণ, কম জলীয় বাষ্প।

জেট স্ট্রিম কোনো এলাকার ওপরে স্থির হয়ে গেলে ঠান্ডা এবং শুষ্ক বায়ু ওপর থেকে নিচে নামে। ঠিক একই সময়ে ভূপৃষ্ঠের কাছের বায়ুসংকোচন বলের কারণে উষ্ণ হয়ে ওঠে। ফলে নিচের বায়ু মেঘ তৈরি করতে বাধা পায়। তরঙ্গ সরে গেলে তাপমাত্রা কমে যায়। শুষ্ক বায়ু দেশে প্রবেশ করায় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর সাগরে এ সময় সাইক্লোন তৈরি হয়। এপ্রিলে সাইক্লোনের দেখা পাওয়া যায়নি। তাই বৃষ্টি হয়নি না। তাপমাত্রাও কমেনি। সাইক্লোন রোমেল আসতে আসতে মে মাস শেষ হয়ে গেছে প্রায়। তারপর গরম কমেছে, বৃষ্টির দেখা পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন