মায়া সভ্যতার পতন হলো কেন

আধুনিক বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি পিরামিড আকৃতির কুকুলক্যান ক্যাসলকে ঘিরে দর্শনার্থীদের ভিড়। এটি প্রাক-কলম্বিয়ান সময়ের মায়া সভ্যতার একটি বড় শহর চিচেন ইৎজা-তে। প্রত্নতাত্ত্বিক এই স্থানটি মেক্সিকোর ইউকাতান রাজ্যে অবস্থিত।ছবি: রয়টার্স

মায়া সভ্যতাকে বলা হয় রহস্যময় সভ্যতা। বহু বছর ধরে সমৃদ্ধ হওয়া এই সভ্যতা একসময় পতনের মুখোমুখি হয়। চাপা পড়ে যায় মায়া সভ্যতার ইতিহাস। পরে আবিষ্কৃত হয় আবার। মায়া সভ্যতার অবস্থান ছিল মধ্য আমেরিকায়। মেক্সিকো, বেলিজ, গুয়াতেমালা, এল সালভাদর ও হন্ডুরাসের রেইনফরেস্টের মধ্যে এটি অবস্থিত। বিলুপ্ত হওয়ার আগে বহু শতাব্দী ধরে বিকাশ ঘটেছে এ সভ্যতার। শহরগুলোর ধ্বংসাবশেষ, জটিল হায়ারোগ্লিফিক লিপি আর চিরায়ত রহস্যের মধ্যে আটকা পড়েছে এ সভ্যতার গল্প। মায়া সভ্যতার উত্থানের গল্প যেমন বিস্ময়কর, তেমনি এর পতনের গল্প বিভ্রান্তিতে ঘেরা।

প্রায় ৬০০ বছর ধরে মায়ার লোকেরা ঐশ্বর্যময় সভ্যতা নিয়ে টিকে ছিল। কেউ কেউ দাবি করেন, এই প্রাচীন শহর এলিয়েনদের তৈরি। আসলে মানুষই এ শহরের কারিগর। কাঠামোগুলো বেশ আধুনিক। প্রায় ১৫০০ বছরের পুরোনো। তাই স্থাপত্যগুলোকে এলিয়েনদের কীর্তি মনে হয়। এত আগে এত আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ সত্যিই বিস্ময়কর। বর্তমানে কিছু অবকাঠামো রেইনফরেস্টের উঁচু উঁচু গাছপালার আড়ালে টিকে আছে। এ সভ্যতার রহস্যজনক পতনের কারণে অধিবাসীরা ছোট ছোট শহর আর খামার বা র‍্যাঞ্চ এলাকায় চলে গিয়েছিল, যেখানে মায়াদের বংশধরেরা আজও বাস করে।

একসময় মায়ার লোকেরা স্থাপত্য থেকে শুরু করে গণিত, শিল্প, জ্যোতির্বিদ্যা ও কৃষিতে অনেক সাফল্য অর্জন করে। সভ্যতার কেন্দ্রের শহরটি ছিল বিস্ময়কর। অসাধারণ স্থাপত্য, জটিল পাথরের পিরামিড ও মন্দির ছিল এ শহরে। বর্তমানে গুয়াতেমালায় টিকে আছে, এমন একটি অবকাঠামো হলো টিকাল মন্দির। এর উচ্চতা ২১২ ফুট। আকৃতি দেখতে পিরামিডের মতো।

মায়া সভ্যতা

প্রাচীন আমেরিকার সবচেয়ে উন্নত লেখার পদ্ধতির মধ্যে একটি পাওয়া যায় মায়া সভ্যতায়। তাদের হায়ারোগ্লিফিক লিপি ছিল। ঐতিহাসিক ঘটনা, শাসকদের ইতিহাস আর ধর্মগ্রন্থ লিখতে এই লিপি ব্যবহৃত হতো। গবেষকেরা এখনো মায়ার হায়ারোগ্লিফের পাঠোদ্ধার করছেন। এ ছাড়া মায়ার গণিতবিদেরা সংখ্যা পদ্ধতি ও গণিত বোঝার ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি করেছিলেন। মায়ারা ভিজেসিমাল (যে সংখ্যা পদ্ধতিতে ২০ সংখ্যাকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হতো। আমরা ১০ বা দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করি।) সংখ্যা পদ্ধতি তৈরি করেছিল। মায়ারা শূন্য আবিষ্কার করেছিল। ৩২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তারা এই আবিষ্কার করে। তবে ধারণা করা হয়, এই পদ্ধতিটির উদ্ভাবন তৃতীয় বা চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্ব শতক থেকে আরও পাঁচ শ-ছয় শ বছর বেশিও হতে পারে। মায়ারা স্বাধীনভাবে শূন্যের ধারণাটি বিকাশ করে, যেটি এ অঞ্চলের বাইরে অন্যান্য সংস্কৃতিতে গৃহীত হয়। কে শূন্য আবিষ্কার করেছেন, তা নিয়ে অবশ্য মতভেদ রয়েছে। কারো মতে শূন্যের উদ্ভাবক ব্রহ্মগুপ্ত, আবার কেউ কেউ বলেন আর্যভট্ট। ভারতীয়রাও শূন্য আবিষ্কার করেছিলেন।

মায়াদের শূন্য উদ্ভাবন ক্যালেন্ডার পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। তাদের বেশ কয়েকটি জটিল ক্যালেন্ডার সিস্টেম ছিল, যেগুলো রাজবংশের ইতিহাস অনুসরণ করতে ব্যবহার করা হতো। তাদের ক্যালেন্ডারকে আমাদের বর্তমানে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার থেকেও সূক্ষ্ম ও সঠিক বলেন কেউ কেউ।

মায়া ক্যালেন্ডার
ছবি: গ্লোবাল শেরপা

কৃষিতে মায়ারা ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। রেইনফরেস্ট বা জলাবনের ভূমিতে জনসংখ্যা টিকিয়ে রাখার জন্য চাষিরা সেচের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করতেন। ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করতে তাঁরা ‘স্ল্যাশ অ্যান্ড বার্ন’ কৌশল ব্যবহার করতেন। ফসল কাটার মৌসুমে উর্বর মাটি বের করার জন্য চাষ দিতেন চাষিরা। মায়ার গ্রামে ১ বর্গমাইলে ৫০০ মানুষ বাস করত। শহরে বাস করত এর দ্বিগুণ। তবে তারা চাকা বা ধাতুর ব্যবহার করত না। তাই এ সভ্যতার পিরামিড আর মন্দিরের মতো বিশাল সব অবকাঠামো দেখলে অবাক লাগতেই পারে।

শত শত বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ ও অনুসন্ধানকারীরা মায়া সভ্যতায় মুগ্ধ হয়ে আছেন। মায়া নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এমন উন্নত একটি সভ্যতার পতন হলো কেন? কেমন করেই-বা পতন হলো? এ সভ্যতার পতন হয় নবম শতাব্দীর দিকে। পতন বলতে এ সময়ের মধ্যে সভ্যতার বড় শহরগুলো পরিত্যক্ত হয়। অধিবাসীরা শহরটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। পতনের কারণগুলোর মধ্যে আছে পরিবেশগত অবনতি, খরা, যুদ্ধ ও রাজনৈতিক উত্থান। গবেষকদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে এ কারণগুলো মিলেমিশে মায়া সভ্যতার পতন ঘটিয়ে ফেলে।

মায়া সমাজে নরবলির প্রচলন ছিল। বছরে প্রায় ৫০ হাজার বলি দেওয়া হতো। তাদের অধিকাংশই ছিল মায়াদের বন্দী। সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে নবম শতকে বলির পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। প্রচুর রক্ত দিয়ে দেবতাকে তৃপ্ত করা ছিল নরবলির উদ্দেশ্য। পতনের পেছনে অত্যধিক নরবলি একটি কারণ।

মায়ার উত্থানের পেছনে যেমন কৃষির সাফল্য ছিল, ব্যর্থতার পেছনেও ভূমিকা আছে কৃষির। তীব্র খরার সময়ে কৃষিজমি তৈরির জন্য মায়ারা ব্যাপকভাবে বন উজাড় করে। খাদ্যের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়।

নবম শতকে মায়াদের রেইনফরেস্টে গাছের প্রজাতি ছড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরাগরেণু কমে যায়। এর বদলে আগাছার রেণু বাড়ে। রেইনফরেস্ট অনুর্বর হয়ে পড়ে। মাটির পরিবর্তনশীলতার কারণে তাপমাত্রা প্রায় ৬ ডিগ্রি বেড়ে যায়। মায়াদের প্রধান খাবার ছিল ভুট্টা দিয়ে বানানো রুটি। স্প্যানিশ ভাষায় যার নাম ‘ছোট কেক’। অনাবৃষ্টিতে মায়ার মাটি শুষ্ক হয়ে পড়ে। কৃষকেরা ফসল উৎপাদন করতে পারেননি। শস্যের অভাবে শহরগুলোতে খাবারের অভাব দেখা দেয়। নবম শতকের মায়াদের কঙ্কাল পরীক্ষা করে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অপুষ্টির খোঁজ পেয়েছেন।

একই সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আসে যুদ্ধ আর রাজনৈতিক অস্থিরতা। মায়া শহরগুলো একক সাম্রাজ্যের অধীন একত্র হয়নি। পৃথক রাজা দিয়ে শাসিত হওয়ায় ঘন ঘন যুদ্ধ আর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা। এতে তাদের সম্পদ যুদ্ধে ক্ষয় হতে থাকে। সামাজিকভাবে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৬ শতকে স্প্যানিশরা মায়ায় আসার আগেই সভ্যতা ব্যাপকভাবে ভেঙে পড়েছিল। স্প্যানিশ শাসনের কারণে রোগ, দাসত্ব আর সাংস্কৃতিক দমনে তারা আরও ভেঙে পড়ে। অধিবাসীরা মায়ার মায়া ছেড়ে দূরদূরান্তে চলে যায়। মায়া সভ্যতা হয়ে পড়ে ইতিহাসের গল্প।