ফ্লাইট টার্বুলেন্স কেন হয়

সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ গত ২১ মে মাঝ–আকাশে প্রতিকূল পরিস্থিতির (টার্বুলেন্স) কবলে পড়ে। এতে এই উড়োজাহাজে থাকা একজন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। জিওফ কিচেন নামের ৭৩ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিকের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাঝ-আকাশে প্রচণ্ড ঝাঁকুনির শিকার হওয়া সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটির ২২ যাত্রী মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছেন। উড়োজাহাজটি যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুর যাচ্ছিল। পরে পথ পাল্টে সেটিকে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে জরুরি অবতরণ করানো হয়।

বোয়িং ৭৭৭-৩০০ মডেলের এসকিউ-৩২১ নামের উড়োজাহাজটিতে ২১১ যাত্রী ও ১৮ ক্রু ছিলেন। যাত্রীরা বলেছেন, ঝাঁকুনির সময় উড়োজাহাজের ভেতরে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে উড়োজাহাজের ভেতরে যাত্রীরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছিটকে পড়েছিলেন। মালামালগুলোরও একই অবস্থা হয়েছে।

ফ্লাইট টার্বুলেন্স কী ও কেন ঘটে

যাঁরা উড়োজাহাজে ঘন ঘন যাতায়াত করেন, তাঁরা এই মাঝ–আকাশে হঠাৎ ঝাঁকুনির সঙ্গে পরিচিত। তোমাদের মধ্যেও অনেকের এই অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উড়োজাহাজগুলোর প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে। ঝড়বৃষ্টি, ঠান্ডা আবহাওয়া কিংবা গরম, পর্বতের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস—সব পরিস্থিতিতেই উড়োজাহাজ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে পারে। এতে উড়োজাহাজের গতিবিধি ও উচ্চতায় আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে যায়।

দ্য রয়্যাল এয়ারফোর্সের সাবেক কর্মকর্তা ও বিবিসি ওয়েদারের ব্রডকাস্টার সিমন কিং বলেছেন, অধিকাংশ টার্বুলেন্স মেঘের ভেতর ঘটে। যেখানে ওপর ও নিচ—দুই দিক থেকেই বাতাসের চাপ থাকে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাতাসের এই চাপ হালকা থাকে। তবে বড় মেঘের ক্ষেত্রে বাতাসের বিশৃঙ্খল গতিবিধি মাঝারি থেকে গুরুতর টার্বুলেন্সের সৃষ্টি করতে পারে। ‘ক্লিয়ার এয়ার টার্বুলেন্স’ বলে আরও একধরনের টার্বুলেন্স আছে, যা মেঘের উপস্থিতি ছাড়াই তৈরি হতে পারে। মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হলে উড়োজাহাজকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর মেঘমুক্ত আকাশ হওয়ায় এ ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি নিয়ে পূর্বাভাসও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এ কারণে সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে। উড়োজাহাজকে হুট করেই ঝাঁকুনির কবলে পড়তে হয়।

উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ার আগেই পাইলট যাত্রা সম্পর্কে পূর্বাভাস পেয়ে থাকেন। এর মধ্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাসও থাকে। পাইলট নিজেদের রুট পরিকল্পনা করার সময় এই তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারেন। তবে আগেই বলা হয়েছে, ‘ক্লিয়ার এয়ার টার্বুলেন্স’ এড়ানো বেশ কঠিন।

এভিয়েশন একাডেমিক ও কমার্শিয়াল পাইলট গাই গ্র্যাটন বলেন, এ ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি বায়ুপ্রবাহের (জেট স্ট্রিম) আশপাশে ঘটে। দ্রুতগতিতে প্রবাহিত বাতাসের এই স্রোত সাধারণত ৪০–৬০ হাজার ফুট উচ্চতায় পাওয়া যায়। জেট স্ট্রিমের বাতাস ও এর আশপাশের বাতাসের মধ্যে প্রতি ঘণ্টায় ১০০ মিটারের গতির পার্থক্য সহজেই করা যায়। ধীর ও দ্রুত প্রবাহিত বাতাসের মধ্যে জেট স্ট্রিমের চারপাশের ঘর্ষণ টার্বুলেন্সের সৃষ্টি করে। এটি নানা দিকে প্রবাহিত হয়, এ কারণে তা এড়ানো যায় না এবং পূর্বাভাসও করা যায় না। তবে গবেষকেরা বলছেন, সঠিক অধ্যয়ন করতে পারলে, পাখি দিতে পারে এই গুরুতর টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস।

আরও পড়ুন

টার্বুলেন্স কতটা বিপজ্জনক

যুক্তরাজ্যের ক্র্যানফিল্ড ইউনিভার্সিটির এভিয়েশন অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টে সহযোগী অধ্যাপক গ্র্যাটন বলেছেন, টার্বুলেন্স মূলত যতটা খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, তা সামাল দেওয়ার মতো করেই উড়োজাহাজগুলো তৈরি করা হয়। এ কারণে এ ঘটনায় উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত বা ধ্বংস হবে, এমন হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।

গ্র্যাটন আরও বলেন, তবে টার্বুলেন্স উড়োজাহাজের জন্য একটি বেশ অস্বস্তিকর বিষয়। তাই পাইলট এই পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং দ্রুত সিটবেল্ট বেঁধে ফেলার নির্দেশনা জারি করেন।

উড়োজাহাজটি লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুর যাচ্ছিল। পরে পথ পাল্টে সেটিকে ব্যাংককে জরুরি অবতরণ করানো হয়।
ছবি: রয়টার্স

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিকূল পরিস্থিতি জটিল হলে তা উড়োজাহাজের কাঠামোগত ক্ষতি করতে পারে। এটি নির্ভর করে বাতাস কতটা শক্তিশালী হতে পারে, তার ওপর। সিটবেল্ট না পরা যাত্রীদের জন্য এ সময়টা বিপজ্জনক হতে পারে। যেমনটা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটিতে ঘটেছিল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে উড়োজাহাজের ভেতরে যাত্রীরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছিটকে পড়েছিলেন। তবে এভিয়েশন সেফটি এক্সপার্টরা বলছেন, টার্বুলেন্সের কারণে কারও মৃত্যু কিংবা আহত হওয়ার ঘটনা বিরল।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ জন স্ট্রিকল্যান্ড বলেছেন, গুরুতর টার্বুলেন্সেও আহত হওয়ার ঘটনা তুলনামূলকভাবে বিরল। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড বলেছে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এয়ারলাইনগুলো ১৬৩টি ‘গুরুতর টার্বুলেন্সের’ কবলে পড়েছে, যা প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১২টি।

আরও পড়ুন

পাইলট যেভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন

উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ার আগেই পাইলট যাত্রা সম্পর্কে পূর্বাভাস পেয়ে থাকেন। এর মধ্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাসও থাকে। পাইলট নিজেদের রুট পরিকল্পনা করার সময় এই তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারেন। তবে আগেই বলা হয়েছে, ‘ক্লিয়ার এয়ার টার্বুলেন্স’ এড়ানো বেশ কঠিন।

প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজের ভেতরে ভেঙেচুরে গেছে।
ছবি: রয়টার্স

গ্র্যাটন বলেন, একই রুটে সামনে যাওয়া অন্য উড়োজাহাজগুলো টার্বুলেন্সের বিষয়ে রিপোর্ট করে। এ কারণে পাইলটরা ওই রুট এড়াতে চেষ্টা করেন বা এর প্রভাব কমাতে উড়োজাহাজের গতি কমিয়ে দেন। এ ছাড়া পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্রুদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

যাত্রীদের যা করতে হবে

মাঝ–আকাশে উড়োজাহাজে টার্বুলেন্স বা তীব্র ঝাঁকুনির মুখে পড়লে যাত্রীদের যথাসম্ভব শান্ত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। দ্রুত সিটবেল্ট ব্যবহার করতে হবে এবং কোনো ভারী জিনিস বাইরে রাখা যাবে না। পাইলট যাত্রীদের সব সময় সিটবেল্ট পরার পরামর্শ দেন। কারণ, টার্বুলেন্স অপ্রত্যাশিত হতে পারে।

টার্বুলেন্সের প্রবণতা বাড়ছে

কিছু গবেষক মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের টার্বুলেন্স বেড়ে যাচ্ছে। গত বছর যুক্তরাজ্যের রিডিং ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সাধারণত ব্যস্ত উত্তর আটলান্টিক রুটে ১৯৭৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে গুরুতর টার্বুলেন্স ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি তাঁরা কার্বন নির্গমন ও উষ্ণ বাতাসের কারণে উচ্চ উচ্চতায় বাতাসের গতির পরিবর্তনের কথাও উল্লেখ করেছেন।

গ্র্যাটন মনে করেন, ‘আমরা আরও বেশি টার্বুলেন্সের সম্মুখীন হচ্ছি। এর আরেকটি কারণ হতে পারে আমরা আরও বেশি যাতায়াত করছি।’

আরও পড়ুন

পাখি দেবে পূর্বাভাস

ফ্লোরিডাভিত্তিক এম্ব্রি রিডল অ্যারোনটিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টমাস গিন বলেন, ‘মাঝ-আকাশে প্রতিকূল অবস্থা নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়ার মতো অসাধারণ যন্ত্র আবহাওয়াবিদদের কাছে থাকলেও সেগুলো যথার্থ নয়।’ গবেষকেরা প্রস্তাব দিয়েছেন, টার্বুলেন্সের পূর্বাভাসের সূত্র পাখি দিতে পারে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর টার্বুলেন্স আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

এ কারণে টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস ও তা মোকাবিলার আরও ভালো উপায় খুঁজে বের করতে হবে। গবেষকেরা বলছেন, এর সমাধান মূলত প্রাণিজগতের মধ্যেই আছে।

যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে সোয়ানসি ইউনিভার্সিটির পাখি উড্ডয়ন ও বায়ুপ্রবাহবিশেষজ্ঞ এমিলি শেপার্ড বলেছেন, পাখি প্রায় সময় আকাশের অনেক উঁচুতে উঠতে পারে। তবে মাত্র কয়েক প্রজাতির পাখি বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ ওড়ার উচ্চতায় পৌঁছায়। তবে তারা নিম্ন উচ্চতায় কীভাবে ওড়ে, তা জানা গেলে আবহাওয়াবিদদের টার্বুলেন্স বিষয়ে পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য আরও ভালো মডেল তৈরি করতে সহায়তা করতে পারে। কিছু কিছু পাখি গুরুতর টার্বুলেন্স মোকাবিলা করে উড়তে পারে। তারা কীভাবে নিজেদের সুবিধার জন্য এটিকে কাজে লাগায়, তা বিশ্লেষণ করে উড়োজাহাজের নকশা করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন

২০২৪ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উড়োজাহাজগুলো প্রতিবছর ৬৮ হাজার বার মাঝারি থেকে ‘তীব্র বা তীব্রতর’ টার্বুলেন্সের সম্মুখীন হয়।

বর্তমানে উড়োজাহাজগুলো অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেমে সজ্জিত। এ কারণে পাইলট টার্বুলেন্স কিছুটা আগেই জানতে পেরে ব্যবস্থা নিতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানী পল উইলিয়ামস বলেছেন, ‘আমরা ১৮ ঘণ্টা আগেই প্রায় ৭৫ শতাংশ টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস করতে পারি।’

তবে গুরুতর টার্বুলেন্সের ক্ষেত্রে পূর্বাভাস দেওয়া যায় না, যা সম্প্রতি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

এ কারণে আবহাওয়াবিদেরা এখন কম্পিউটার মডেলিং ব্যবহার করে সব ধরনের টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস দেওয়ার আরও ভালো পদ্ধতি তৈরির কথা ভাবছেন। এর আগে এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাণীর গতিবিধি তাপ, বাতাসের দিক ও বাতাসের গতির শক্তি নির্ধারণ করতে সাহায্য করতে পারে।

এখন সোয়ানসি ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা বলছেন, তীব্র বাতাসে পাখির চলাচলের অভিজ্ঞতা টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস দিতে সাহায্য করতে পারে। কারণ, পাখিরা প্রায়ই হাজারো মাইল পাড়ি দেয়। বাতাসের গতি, দিক ও টার্বুলেন্স সবকিছু তাদের অতিক্রম করতে হয়।

প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজের ভেতরে মালামাল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছিটকে পড়ে।
ছবি: রয়টার্স

এমিলি শেপার্ড বলেছেন, ফ্রিগেট পাখি মাটি থেকে ১৩ হাজার ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় উড়তে পারে। এ কারণে তাদের প্রায় সময় টার্বুলেন্স মোকাবিলা করতে হয়। এটা তারা কীভাবে করে, তা আমরা জানি না। এটা জানলে টার্বুলেন্সের পূর্বাভাস দেওয়া অনেক সহজ হবে।

২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শেপার্ডের দল হোমিং কবুতর নিয়ে গবেষণা করেছেন। এসব পাখির সঙ্গে জিপিএস, ব্যারোমেট্রিক চাপ এবং ত্বরণ ডেটা লগার সংযুক্ত করা হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, শক্তিশালী টার্বুলেন্সের কারণে পাইলট উড়োজাহাজ অবতরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু কবুতরগুলো কোনো সমস্যা ছাড়াই গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। শেপার্ড বলেন, ‘তাই বলা যায়, কবুতর উচ্চমাত্রার টার্বুলেন্স মোকাবিলা করতে পারে। আর পাখি এমন কিছু পরিস্থিতিতে উড়তে পারে, যা উড়োজাহাজ পারে না। তাই আমাদের পাখির কাছ থেকেও কিছু বিষয় শেখার আছে।’

তথ্যসূত্র: বিবিসি ও সিএনএন

আরও পড়ুন