‘আদায় কাঁচকলায়’ কী, আদার সঙ্গে কাঁচকলার কি আসলেই শত্রুতা আছে?
বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, আদায় কাঁচকলায়। আদা আর কাঁচকলা একসঙ্গে যায় না। এর মানে কী? এর মানে এই নয় যে কাঁচকলা বা কাঁচা কলায় আদা দেওয়া যাবে না। আসলে কথাটা এসেছে দুটো বিপরীত গুণ থেকে। মানুষের যখন ডায়রিয়া হয়, তখন তারা কাঁচকলা খায়। আর যখন কোষ্ঠকাঠিন্য হয়, তখন লোকে আদা খায়। এখন তুমি যদি আদাও খাও, আবার কাঁচকলাও খাও, তোমার পাকস্থলীর খাবারগুলো কী করবে? দ্রুত নিচে নামবে, নাকি দীর্ঘক্ষণ পেটে থাকবে?
আদা আর কাঁচকলা একসঙ্গে রান্না করা সম্ভব। তবে তেল ও জল যেমন মেশে না, গুণের দিক দিয়ে আদা আর কাঁচকলাও তেমন। আদা যে কারণে খাওয়া হয়, কাঁচকলা খাওয়া চলে বিপরীত কারণে। এ ছাড়া আদা কাঁচকলার তরকারিতে দিলে কাঁচকলা সহজে সেদ্ধ হয় না। একটি অন্যটির ক্রিয়াকে অকেজো করে দেয়।
রান্নায় ব্যবহারের জন্য অনেকেই আদা একবারে পিষে বক্সে ভর্তি করে ফ্রিজে রেখে দেয়। আদা পিষে ফ্রিজে রেখে দিলে গুণাগুণ নষ্ট হয়। রান্না বা খাওয়ার আগে আগে আদা রস করে নিতে হবে; আগে থেকে ফ্রিজে জমিয়ে রাখা যাবে না। যদি সঠিক নিয়মে আদা পিষে রান্নায় ব্যবহার করা হয়, তবে ফ্রিজে নিশ্চয়ই আইসক্রিমের বাটি খুলে হতাশ হবে না কেউ। তখন আইসক্রিমের বাটিতে আইস্ক্রিমই থাকবে। আদা থাকবে না।
আদার গুণ আসলে কী কী? খাবার, পানীয়, আচার, ওষুধ ও সুগন্ধি তৈরিতে প্রচুর আদা ব্যবহার করা হয়। ইতিহাসে প্রথম যে মসলাগুলো এশিয়া থেকে ইউরোপে রপ্তানি হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল আদা। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে আদা ব্যবহার করা হতো।
আদায় আছে প্রচুর খনিজ পদার্থ। পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন এ, বি৬, ই ও সি এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট ও অ্যান্টি–ইনফ্লামেটরি এজেন্ট, কী নেই আদায়। আদায় এত গুণ থাকায় প্রবাদ আছে, ‘আদা সকল রোগ নিরাময়ে দাদা’। রোগ তো দূর করেই, মুখের রুচিও বাড়ায়। সর্দি-কাশি হলে লোকে আদা খেতে বলে। প্রবাদে মূলত আমাশয় রোগের সময় আদা খাওয়ার ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে জ্বর, বমির ভাব—সবকিছুই আদা ভালো করে। আমাশয়, জন্ডিস, পেটফাঁপায় আদা চিবিয়ে বা রস করে খাওয়া হয়। এ সমস্যায় ভুগলে এক কাপ গরম পানিতে এক চা–চামচ আদার রস মিশিয়ে খেলে ভালো হবে। আমাশয়, পেটফাঁপা ও পেটব্যথা ভালো হয় আদায়।
কাঁচকলাও আদার মতোই, গুণের শেষ নেই। দামে কম, মানে ভালো একটি সবজি। পথেঘাটে টকের সঙ্গে কাঁচকলাভর্তা জনপ্রিয়। কাঁচা কলার সঙ্গে কাঁচা মরিচ, তেঁতুল, জলপাই, ধনেপাতাসহ নানা কিছু মিশিয়ে তৈরি হয় এই ভর্তা। রান্নার সবজি হিসেবে কাঁচকলা বেশি চলে। রক্তশূন্যতার সময় চিকিৎসকেরা বেশি করে কাঁচকলা খেতে বলেন। রান্না বা ভর্তা, যেভাবেই খাওয়া হোক, কাঁচকলার খাদ্যগুণ ঠিক থাকে। দুর্বল শরীরে পুষ্টি হিসেবে কাজ করে কাঁচকলা। ১০০ গ্রাম কাঁচকলায় ক্যালরি থাকে ৮৩ গ্রাম। এতে আছে পটাশিয়াম, যা স্নায়ু ও মাংসপেশি সচল রাখতে কাজ করে। আছে আয়রন, ক্যালসিয়ামও। হাড় গঠনে আর হাড়ের সুরক্ষায় কাঁচকলা ভূমিকা রাখে।
কাঁচকলা নিয়ে প্রচলিত কথা হলো ‘কাঁচকলা দেখিয়ে দেওয়া’। কাউকে বা কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করলে বলা হয়, কাঁচকলা দেখিয়ে দিল; যেমন জার্মানিতে কোভিড-১৯–এর লকডাউনের সময় খেলোয়াড়েরা নিত্যনতুন স্টাইলে চুল কাটছিলেন। তখন জার্মান নাপিতদের সংগঠন ‘জার্মান হেয়ারড্রেসার অ্যাসোসিয়েশন’ চিঠি লিখে জবাব চেয়েছিল জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে। লকডাউনের মধ্যেও ফুটবলাররা কীভাবে চুল কাটছেন, নিত্যনতুন হেয়ারস্টাইল পাচ্ছেন, নাপিতেরা জানতে চেয়েছিলেন। এ ঘটনায় খবর বেরিয়েছিল পত্রিকায়, ‘নাপিতসমাজকে কাঁচকলা দেখিয়ে দিব্যি চুল কাটছেন ফুটবলাররা’। আদতে কোষ্ঠকাঠিন্যকে কাঁচকলা দেখাতে খেতে হয় কাঁচকলা।
আদায় কাঁচকলায় প্রবাদে কাঁচকলার যে গুণের কথা বলা হয়েছে, সেটি আসলে হজমে সহায়ক কাঁচকলা। পরিপাকতন্ত্রে গোলযোগ দেখা দিলে বহুকাল ধরে মানুষ কাঁচকলায় সমাধান খুঁজেছেন।
এভাবেই আদা আর কাঁচকলার বিপরীতমুখী গুণের কারণে এ দুটো একসঙ্গে যায় না বলে মনে করা হয়। সে জন্য প্রবাদটা এসেছে, আদায় কাঁচকলায়! তাই আমাশয়ে আদায়, কোষ্ঠকাঠিন্যে কাঁচকলায় সমাধান খোঁজা ভালো। ঠিক প্রবাদের মতো।