গারো উৎসব ওয়ানগালা

ওয়ানগালা উৎসবে গারো নৃত্যছবি: সালগিরা চিসিম

বাঙালি ছাড়াও এ দেশে বসবাস করে আরও অনেক জাতি। যারা ‘আদিবাসী’ নামেই অধিক পরিচিত। গারো তেমনই একটি জাতির নাম। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সীমান্তবর্তী বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা; সিলেটের সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার; গাজীপুরের শ্রীপুরে তাদের বসবাস। গারোরা নিজেদের ‘মান্দি’ (মানুষ) হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে।

মান্দি বা গারোদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ওয়ানগালা। সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর আগে তাদের নতুন খাদ্যশস্য খাওয়া নিষেধ। গারো ভাষায় ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেব-দেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ উৎসর্গ করা। গারোদের বিশ্বাস, দেবতা মিসি সালজংয়ের নির্দেশে সূর্য বীজ থেকে চারার অঙ্কুরোদগম ও তার পরিপক্বতা ঘটান। তাই ফসল গ্রহণের আগে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই এ উৎসবের উদ্দেশ্য।

নকমা (গ্রামপ্রধান) সভা ডেকে উৎসবের দিন ঠিক করেন। ধান পাকার পর খেতের কিছু অংশের (আ’সিরকা) ধান কাটা হয় সর্বশেষ, ধূপ উৎসর্গ করে। প্রথম দিনে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয় নতুন ধানের ভাত, নতুন ফলমূল, শাকসবজি ও পশু-পাখি। ওই দিন নকমা ঝরনা বা খাল থেকে দুটি কাঁকড়া ধরে আনেন। দুপুরের আগে একটি লাল বা সাদা মোরগ নিয়ে খেতে যান। সেখানে আ’সিরকা স্থানে সূর্যদেবতার উদ্দেশে সেটি উৎসর্গ করে পূজা-অর্চনা করেন। অতঃপর বাড়ি ফিরে ঘরের মাঝখানে কলাপাতায় নতুন ধানের ভাতসহ অন্যান্য শস্য, কৃষি যন্ত্রপাতি ও বাদ্যযন্ত্র সাজিয়ে রাখেন। দুপুরের পরই নকমার বাড়িতে শুরু হয় ওয়ানগালার প্রথম আনুষ্ঠানিকতা। এভাবে তিন দিন নানা আচারের মাধ্যমে গারোরা ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকে।

কিন্তু কেন তারা ওয়ানগালা উৎসব পালন করছে? সেটি নিয়ে গারো সমাজে প্রচলিত রয়েছে কয়েকটি কাহিনি। একটি কাহিনির ভাবার্থ এমন—

‘আদিকালের কথা। মানুষ তখন বনের আলু, কচু, গাছের ফলমূল, লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করত। ধান, ভুট্টা ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। সূর্যদেবতা ছিলেন ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের একচেটিয়া অধিকারী।

একদিন কোনো এক পথে তিনি যাচ্ছিলেন। তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এ জগতের এক লোক। তাঁর শরীর ছিল ময়লামাখা। পরনে নোংরা পোশাক। পেছনে সূর্যদেবতার মতো সুপুরুষকে পরিচ্ছন্ন পোশাকে দেখে তিনি লজ্জায় বড় এক পাথরের আড়ালে লুকালেন। দেবতা তা খেয়াল করলেন। কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলে লজ্জায় ও ভয়ে জড়সড় হয়ে লোকটি তাঁর নাম জানালেন।

নামে নামে মিল দেখে সূর্যদেবতা তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেন। গাছের ছায়ায় একসঙ্গে খাবার খেতে বসে তিনি দেখলেন, তাঁর বন্ধু খাচ্ছেন বনের আলু। তাঁর খুব মায়া হলো। তাঁকে নিজের ভাত ও সুস্বাদু মাছ-মাংসের তরকারি খেতে দিলেন। অতঃপর ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের বীজ বপন করেন কি না, জানতে চাইলে বন্ধুটি উত্তরে বলেন, ধান কী, তা তিনি জানেন না।

শুনে সূর্যদেবতার দয়া হলো। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে ধানের বীজ পাঠাব। তুমি জুমচাষ করে জুমখেতে ধান বুনবে। যখন ধান পাকবে, ঘরে তুলবে। সে সময় আমাকে স্মরণ করবে। তাহলে প্রতিবছর তোমাকে ও তোমার পরিবার-পরিজনকে আমি আশীর্বাদ করব। এ আমার প্রতিশ্রুতি।’

বাড়ি ফিরে সূর্যদেবতা তাঁর এক দাসকে দিয়ে বন্ধুর জন্য ভালো ধানের বীজ পাঠালেন। ওই দাস ছিল খুব ঈর্ষাপরায়ণ। সে বীজগুলো ভেজে নষ্ট করে পৌঁছে দিল।

বন্ধুটি জুমখেতে তা বুনলেন। দখিনা বাতাস এল। বৃষ্টিও হলো। কিন্তু বীজ থেকে কোনো চারা গজাল না। তা দেখে তিনি হতাশ হলেন। সূর্যদেবতা তাঁকে ঠকিয়েছেন ভেবে কষ্টও পেলেন। একদিন সূর্যদেবতার অন্য দাসদের পেয়ে তিনি তাদের বেঁধে রাখলেন।

দাসদের কান্নায় এলেন সূর্যদেবতা। বন্ধুর মুখে সব শুনে তিনি বললেন, ‘অন্যায় করেছে আমার আরেক দাস। তাকে শাস্তি দিচ্ছি। তুমি এদের ছেড়ে দাও। আমি পুনরায় তোমাকে সতেজ ধানের বীজ পাঠাব।’

ওয়ানগালা উৎসবে গারো নারীদের আনন্দনৃত্য
ছবি: সালগিরা চিসিম

সূর্যদেবতার অনুরোধে দাসেরা মুক্ত হলেন। তিনি তাঁর কথামতো বন্ধুর কাছে নতুন বীজ পাঠালেন। নব উদ্যমে পরিশ্রম করে বন্ধুটি জুমখেতে ধানের সেই বীজ বুনলেন। বীজ থেকে এবার ধানগাছ গজিয়ে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠল।

ধান পাকছে। কয়েক দিন পরই কাটতে হবে। এমন সময় ঘটল আরেক ঘটনা! সূর্যদেবতার কয়েকজন দাস গোপনে খেতের কিছু ধান চুরি করে। অতঃপর দেবতার কাছে তারা অভিযোগ করে বলে, ‘দেখুন, আপনাকে না দিয়েই পাকা ধানগুলো আপনার বন্ধু কেটে খেয়েছেন। আপনাকে তিনি অসম্মান করেছেন।’

দাসদের কথায় সূর্যদেবতা অপমানিত বোধ করলেন। অতঃপর বন্ধুর পুত্র ও দাসদের ধরে এনে বন্দী করে রাখলেন।

এ সংবাদ শুনে বন্ধুটি সূর্যদেবতার কাছে ছুটে আসেন। অভিযোগ শুনে তিনি অনুনয় করে বলেন, ‘এখনো আমি জুমখেতের ধান কাটিনি। তোমাকে অবজ্ঞা ও অসম্মান করে নিজে আগে খাইনি। কারা যেন কিছু পাকা ধান চুরি করে নিয়ে গেছে।’

বন্ধুর কথায় সূর্যদেবতার মন গলে। ভুল শুধরে নতুন করে তাঁরা বন্ধুত্ব গড়েন।

এরপর পাকা ফসল ওঠে। বন্ধুটি প্রথম মংরে পর্বতের (মন্দর পর্বত) চেন্দেন শিখরে সূর্যদেবতার উদ্দেশে নতুন শস্য, নতুন পানীয়, ধূপ প্রভৃতি উৎসর্গ করেন। দেবতা তখন খুশি হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেন, ‘এ ব্যক্তি ও তার বংশধরদের ভবিষ্যতেও ভালো ফসল হোক। তারা চিরকালের জন্য আশীর্বাদযুক্ত হবে। প্রতিবছর ফসল কাটার ঋতুতে আমি পৃথিবীতে ফিরব আশীর্বাদ করতে।’

এভাবে দিন দিন ওই বন্ধু আরও ধনী ও সম্পদশালী হয়ে উঠলেন। তিনি তাঁর পুত্র-কন্যাদেরও জুমচাষে উৎসাহ দিলেন।

গারোদের বিশ্বাস, যুগযুগান্তে বংশপরম্পরায় এ কারণেই নতুন ফসল তোলার পর ধূপ জ্বালিয়ে পানাহার করে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে তারা ওয়ানগালা উৎসব পালন করে আসছে।

সময়ের হাওয়ায় আজ বদলে গেছে আদিবাসীদের উৎসবগুলো। ধর্মান্তরের ফলে গারোরা আজ হারিয়ে ফেলছে ওয়ানগালা উৎসবের আদি রূপটিকে। কিন্তু আদিবাসী সংস্কৃতি ও সাহিত্যে এ উৎসব নিয়ে তাদের বিশ্বাসের কাহিনিগুলো আজও জীবন্ত হয়ে আছে।