কেউ কি মাতৃভাষা ভুলে যেতে পারে

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে একটি শিশুর গালে এঁকে দেওয়া হচ্ছে একুশের উল্কী। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বরিশাল নগর, ২১ ফেব্রুয়ারিছবি: সাইয়ান

জন্মের পর আমরা যে ভাষা শিখে বড় হই, সেটাই আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষা আমাদের পরিচয়ের একটা বড় অংশ। পরিবার, বন্ধু, সংস্কৃতি—সবকিছুর সঙ্গে ভাষার মাধ্যমে আমরা গভীরভাবে যুক্ত থাকি। কিন্তু কেউ যদি অন্য দেশে চলে যায় বা অন্য ভাষায় কথা বলতে শুরু করে, তাহলে কি সে তার মাতৃভাষা ভুলে যেতে পারে?

ভাষাবিদরা একে ‘নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাট্রিশন’ বলেন। এর মানে হলো, কেউ যদি দীর্ঘদিন তার মাতৃভাষা ব্যবহার না করে, তাহলে সে সেই ভাষায় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট শিশুরা যদি অন্য ভাষার পরিবেশে বড় হয়, তাহলে তারা সত্যিই মাতৃভাষা ভুলে যেতে পারে। তবে বড়দের ক্ষেত্রে এমন হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আমাদের মনে হতে পারে আমরা ভাষা ভুলে গেছি, কিন্তু আসলে তা আমাদের মস্তিষ্কে সংরক্ষিত থাকে।
যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক আন্তোনেলা সোরাসে

২০০৩ সালে সেরিব্রাল কর্টেক্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, অল্প বয়সে শিশুরা দেশ পরিবর্তন করলে মাতৃভাষা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ওই গবেষণাপত্রে একটা উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। কোরিয়ায় জন্ম নেওয়া কিছু শিশুকে ফ্রান্সের কয়েকটি পরিবার দত্তক নিয়েছিল। তাদের বয়স ছিল ৩-৮ বছর। কিন্তু ৩০ বছর বয়সেও ওই কোরিয়ান শিশুরা কোরিয়ান ভাষায় দক্ষ হতে পারেনি। বরং ফ্রান্সের ভাষা তারা স্পষ্টভাবে বলতে ও বুঝতে পারে। কিন্তু কেউ যদি কিশোর বা তার চেয়েও বড় বয়সে অন্য দেশে যায়, তাহলে তার ভাষা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কারণ ততদিনে সে মাতৃভাষায় ভালো দক্ষতা অর্জন করে ফেলে।

যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক লরা ডমিনগেজ বলেন, কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাতৃভাষা সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া কঠিন। তারা হয়তো অনরগল মাতৃভাষায় কথা বলতে পারবে না, কিন্তু ধীরে ধীরে পারবে। কারণ শব্দ মনে করতে তাদের দেরি হতে পারে।

গবেষণা বলছে, ৮-১৩ বছর বয়সের মেয়েদের জন্য এবং ৯-১৪ বছর বয়সের ছেলেদের জন্য ভাষা ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কম। কারণ এই বয়সের পর মস্তিষ্কের গঠন অনেকটাই স্থায়ী হয়ে যায়। তবে শব্দভান্ডার বা ভোকাবুলারি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যদি কেউ বিদেশে কিছুদিন কাটায়, তাহলে সে নিজের ভাষার কিছু শব্দ মনে করতে একটু সময় নিতে পারে। কিন্তু পুরোপুরি ভুলে যায় না। দেশে ফিরে নিয়মিত ব্যবহার করলে শব্দগুলো আবার সহজেই মনে পড়ে যায়।

আরও পড়ুন

তবে ব্যাকরণ ভুলে যাওয়া তুলনামূলক কঠিন। ২০২৩ সালে দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ লার্নিং জার্নাল-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলা ব্যক্তিরা বহু বছর ইংল্যান্ডে কাটানোর পরও স্প্যানিশ ব্যাকরণ ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে।

আবার দ্বিতীয় ভাষাও একেবারে ভুলে যাওয়া কঠিন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। কেউ যদি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখে, তাহলে তার পক্ষে ইংরেজি ভাষায় পুরোপুরি ভুলে যাওয়া কঠিন। হয়তো হঠাৎ মনে আসবে না, কিন্তু একটু চর্চা করলেই এই ভাষা আবার মনে রাখা সম্ভব। এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক আন্তোনেলা সোরাসে বলেন, ‘আমাদের মনে হতে পারে আমরা ভাষা ভুলে গেছি, কিন্তু আসলে তা আমাদের মস্তিষ্কে সংরক্ষিত থাকে।’

তবে ডিমেনশিয়া রোগ থাকলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা দুটি ভাষা জানলে, এক ভাষার সঙ্গে আরেক ভাষা গুলিয়ে ফেলতে পারে অথবা শুধু মাতৃভাষা মনে রাখতে পারে। একে বলে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ রিভার্সন’।

সুতরাং, কেউ দীর্ঘদিন মাতৃভাষা ব্যবহার না করলে কিছু শব্দ ভুলে যেতে পারে, কিন্তু ভাষাটি পুরোপুরি ভুলে যায় না। কিছুদিন নিয়মিত চর্চা করলে আবার মাতৃভাষায় কথা বলা সম্ভব। তবে একেবারে অল্প বয়সে দেশ পরিবর্তন করলে ভিন্ন কথা।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন