সাইবার অ্যাটাককে অপরাধজগতের অন্যতম বড় অপরাধ হিসেবে ধরা হয়। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সব সময় চেষ্টা করে, যেন তারা হ্যাকারদের কবলে না পড়ে। সাইবার আক্রমণ হলে যেন প্রতিহত করতে পারে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, কাজটি মোটেও সহজ নয়।
এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারের স্বাভাবিক কাজে বাধা দেওয়াই সাইবার অ্যাটাক। এটি মূলত দুই ধরনের। একটি হলো কম্পিউটার বা নেটওয়ার্ককে অচল করা। অন্যটি তথ্য হাতিয়ে নেওয়া। নানা উপায়ে এই কাজ করে হ্যাকাররা। একা বা দলবদ্ধভাবে সাইবার অ্যাটাক করা হয়। পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয়ের অধীন ভারতীয় সরকারি সংস্থা সিএসওর তথ্যমতে, ৯২ শতাংশ ম্যালওয়্যার ই-মেইলের মাধ্যমেই পাঠানো হয়।
ভাইরাস একধরনের ম্যালওয়্যার, কম্পিউটারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ডেটা এবং সফটওয়্যারের ক্ষতি করে। ট্রোজানসও একধরনের ম্যালওয়্যার, প্রোগ্রামের ছদ্মবেশ ধারণ করে এর প্রকৃত কাজ সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের বিভ্রান্ত করে। ওয়ার্মস একটি স্বতন্ত্র ম্যালওয়্যার, যা অন্য কম্পিউটারে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে। পৃথিবীর ইতিহাসে আলোচিত ১০ সাইবার অ্যাটাক নিয়ে আজকের লেখা।
১৯৮৮ সালের কথা। এক আমেরিকান শিক্ষার্থী একটি ওয়ার্ম বানিয়েছিলেন, যা পরে ভাইরাসে রূপান্তরিত হয়ে প্রায় ছয় হাজার কম্পিউটারকে আক্রান্ত করে। এর ফলে প্রায় ১০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়।
২০০০ সালে মাফিয়া বয় নামে পরিচিত ১৫ বছর বয়সী এক কানাডিয়ান উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইটের সেবার প্রকৃত ব্যবহারকারীদের বাধা দেওয়ার একটি কৌশল বা ডিস্ট্রিবিউটেড ডেনিয়াল অব সার্ভিস (ডিডিওএস) পাঠিয়ে দেয়। ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে ছিল অ্যামাজন, সিএনএন, ই-বে ও ইয়াহুর ওয়েবসাইট। এই অ্যাটাকের ফলে প্রায় ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়।
২০০৯ সালে হ্যাকাররা চায়নিজ মানবাধিকারকর্মীদের ই-মেইলের প্রবেশাধিকার পেতে গুগলের সার্ভারে আক্রমণ চালায়। এই অ্যাটাকের পেছনে চীন সরকারের হাত আছে বলে সন্দেহ করা হয়। ফলে ২০১০ সালে গুগল চীন থেকে সার্ভারগুলো হংকংয়ে নিয়ে যায়।
জোনাথন জেমস নামের ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর সফলভাবে জনসন স্পেস সেন্টারসহ নাসার কম্পিউটার সিস্টেমে হ্যাক করে। অনুপ্রবেশের সময় সে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) সম্পর্কিত অত্যন্ত সংবেদনশীল তথ্য হাতিয়ে নেয়। অসংখ্য ব্যবহারকারীর নাম ও পাসওয়ার্ড হাতিয়ে নেয়। ঘটনাটি নাসার জন্য বিব্রতকর ও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি তাদের সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থায় দুর্বলতা প্রকাশ করে।
কেভিন পসেন নামের এক লোক একবার লস অ্যাঞ্জেলেসের টেলিফোন সার্ভিস ব্লক করতে সক্ষম হন। এর কারণ ছিল, তিনি রেডিওভিত্তিক একটি প্রতিযোগিতায় গাড়ি জিততে চেয়েছিলেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তিনি অন্যদের কল ব্লক করে এবং গাড়িটি জিততে সক্ষম হন। তবে পরবর্তী সময়ে এ জন্য তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল।
ক্যালিফোর্নিয়ার তিন কিশোর সান সোলারিস অপারেটিং সিস্টেমে চলা ৫০০ সরকারি ও বেসরকারি কম্পিউটার হ্যাক করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রথমে এই সাইবার অ্যাটাকের পেছনে ইরাকিরা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করেছিল।
মেলিসা ভাইরাস এমন একধরনের ম্যালওয়্যার, যা মাইক্রোসফট ওয়ার্ড বা মাইক্রোসফট আউটলুকের সাহায্যে কম্পিউটারকে আক্রান্ত করে। ভাইরাসটি মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ডকুমেন্টকে আক্রান্ত করে ই-মেইল দিয়ে। ভাইরাসটিকে ১৯৯৯ সালের ২৬ মার্চ প্রথমবারের মতো বিভিন্ন কম্পিউটারে প্রেরণ করা হয়। ফলে বিশ্বজুড়ে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রুট সার্ভারের অ্যাটাকটি ইন্টারনেটের কার্যক্রমকে প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম জটিল একটি সাইবার অ্যাটাক। ইন্টারনেটের শীর্ষ ১৩টি সার্ভারের মধ্যে ৯টি সার্ভারকেই এই সাইবার অ্যাটাক প্রায় অচল করে দিয়েছিল। এর স্থায়িত্ব এক ঘণ্টার বেশি হলে ইন্টারনেট ব্যবহারের ট্রাফিক বেড়ে যেত। ফলে ইন্টারনেট সেবার মান ধীরগতির হতো এবং পরিণতি হতো ভয়াবহ।
২০০৯ সালে আলবার্ট গনজালেজ নামের এক ব্যক্তি ২৫০টির বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লক্ষাধিক ক্রেডিট কার্ড নম্বর চুরি করেন। এই কার্ড থেকে পরে গনজালেজ এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার ব্যয় করেন, যা এখন পর্যন্ত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কার্ড কেলেঙ্কারি।
২০১০ সালে পেপাল উইকিলিকস নামের একটি অ্যাকাউন্টকে বন্ধ করে দেয় গোপন তথ্য ফাঁস করার উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহ করার জন্য; যা ছিল পেপালের গোপনীয়তা রক্ষার নীতিমালার বাইরে। এর ফলে অনেকে পেপাল বর্জন করেন এবং হ্যাকাররা পেপালে সাইবার অ্যাটাকের পরিকল্পনা করে। ধারণা করা হয়, এর ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
স্টাক্সনেট নামে একটি ওয়ার্ম ২০১০ সালে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। স্টাক্সনেটের লক্ষ্য ছিল মূলত ইরানের ইউরেনিয়াম পরমাণু। ইরানের তখনকার উদীয়মান পারমাণবিক কার্যক্রমকে গোপনে লাইনচ্যুত করার উদ্দেশ্যেই এই ওয়ার্ম পাঠানো হয়। যার ফলে ইরানের এক হাজার ইউরেনিয়াম পরমাণুকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় দুই লাখ কম্পিউটার আক্রান্ত হয়। ইরান এই ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে দায়ী করে।