একদল বানরের তাড়া খেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে কয়েকজন উঠতি বয়সী ছেলে, তাদের অপরাধ—বানর যেমন করে হাসে, তারাও ঠিক সেভাবে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসেছিল, বাংলায় যাকে বলে ভেংচি! সেই হাসিকে বানরের নেতা খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি! ফলাফল, ঠিক নাকের সামনে দিয়েই ১০০ মিটার স্প্রিন্টের সূত্রপাত। সেই দৌড়ের ফলে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের পরিষ্কার সাজানো–গোছানো রাস্তায়ও তৈরি হলো ধুলার একটা আস্তরণ। কী অদ্ভুত! চারজন ছেলের পেছনে একটা বানর! বাকি বানরগুলো গাছের ডালে বসে বসে হাততালি দিচ্ছে! ধুলার আস্তরণটা সরে যেতেই উঁকি দিল মায়াবী এক চিত্রা হরিণের চোখ, পৃথিবীর সবকিছুকে উদাসীনতার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে সে আরাম করে মিষ্টিকুমড়া চিবাচ্ছে! একটা বানরের বাচ্চা এসে হরিণের দিকে এক হাত বাড়াল, হরিণ দয়ার সাগর, এক টুকরা কুমড়া ভেঙে বাচ্চাটাকে দিল, সেই বাচ্চা বিপুল উৎসাহ–উদ্দীপনার সঙ্গে কুমড়া ভোজনে নেমে গেল!
কক্সবাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে সেদিন সম্ভবত কুমড়া উৎসব চলছিল, যেদিকে তাকাই সবাই দেখি মিষ্টিকুমড়া খাচ্ছে, এক পাশে ভালুক, অন্য পাশে জলহস্তী। আবার কে যেন কুমিরের খাঁচাতেও অর্ধেক কুমড়া ফেলে এসেছে, কুমির সেদিকে নজরই দিল না! লামচিতা অবশ্য ব্যতিক্রম, সে কুমড়াকে বল বানিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে খেলা শুরু করে দিল।
সাফারি পার্কে গিয়েছিলাম ইয়ুথ কনজারভেশন করপসের (ওয়াইসিসি) ছেলেমেয়েদের বন্য প্রাণী সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য। আমাদের সমাজ ও দেশের জন্য বন্য প্রাণীগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কীভাবে এসব বন্য প্রাণী সংরক্ষণ করা যায়, সেসব বিষয়ে তাঁদের বিস্তারিত জানানোই ছিল এই পার্কে আসার উদ্দেশ্য। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী এই ছেলেমেয়েরা সুবিধাবঞ্চিত, কেউই পেরোতে পারেননি এসএসসি পরীক্ষার গণ্ডি, তাঁদের জীবনমুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরি বা উদ্যোগের জন্য তৈরি করাটাই ওয়াইসিসির উদ্দেশ্য। ইউএস ফরেস্টের এই ট্রেনিং প্রোগ্রামটিতে এ রকম একেকটি ব্যাচ চলবে ছয় মাস ধরে। এই প্রশিক্ষণেরই একটা অংশ ছিল ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক পরিদর্শন করা। সেখানে ঘুরে ঘুরে পেখম মেলা ময়ূর আর বিশাল ঠোঁটের ধনেশ পাখি দেখতে দেখতেই শুনি অদ্ভুত চিৎকার! কে যেন বনজঙ্গল সব এক করে চেঁচামেচি করছে! শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে জানলাম, এটা একটা বাচ্চা হাতির ডাক, এখানকার হাসপাতালে আছে সে। বাচ্চা হাতি! বলে কী! জীবনে কোনো দিন হাতির বাচ্চা দেখিনি, সারা জীবন শুধু হাতির বাচ্চার দুষ্টুমির গল্প শুনে আসা জীবনটা ধন্য করার এই সুযোগ হেলায় হারানোর কোনো মানে হয় না! বাঘ, সিংহ, হর্নবিল আর জেব্রাকে তুচ্ছ করে ঢুকে গেলাম ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের বন্য প্রাণী হাসপাতালে। কোথায় হাতির বাচ্চা! হাসপাতালে তো নেই সে, কিন্তু তার ডাকের শব্দ আসছে চারপাশ থেকে!
বের হয়ে দেখি, হালকা একটা বাঁশগাছের বেড়ার ওপাশ থেকে লেজ নাড়িয়ে শুঁড় বাগিয়ে গাছের ওপরে বসা ময়না পাখিকে ডাকছে হাতির বাচ্চাটা। পাখিটাও একটু নিচে নেমে এসে ভাব বিনিময় করল, আর যায় কোথায়! খুশির ঠেলায় বাচ্চা হাতিটা এদিক–সেদিক দৌড়াতে শুরু করল। একবার লতানো গাছের জঙ্গলে ঢুকে পড়ছে তো আবার বের হয়ে শুধু শুঁড় দেখাচ্ছে সবাইকে, সেই শুঁড়ে ঝরাপাতা পড়তেই টুক করে গুটিয়ে নিচ্ছে গর্জন গাছের আড়ালে। আবার বেরিয়ে এসে শুঁড় দিয়ে ধুলা ছিটাচ্ছে চারপাশে। এই খেলাধুলার মাঝেই বিশাল ডাক দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে কতটা আনন্দিত!
হাতিটাকে দেখভাল করতে থাকা কিউরেটর দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওর মা কোথায়? আবার হুট করে এসে মারবে না তো আমাদের! জবাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিবাসী দাদা জানালেন, এই বাচ্চার মা মারা গেছে গত মার্চ মাসে, তখনই বন বিভাগ ওকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে, এখন তার বয়স ৯ মাস। মা–হারা বাচ্চাটা এখানে এই শাল-গর্জনের বনেই ময়না-টিয়া আর বানর–হরিণ দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে! কথা শুনতে শুনতেই দেখি এক বানরের বাচ্চা এসে ওকে এক টুকরা কুমড়া সাধল, কী যত্ন করেই না কুমড়ার টুকরা নিয়ে ওপরে ছুড়ে আবার শুঁড় দিয়ে ক্যাচ ধরল হাতিটা। সেটা দেখে বানরের বাচ্চার সে কী হাততালি! একটু খেলেই আবার কুমড়ার টুকরাটা বানরের বাচ্চাকে ফেরত দিয়ে দিল সে। জিজ্ঞাসা করলাম, বাচ্চা হাতিটা কী খায় এখন? জানলাম, এখনো সে ল্যাকটোজেন ওয়ান দুধ খায়, দিনে ছয়বার। এতক্ষণ আমার চোখেমুখে যে আনন্দ আর উৎসাহ ছিল, সেটা ধক্ করে থেমে গেল! আরে এ তো দুধের বাচ্চা! এই বয়সে কোথায় মায়ের সাথে খেলবে, মায়ের থেকে অন্য জঙ্গলের গল্প শুনবে, কলাগাছ ঠেলে ফেলে দেবে, তা না, সে আটকে আছে অচিন কিছু প্রাণীর মাঝে!
মনটা প্রচণ্ড খারাপ করে বেড়ার কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলাম বাচ্চাটাকে, দূর থেকে কয়েকবার দেখল আমাদের, এরপর দাদা ডাক দিলেন, ‘যমুনা, আয়, কাছে আয়।’ আমাদের চোখ ছানাবড়া করে দিয়ে যমুনা নামের বাচ্চাটা গুটি গুটি পায়ে এসে শুঁড় দিয়ে একবার আমার বাড়ানো হাতটা শুঁকল, এরপর সেটা জড়িয়ে ধরে মুখের কাছে নিয়ে জিব দিয়ে একটু চেটে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করল! প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও পরে বুঝলাম এটা তার খেলা, হাতটা আরেকটু আরাম করে ধরার জন্য বেড়ার ওপরে পা তুলে দিল! এবার দাদা সামনে এসে বাঁশের দরজাটা খুলে দিলেন। অমনি হাত-জামা ছেড়ে দিয়ে গুটগুট করে বাইরে বেরিয়ে এল যমুনা।
হাতির বাচ্চাটার গায়ের লোমগুলো গুনা তারের মতো শক্ত, খসখসে মেটো চামড়ায় মোড়া লেজের লোমগুলো দিয়ে চাইলে দাঁত খোঁচানো সম্ভব, এত শক্ত! আর শুঁড়ের সামনের অংশটা নরম–শক্তের বিশেষ মিশ্রণ। একটু পরপর এসে আমাকে ধাক্কা মারে, ওর সঙ্গে খেলতে বলে, একবার তো পা-ই মাড়িয়ে দিল। এই গরিবের পায়ে একেবারে ‘হাতির পাড়া’। হাতির পাড়া খেয়েও বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকা জগতের একমাত্র ব্যক্তি মনে হয় আমিই! যমুনার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো ছিল অদ্ভুত ভালো লাগার, তার বারবার এসে পায়ের কাছে শুয়ে পড়া, আমার কোমরে–পেটে ধাক্কা দেওয়া, কিংবা পায়ের মধ্যে শুঁড় পেঁচিয়ে মুখের কাছে টেনে নেওয়া, কোনোটা দেখেই মনে হয়নি আমি মাটির ওপরে চরতে থাকা ধরিত্রীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণীটির ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছি! উল্টো মনে হচ্ছিল, একটা দুষ্টু বাচ্চা কিছুক্ষণ পরপর তার সঙ্গে খেলার জন্য ডাকছে, আমার সাড়া না পেয়ে যাচ্ছে অন্যদের কাছে, তারপর আবার এসে গুঁতা মারছে আমাকে!
উচ্চতায় ৩ ফুট আর ওজনে ১৫০ কেজির যমুনার সঙ্গে সাফারি পার্কে একসঙ্গে হাঁটার যে মজা, সেটা অন্য কোথাও আর পাব কি না, জানি না। দাদা জানালেন, যমুনা এখন থেকে এখানেই থাকবে, একে আর বাইরে ছাড়া হবে না। কারণ, বনে বেঁচে থাকার মতো কৌশল জানে না ও। একদিক দিয়ে হয়তো একটু ভালোই হলো, ওকে দেখার জন্য হলেও আবার আসা যাবে এখানে।
কক্সবাজার থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের এই সাফারি পার্কে প্রচুর বন্য প্রাণী রয়েছে, বিশাল আয়তনের এই সাফারি পার্কে ঘুরতে ঘুরতে পা ব্যথা হয়ে যাবে, প্রতিটি প্রাণীর জন্যই রয়েছে বিশাল জায়গা, প্রতিদিন অনেক মানুষ এই পার্কে বেড়াতে আসে। কেউ কক্সবাজারে বেড়াতে এলে একদিন এই সাফারি পার্কে বেড়িয়ে যেতে পারে, শুধু মনে রাখতে হবে যে এই পার্ক মঙ্গলবারে বন্ধ।