এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়ে যা জানা দরকার
কোভিডের সময় চীনে যেমন মাস্ক আর পিপিই পরা ছবি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, এবারও তেমনই হয়েছে। এইচএমপিভি ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে চীনসহ বেশ কিছু দেশে। বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ চীনের হাসপাতালে মাস্ক আর পিপিই পরা চিকিৎসক ও রোগীর ছবি ছড়িয়ে পড়েছে এবারও। মানুষের মধ্যে ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে, এটি বুঝি কোভিডের মতো ভয়ংকর কোনো রোগ। এই ধারণা সঠিক নয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি কোভিড-১৯ মহামারির শুরুর সময়ের মতো উদ্বেগজনক নয়। এইচএমপিভি বা হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস মানুষের মধ্যে কয়েক দশক ধরেই সংক্রামিত হয়ে আসছে। মানে এই ভাইরাসের সংক্রমণ নতুন কিছু না।
এইচএমপিভি কী?
এইচএমপিভি এমন একটি ভাইরাস, যা প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ঘটায়। এটি এত সাধারণ যে বেশিরভাগ মানুষ শিশু অবস্থায় একবার না একবার এতে আক্রান্ত হয়। সারা জীবনে একাধিকবার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। ঠান্ডা আবহাওয়ার দেশগুলোতে এটি সাধারণত ফ্লুর মতো মৌসুমি রোগ হিসেবে দেখা দেয়। আর নিরক্ষীয় অঞ্চলে বছরজুড়ে এটি কম মাত্রায় ছড়ায়।
এইচএমপিভির লক্ষণ অনেকটা রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি)-এর মতো। এতে কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ হওয়া এবং আর শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ তৈরি হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ভাইরাস সাধারণ সর্দি-কাশির মতো মৃদু উপসর্গ সৃষ্টি করে। তবে মারাত্মক সংক্রমণের ক্ষেত্রে ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়া হতে পারে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের মধ্যে এমন লক্ষণ দেখা দেয়। শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা রোগীদের জন্য এটি বেশি বিপজ্জনক হতে পারে।
উন্নত স্বাস্থ্যসেবা আছে যে দেশগুলোতে, সেখানে এইচএমপিভিতে মৃত্যুর হার খুবই কম। তবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা অনুন্নত এবং রোগ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা দুর্বল, সেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
এইচএমপিভি কতদিন ধরে মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে?
ভাইরাসটি ২০০১ সালে প্রথম চিহ্নিত হয়। তবে গবেষকরা বলছেন, এটি অন্তত ৬০ বছর ধরে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়ে আসছে। যদিও এটি নতুন নয়। তবুও ফ্লু, কোভিডের মতো অত পরিচিত না। ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের শিশু সংক্রামক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. লি হাওয়ার্ড বলেছেন, যে এইচএমপিভি নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি পরীক্ষা করা হয় না।
এইচএমপিভি কীভাবে সংক্রমিত হয়?
এই ভাইরাস মূলত কাশি ও হাঁচির সময় নিঃসৃত কণা এবং সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ছড়ায়। এছাড়া দূষিত জায়গাকে স্পর্শ করলেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। সর্দি-কাশি, ফ্লু ও কোভিড যেভাবে ছড়ায়, এটিও তেমনি করেই ছড়ায়।
এইচএমপিভির কোনো ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা আছে?
এইচএমপিভির কোনো ভ্যাকসিন নেই। তবে আরএসভির ভ্যাকসিন রয়েছে। গবেষণায় এমন একটি ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চলছে যা একই সঙ্গে দুইটি ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দেবে। এইচএমপিভির জন্য কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই। সাধারণত উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়।
এই ভাইরাস নিয়ে চীন কী বলছে?
চীনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এইচএমপিভির সংক্রমণ বাড়ছে। তবে এটি নতুন কোনো ভাইরাস নয় এবং বড় কোনো উদ্বেগের বিষয় এতে নেই। কোভিড-১৯ ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন ভাইরাস, যার বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি।
গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এক সংবাদ সম্মেলনে সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক কান বিয়াও বলেছেন, ১৪ বছর বা তার কম বয়সী শিশুদের মধ্যে এইচএমপিভির সংক্রমণ বাড়ছে। বিশেষত উত্তর চীনে সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেছেন, জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে লুনার নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে ভ্রমণ ও বড় সমাবেশের কারণে সংক্রমণ বাড়তে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে গত বছরের তুলনায় এ বছর সংক্রমণের মাত্রা কম হতে পারে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে এইচএমপিভির সংক্রমণ বেড়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়েছে যখন অনেক অভিভাবক অনলাইনে এর সমাধান খুঁজেছেন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাস নিয়ে পরামর্শ খুঁজেছেন।
চীনের সিনহুয়া সংবাদ সংস্থা সাধারণ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে নিয়মিত হাত ধুতে হবে এবং ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন?
অনলাইনে অনেকেই এইচএমপিভি সম্পর্কে শুনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পত্রিকার হোমপেজে এই ভাইরাস নিয়ে প্রচুর সংবাদ দেখা যাচ্ছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এমনই দেখা গেছে। তবে গবেষকদের মত, এটি নতুন কোনো ভাইরাস নয়। কেউ কেউ মজা করে এটিকে করোনাভাইরাসের সঙ্গেও তুলনা করছেন। তবে এটি করোনাভাইরাসের মতো গুরুতর কিছু নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) যা বলছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এইচএমপিভি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। সংস্থার মুখপাত্র ডা. মার্গারেট হ্যারিস জানিয়েছেন, চীন থেকে প্রাপ্ত সাপ্তাহিক রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সময়ে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বৃদ্ধি স্বাভাবিক।
ডব্লিউএইচও এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘এখন পর্যন্ত কোনো অস্বাভাবিক প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া যায়নি। চীনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে।’
তবে এত চিন্তা কেন
পত্রিকার মাতায় মাস্ক, পিপিই পরা ছবি দেখে চীনের বর্তমান পরিস্থিতিকে অনেকটা কোভিড-১৯ মহামারির শুরুর সময়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সে সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের কাছ থেকে বারবার তথ্য চেয়ে আহ্বান জানিয়েছিল।
তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কোভিড ছিল একটি নতুন ভাইরাস, যা আগে কখনো মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি। এইচএমপিভি নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভালো ধারণা রয়েছে। এটির পরীক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে।
তাই এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আর সাধারণ মৌসুমি সর্দি-কাশি হলেই ভাবার প্রয়োজন নেই যে তোমার এইচএমপিভি হয়েছে।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস