মনে করো, এক রাতে তুমি ঘুমাতে গেলে। ঘুমানোর আগে ক্যালেন্ডারে চোখ রেখে তারিখ দেখলে ৪ অক্টোবর। খুব ভালো একটা ঘুম দিয়ে সকালে ওঠার পর হাই তুলতে তুলতে যখন পত্রিকার পাতায় তাকালে, তখনই তোমার মাথায় হাত! পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘তারিখ: ১৫ অক্টোবর’। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? তাহলে কি তুমি টাইম ট্রাভেলের সাক্ষী হলে? নাকি এক ঘুমেই পার করে দিয়েছ দশ দিন?
ভুতুড়ে শোনালেও ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাসের ক্যালেন্ডারটির দিকে ভালোমতো লক্ষ করলে ঠিক এমনই এক ঘটনার দেখা পাওয়া যায়। তবে এটা কোনো ভূতের গল্প কিংবা অলৌকিক ঘটনা নয়। সাধারণত বছরের সব কটি মাস ৩০ কিংবা ৩১ দিনে হলেও ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাসে ছিল সব মিলিয়ে ২১ দিন। কিন্তু কেন? কোথায় হারাল বাকি ১০ দিন?
আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এখন যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে থাকি, তা হলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। কিন্তু এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বয়স কিন্তু খুব বেশি নয়। এর আগে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে আরেকটি ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হতো।
সেই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। এই ছয় ঘণ্টা সময়কে আলাদা করে জমিয়ে চার বছর পরপর একটি অতিরিক্ত দিন হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসে যোগ করা হয়, যাকে আমরা লিপইয়ার বলে চিনি। কিন্তু তোমরা অনেকেই নিশ্চয়ই জানো, সূর্যকে একবার আবর্তন করতে পৃথিবীর কিন্তু পুরোপুরি ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টার প্রয়োজন হয় না, বরং প্রয়োজন হয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। তার মানে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার প্রতিবছর প্রায় ১১ মিনিট বেশি গণনা করে আসছিল। আর এখানেই বাধে মূল ঝামেলা।
বছরের অতিরিক্ত এই ১১ মিনিট সাময়িকভাবে কোনো সমস্যার সৃষ্টি না করলেও, বিস্তরভাবে দেখলে এর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা যায়। বছরের অতিরিক্ত এই সময় জমতে থাকার কারণে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার প্রতি ৩১৪ বছরে এক দিন করে পেছাতে থাকে। আর তাতে করে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়ে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা। খ্রিষ্টানরা তাদের ইস্টার সানডে পালন করে থাকে মূলত বসন্ত বিষুবের ঠিক পরই যে রাতে পূর্ণিমা হয়, তারপরের প্রথম রবিবার। বসন্ত বিষুব বলতে বোঝানো হয়েছে সে সময়কে, যখন পৃথিবীতে রাত ও দিনের দৈর্ঘ্য সমান হয়। আর উত্তর মেরুর ক্ষেত্রে সেটি হয়ে থাকে প্রতিবছরের ২১ মার্চ।
পঞ্চদশ শতকে এসে দেখা যায়, বছরের পর বছর ধরে জমতে থাকা অতিরিক্ত সেই ১১ মিনিটের কারণে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ইতিমধ্যে প্রায় ১০ দিন পিছিয়ে গেছে। ফলে বিপাকে পড়ে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা। তাদের পক্ষে ঠিক সময়মতো ইস্টার সানডে পালন করা আর সম্ভব হচ্ছিল না। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে ১৫৬২-৬৩ সময়কালে ‘দ্য কাউন্সিল অব ট্রেন্ট’ পুরোনো ক্যালেন্ডার সংশোধন করে নতুন সংস্করণ বের করার আদেশ জারি করে। কিন্তু এত দিন ধরে ব্যবহার করে আসা ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করা তো চারটিখানি কথা নয়। ফলে এই সংশোধনের পেছনে চলে যায় আরও প্রায় দুই দশক। সব শেষে ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরি-XIII-এর হাত ধরে তৈরি হয় সংশোধিত নতুন ক্যালেন্ডার, যা আমাদের কাছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। আর সেই সংশোধিত ক্যালেন্ডারেই পোপ গ্রেগরি অক্টোবর মাস থেকে অতিরিক্ত ১০ দিনকে মুছে ফেলেন। আর এভাবেই হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে গোটা ১০টি দিন!
এখন তোমাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে এত মাস থাকতে অক্টোবরই কেন? এর কারণ হচ্ছে, সে সময় অন্য মাসগুলোর তুলনায় অক্টোবরে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ তেমন কোনো উৎসব ছিল না। আর এর জন্যই ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাস থেকে ১০ দিন মুছে দিয়ে ৪ অক্টোবরের পর সরাসরি ১৫ অক্টোবর থেকে নতুন ক্যালেন্ডারের দিন গণনা শুরু হয়।
বছরের পর বছর অদ্ভুত এই ক্যালেন্ডার তেমন কারও নজরে না এলেও গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের শেষ দিকে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশ আলোড়নের সৃষ্টি হয়। আর এই কৌতূহল থেকেই জানা যায় হারিয়ে যাওয়া রহস্যময় সেই ১০ দিনের গল্প।