স্বপ্ন হয় সত্যি
পাখির ওড়ার দৃশ্য দেখে ছবি এঁকেছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। এঁকেছিলেন উড়োজাহাজের নকশা। ভেবেছিলেন মানুষ পাখির মতো উড়বে। ঘুরবে। তাঁর কল্পনা একদিন সত্যে পরিণত হলো। আমরা উড়ছি। ঘুরছি। কত কিছু করছি। জয় করছি সৌরজগৎ। বিশ্বজগৎ। আরও কত কিছু জয় করতে হবে আমাদের। আরও কত রহস্য রয়ে গেছে। আমরা এভাবে রহস্য ভেদ করব। এগিয়ে যাব। এগিয়ে যাব অনেক দূর।
আসলে জন্মের পর থেকেই আমরা এগিয়ে চলেছি। এখন আমরা শিক্ষার্থী। বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী। আমরা আছি স্বপ্নের পথে। স্বপ্ন জয়ের পথে। এখন আছি একটি সিঁড়িতে। এই সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে যেতে হয়। আমরা এগিয়ে যাব।
মনে পড়ে? বছরের শুরু হয়েছিল নতুন বই পেয়ে। দিনটাকে খুব রঙিন মনে হয়েছিল। মধুর মনে হয়েছিল। স্বপ্নের মতো লেগেছিল সবকিছু। শ্রেণিকক্ষটিকে নতুন মনে হয়েছিল। অপূর্ব লেগেছিল নিজের স্কুলকে। স্যার-ম্যাডামদের নতুন মনে হয়েছিল। সবকিছু যেন নতুন নতুন। সতেজ সতেজ। রঙিন রঙিন। আলোময় আলোময়। আমাদের মনে যেন দোল খাচ্ছিল সবুজ পৃথিবী। স্বপ্নের পৃথিবী। আমরা যেন পেয়ে গেছে নতুন ঠিকানা।
বছর শেষ হতে চলল। আবার উঁকি দিচ্ছে নতুন বছর। তার আগে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে একটি দেয়াল। সেই দেয়াল যেন বলছে, ‘হে শিক্ষার্থী, এসো আমাকে টপকাও। আমাকে পেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে উঠি। আপ্লুত হয়ে উঠি। তোমরা যখন নাচতে নাচতে আমাকে টপকে যাও, আমিও যেন নেচে নেচে উঠি। তোমাদের হাসিতে আমিও হেসে উঠি।’
দেয়ালের নাম বার্ষিক পরীক্ষা
আমরা মূলত শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে পরীক্ষার্থীও। দুনিয়া আমাদের শিক্ষাক্ষেত্র। সুনির্মল বসু বলেছিলেন:
‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর
সবার আমি ছাত্র,
নানানভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।’
শিখতে শিখতে আমরা বড় হচ্ছি। বড় হতে হতে আমরা শিখছি। অবশ্য আমরা যা কিছু করব, সব আনন্দের সঙ্গেই করব। মজা খুঁজে নেব সব কাজে। পাঠ্যবই পড়ার কাজেও। পাঠ্যবই-ই তো আমাদের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যায়। সিঁড়ি পার করিয়ে দেয়। তাই না?
তাই তো পড়তে পড়তে পড়তে—লিখতে লিখতে—শিখতে শিখতে—আঁকতে আঁকতে—আরও কত কিছুর সঙ্গে পরিচিত হতে হতে আজ পরীক্ষার দরজায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। কদিন পরেই নিজেকে মেলে ধরব পরীক্ষার টেবিলে। যা শিখেছি, যা পড়েছি তা জানান দিতে তৈরি আছি নিশ্চয়ই আমরা। রোমাঞ্চিতও হচ্ছি—নতুন ক্লাসে উঠব বলে। এই তো, আর মাত্র কটা দিন।
পরীক্ষাও একটি রোমাঞ্চের নাম হতে পারে
পরীক্ষার ভয়ে অনেকেই কাবু হয়ে যায়। অনেকের ঘাড়ে চেপে বসে পরীক্ষার ভূত। পরীক্ষার নাম শুনলে কেমন লাগে? কেউ কেউ বলে, কেমন লাগবে আবার। এমন তো না, যা আমরা জীবনে দেখিনি, শুনিনি এমন কিছু আমাদের সামনে চোখ রাঙাবে। সিলেবাস তো আছেই। সিলেবাসের ভেতর থেকেই তো প্রশ্ন আসবে। আমরা উত্তর লিখব। এমন ভালো করে লিখব, মূল্যায়নকারী শিক্ষক উত্তর লেখার ধরন দেখে খুশি হয়ে উঠবেন। পরীক্ষক ভাববেন, ‘বাহ্ চমত্কার লেখা তো। এমন লেখাই তো চাই।’ এমন দৃশ্য কল্পনা করতে করতে বেশ রোমাঞ্চিত লাগে। নিজের ভেতরে একরকম পুলক জেগে ওঠে। যারা কম পড়েছি, সময়মতো সবকিছু করিনি—তারা? হ্যাঁ, তারা অবশ্যই তাদের সেরাটাই উপস্থাপন করবে। ব্যস, হয়ে গেল। আসলে, আমরা সবাই প্রথম হব না। সবার সেরাও সবাই হব না। হওয়া দরকারও নেই। আমরা পৃথিবীতে একেকজন একেক কাজে দক্ষ হব। সবার একই কাজে দক্ষ হওয়ার দরকার নেই। চিকিৎসক, প্রকৌশলীও সবার হওয়ার দরকার নেই। সবাই হবেও না। তবে ‘আমি আমার মতো হব, আমার পছন্দের মতো হব, আমরা সেরাটাই হব, আমার কাজে আমি রোমাঞ্চিত হব।’—এই বোধটুকু থাকলেই চলে।
চাপ আছে, চাপ নেই
পরীক্ষার নাম শুনে কি চাপ লাগছে? কারও কারও লাগতেও পারে। কারও কারও না–ও লাগতে পারে। আচ্ছা, পরীক্ষার হলে গিয়ে কেমন লাগবে, সেটা এখন ভেবে তো কোনো লাভ নেই। যা হওয়ার তা-ই হবে। অহেতুক মাথায় চাপ নেওয়ার কোনো মানে হয় না। তোমরা কী বলো? আমার সঙ্গে কি তোমরা একমত? অতএব, কোনো চাপ একদমই মাথায় আনব না। হালকা মাথাকে ভারী করে তুলব না, যাতে মাথা তুলতে কষ্ট হয়। গরম করে তুলব না, যাতে উত্তাপে ঠান্ডা জিনিসও নষ্ট হয়ে যায়। আরও অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করছে। থাক, অত কথা বলার দরকার নেই। তোমরা বুঝে নিয়েছ নিশ্চয়ই। ঠিক আছে?
ভাবব স্বাস্থ্যের কথা
‘পাখা ছাড়লে ঠান্ডা লাগে। না ছাড়লে গরম লাগে।’ ‘এসি ছাড়লে বেশি ঠান্ডা লাগে। না ছাড়লে গরম লাগে।’ এ রকম সময় এখন চলছে। তার মানে ঋতু বদলে যাচ্ছে। তার মানে আমাদেরও একটু সাবধান থাকতে হচ্ছে। সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে থাকলেই আমরা আসলে ভালো থাকি। ভালো থাকে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ‘শরীর’। আমাদের মন। ‘সুস্থ দেহে, সুস্থ মন’—কথাটা তো আমরা সবাই জানি। তাই না? সারা জীবন সুস্থ থাকার কোনো বিকল্প নেই। দেখেছ, কেউ কেউ অল্প বয়সেই বেশি অসুস্থ হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ ৭৫ বছর বয়সেও কেমন সুস্থ থাকেন। কর্মক্ষম থাকেন। উদ্যম হারান না। আমরা পুষ্টিকর খাবার খাব। পরিমিত ঘুমাব। সারা রাত জেগে জেগে পড়ে পরের সারা দিন ঘুমে ঢুলুঢুলু থাকার কোনো মানে নেই। আমরা নিশ্চয়ই রুটিন করে পড়ে এসেছি। ‘শিক্ষার্থীদের রুটিন করেই পড়া উচিত’—এ রকম কথা তো আমরা জানি এবং মানি। ২৪ ঘণ্টাকে রুটিনে ভাগ করে নিলে স্বাস্থ্যের দিকটাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কি, ঠিক আছে?
সব বিষয়ের গুরুত্ব সমান
কোনো বিষয় কারও কাছে সহজ মনে হতে পারে। কোনো বিষয় কারও কাছে কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু কোনো বিষয়ের গুরুত্ব কোনোটার চেয়ে মোটেও কম নয়। গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে দিতে অনেক সময় বাংলা, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়গুলোর প্রতি একটু কম সময় দেয় অনেক শিক্ষার্থী। এতে দেখা যায়, কম সময় দেওয়া বিষয়গুলো ভালো করা যায় না। কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এতে পিছিয়ে থাকতে হয়। অতএব, সব বিষয়েই গুরুত্ব দিতে হবে প্রায় সমানভাবে।
বলে রাখি, পড়াশোনার কঠিন কঠিন কথা শোনানো আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। ‘পড়ো পড়ো পড়ো’ কথাগুলো বারবার শুনতে ভালোও লাগে না। আমারও ভালো লাগত না। কেউ যদি আমাকে বলত ‘পড়ো’, আমি মনে মনে বলতাম, ‘পড়তে বলতে হবে কেন? আমার পড়া আমিই পড়ব। আমাকেই তো পড়তে হবে। আমাকেই তো পরীক্ষার খাতায় লিখে আসতে হবে। আমার দায়িত্ব তো দুনিয়ার কেউ নেবে না। আমি দেবও না। অতএব, আমার কাজ আমাকেই করতে দাও বাপু। এত বকবক দরকার নেই।’ তোমাদেরও কি তা–ই মনে হয়?
আরেকটু বলি, গণিতে কাউকে কাউকে দেখেছি, প্রশ্ন বাছাই করতে খানিকটা ভুল করে ফেলে। যেমন, যেসব প্রশ্নের সমাধান করতে কম সময় লাগে, ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম—সে প্রশ্নেরই সমাধান করতে বাছাই করা উচিত। তা না হলে কাটাকাটি করতে করতে সময় নষ্ট হয়ে যাবে এবং সময়টা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। সম্পূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তখন কঠিন হয়ে পড়ে। কখনো কখনো সম্ভবও হয় না। অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য বলে মনে হয়।
বসব যখন পরীক্ষার হলে
এত দিন তো আমরা পাঠ্যবইগুলো পড়ে এসেছি। সব জানা, শেখা, অভিজ্ঞতা পরীক্ষার নির্ধারিত সময়টাতেই কাজে লাগাতে হয়। পরীক্ষার হলে স্বাভাবিক থাকা খুবই জরুরি। যা-ই হোক, পরীক্ষা যেমনই হোক, যে প্রশ্নই আসুক, আমি সব পারব—এই ভাবনাতেই থাকতে হবে। অনেক সময় ‘কমন’ না পড়লেও নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রাসঙ্গিক উত্তর দেওয়া যায়। তবে কোনো অবস্থাতেই অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক, বিদঘুটে, অলীক কথামালা সাজিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না। তা থেকে এক শ হাত দূরে থাকতে হবে।
ধরো, একটা সম্পাদ্যের চিত্র আঁকতে হচ্ছে। পেনসিল কম্পাসের সাহায্যে সূক্ষ্ম মাথার পেনসিল ব্যবহার করেই যথাযথ চিত্র আঁকতে হবে। ভোঁতা পেনসিল দিয়ে আঁকলে চিত্র তো কখনো ভালো হতে পারে না।
বিজ্ঞানে চিত্রে? হ্যাঁ, বিজ্ঞানের চিত্রের ক্ষেত্রে ‘অসম্ভব সুন্দর’ হওয়ার চেয়ে ‘যথাসম্ভব শুদ্ধ’ হওয়া বেশি জরুরি। কারণ, চিত্র আঁকতে খুব বেশি সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই।
প্রশ্ন পড়ব, উত্তর দেব
অনেক সময় প্রশ্ন সম্পূর্ণ না পড়ে, অর্ধেক পড়ে অথবা একটু দেখেই উত্তর লেখার প্রবণতা দেখা যায় কারও কারও ক্ষেত্রে। কিন্তু এ রকম কাজ থেকে দূরে থাকলে নিশ্চয়ই খুব ভালো হবে, এটা কি আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? অনেক লম্বা ব্যাখ্যা করতে হবে? এ রকম করলে নিশ্চয়ই তোমরা আমার কলম থামাতে চাইবে। আমারও ভালো লাগবে না।
শুধু একটা কথাই বলি, প্রশ্ন ভেঙে ভেঙে, মনোযোগসহকারে পড়ে মাথায় গেঁথে নিয়ে উত্তর লেখা আরম্ভ করা দরকার। এটাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি: নতুন পাঠক্রম, মূল্যায়ন উত্সব
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী, মানে নতুন কারিকুলামের শিক্ষার্থী। পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণের ক্ষেত্রে তাদের জন্য রয়েছে বাত্সরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন উত্সব। তাদের জন্যও ‘বাত্সরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন নির্দেশনা’ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা রয়েছে। বলা হয়েছে, তাদের ‘পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার এবং নির্ধারিতসংখ্যক বিষয়ে পারদর্শিতার সমন্বিত ফলাফল বিবেচনা করা হবে।’
শেষ কথা
ভেবেছিলাম, তেমন কিছুই বলব না। তবু বলতে বলতে কত কথাই তো বলে ফেললাম। আবার ‘শেষ কথা’ শিরোনাম দিয়েও কথা বলা! না, আর কত কথা বলা যায়! ছোটবেলায় শুনেছি ‘কথা কম, কাজ বেশি’—এটাই হোক শেষ কথা। না, আরও একটু বলি, সবার জন্য শুভকামনা, সবাই সুন্দর থাকো। পরীক্ষার ভয় তাড়াও। ভালো থাকো। আলোকিত হও।