ইদানীং দেশে বেশ শীত পড়েছে, এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও শীতের প্রকোপ ভয়াবহ। গত ছয় বা সাত বছরে এতটা শীত পড়েনি। সাধারণত ঢাকায় শীতকালটা হালকা জ্যাকেট বা সোয়েটার পরে কাটিয়ে দেওয়া যায়। এ বছরের চিত্রটাও শুরুর দিকে তেমনই ছিল। অনেকেই আক্ষেপ করে বলেছেন, শীতের সময় শীত পড়বে না, এটা কেমন কথা? শীতের দিনে কোথায় লেপ–কম্বল জড়িয়ে ঘুমাবে মানুষ, তা না করে চালাচ্ছে ফ্যান! তোমরাও নিশ্চয় ভেবেছিলে, কবে পরবে শীতের পোশাক? শীতের ছুটিতে বেড়াতে যাবে। কথায় আছে, মামার বাড়ি, রসের হাঁড়ি। শীত না পড়লে খেজুরের রসটাই–বা আসবে কোথা থেকে! মানুষের আক্ষেপ দেখেই হয়তো রূপ বদলে গেছে শীতের। প্রচণ্ড ঠান্ডা এখন। কম্বলের নিচ থেকে বের হওয়াটাই কঠিন। তারপরও বের হতে হয়, করতে হয় পড়াশোনা ও দৈনন্দিন কাজকর্ম। ভারী ভারী শীতের পোশাক জড়িয়েও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। এ রকম পরিস্থিতিতে তোমার মনে হতেই পারে, বিদেশের মতো বাংলাদেশেও কি তুষারপাত হবে নাকি? বাংলাদেশে কি তুষারপাত বা বরফ পড়া সম্ভব? চলো, জানা যাক।
দেশে তুষারপাতের সম্ভাবনা কতটুকু, সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে জানতে হবে, তুষারপাত জিনিসটা কী? তোমরা সবাই জানো, সূর্যের তাপে সাগর, নদী, খাল-বিল বা পুকুরের পানি বাষ্পীভূত হয়ে ওপরে উঠে যায়। পানি বাষ্পীভূত হয়ে ওপরে ওঠারও একটি কারণ আছে। সাধারণত যে বস্তু তুলনামূলক হালকা, সেটি ওপরের দিকে উঠতে চায়। জলীয় বাষ্প বাতাসের চেয়ে হালকা। তাই ওপরে উঠে যায় জলীয় বাষ্প। যত ওপরের দিকে যাওয়া যায়, তাপমাত্রাও তত কমতে থাকে। অবশ্য, ওপরে ওঠারও একটা সীমা আছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১ কিলোমিটার ওপরে যাওয়ার পর বাতাসে জলীয় বাষ্পের ধারণক্ষমতা কমে যায়। এই অঞ্চলকে বলে ক্ষুব্ধমণ্ডল। সেখানকার বায়ুতে থাকে প্রচুর ধূলিকণা। জলীয় বাষ্পের সঙ্গে ধূলিকণা মিশে তা ভারী হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা আরও কমলে তুষারপাতে পরিণত হয়। তাই বাতাসের তুলনায় তুষারপাত আরও ভারী হয়ে যায়। বাতাস আর ওগুলোকে ধরে রাখতে পারে না। তুষারকণা ঝরে পড়ে ভূপৃষ্ঠে।
এ পর্যন্ত পড়ার পরে তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন জেগেছে, তুষারকণা যদি আকাশ থেকেই ঝরে পড়ে, তাহলে বাংলাদেশ কী দোষ করল? আমাদের দেশেও পড়ত একটু বরফ। ছুঁয়ে দেখতাম হাত দিয়ে, কেমন মজা। কিন্তু তা হওয়ার জো নেই। আচ্ছা, বরফের কণাগুলো কি বোঝে, কোনটা সাইবেরিয়া আর কোনটা বাংলাদেশ? তা না হলে প্রতিবছর সাইবেরিয়ায় তুষারপাত হলেও বাংলাদেশে কেন হয় না? এর পেছনে আছে একটুখানি বিজ্ঞান। চলো, সে রহস্য উন্মোচন করা যাক।
আসলে আকাশে যখন তুষারকণা তৈরি হয়, তখন সেগুলো সব জায়গায় সমানভাবেই পড়ে। কিন্তু কোন অঞ্চলে তুষারপাত হবে আর কোন অঞ্চলে হবে না, তা নির্ভর করে তাপমাত্রার ওপর। মূলত তুষারপাত হওয়ার জন্য যেকোনো দেশের তাপমাত্রা নামতে হবে হিমাঙ্কের নিচে। অর্থাৎ শূন্য ডিগ্রির নিচে থাকতে হবে তাপমাত্রা। বাংলাদেশের তাপমাত্রা কষ্মিনকালেও হিমাঙ্কের নিচে নামেনি। দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২০১৮ সালে তেঁতুলিয়ায়, ২.৬ ডিগ্রি। যেহেতু দেশের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে নামে না, তাই তুষারপাত বা বরফও পড়ে না।
কিন্তু তাপমাত্রার সঙ্গে বরফ পড়ার সম্পর্ক কী? আগেই বলেছি, ভূপৃষ্ঠের সব জায়গায় সমানভাবে তুষারকণা পড়ে। এরপর যে দেশে তাপমাত্রা কম (যেমন সাইবেরিয়া), সে দেশে তুষারকণা বরফ আকারেই থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাভাবিক তাপমাত্রা যেহেতু ২০ ডিগ্রির ওপরে, তাই তুষারকণা গলে পানিতে পরিণত হয়। ফলে তুষারপাতের পরিবর্তে বাংলাদেশে হয় বৃষ্টি। মূলত তুষারকণা ও বৃষ্টিকণা একই। কোনোটা বরফ আকারে পড়ে আর কোনোটা পড়ে পানি আকারে। বাংলাদেশে তুষারপাত না হলেও শিলা বৃষ্টি হয় মাঝেমধ্যেই।
আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শেষ করি। বাংলাদেশে কি কখনো তুষারপাত হয়েছিল বা ভবিষ্যতে কি দেশে তুষারপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর আগে দিই। স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো দিন তুষারপাত হয়নি। হওয়া সম্ভবও নয়। কারণ, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ওই ২.৬ ডিগ্রি। এখানে একটা বিষয় নিশ্চয় খেয়াল করেছ। বারবার স্বাধীন দেশের কথা বলছি। এর একটা কারণ আছে। পৃথিবীতে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার বছর আগে ছিল বরফযুগ। তখন সম্পূর্ণ পৃথিবীই নিমজ্জিত ছিল বরফে। তখন বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডও নিশ্চিতভাবে বরফে ঢাকা ছিল।
আর বাকি থাকল, ভবিষ্যতে দেশে বরফ পড়ার সম্ভাবনা কতটুকু? একটা ব্যাপার নিশ্চিত, শূন্য ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা নামলেই তুষারপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ুর যে অবস্থা, তাতে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে দেশের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নামবে না। গবেষকদের মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ পঞ্চগড়ের দিকে তুষারপাত হলেও হতে পারে। তবে সাইবেরিয়ার মতো ভারী তুষারপাত নয়।