আলপনা জিনিসটা কী?
একটা বিন্দু যখন চলতে শুরু করে, সেটা একটা রেখায় রূপ নেয়। রেখার সঙ্গে রং যুক্ত হয়ে রঙিন হয়ে ওঠা রেখাচিত্রই আলপনা বলা যায়। আলপনা সাধারণত মেঝের ওপরই করা হয়। বাসাবাড়ি, অফিস, রাস্তা, ফুটপাত—নানা জায়গায় আলপনা আঁকা হয়। বাড়ির উঠান বা আঙিনায়, বিয়ে বা গায়েহলুদের পিঁড়িতে, সরা, পটসহ নানা অনুষ্ঠানে আলপনা আঁকার প্রচলন আছে। সেই ধারায় এখন বিশেষ উত্সব যেমন পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিভিন্ন মোটিফ, এমনকি জামাকাপড়, বিশেষ করে পাঞ্জাবি, শাড়ি ইত্যাদিতেও আলপনার ব্যবহার চোখে পড়ে।
তুমিও চাইলে সহজে আঁকতে পারো রঙিন আলপনা। কল্পনা না করে রং আর ব্রাশ নিয়ে নেমে পড়ি চলো। এসো, ধাপে ধাপে দেখি আলপনা আঁকতে কতটুকু কল্পনা আর কী কী সরঞ্জাম লাগে, সেটা জেনে নিই...
আলপনার যত সরঞ্জাম: আলপনা আঁকার জন্য লাগবে রং, ব্রাশ, পানি, চকপেনসিল, পুরোনো কাপড়ের ন্যাকড়া ইত্যাদি।
প্রথমেই আসি ব্রাশ বা হগ হেয়ার প্রসঙ্গে
আলপনা আঁকার জন্য প্রথমেই যে জিনিসটি প্রয়োজন, সেটা হলো ব্রাশ। সাধারণ রঙের ব্রাশ দিয়েই আলপনা আঁকা যায়। তবে চিকন লাইনের জন্য হগ হেয়ার ব্রাশ খুব জনপ্রিয়। যদিও আমাদের এখানে এটা হকিয়ার নামে দোকানিরা বলে থাকেন। সাইজভেদে ১৮ থেকে ২৪ নম্বর যেকোনো একটা নিতে পারো। তারপর ১০ থেকে ১৪ নম্বরে একটা আর তুলি নিতে পারো কিছু ইচ্ছেমতো ছোট–বড় মিলিয়ে। আর বড় স্ট্রোকে বড় আলপনা করতে চাইলে ২/৩/৪ ইঞ্চি সাইজের সাধারণ ব্রাশ নিতে পারো। কিছু ব্রাশ নিয়ে আরও একটু বিস্তারিত জেনে নিই।
রাউন্ড ব্রাশ: সূক্ষ্ম কাজ বা রেখা এবং ছোট কাজের জন্য উপযোগী।
ব্রাইট ব্রাশ: ফ্ল্যাট ব্রাশের মতো কিন্তু ছোট ব্রিসলযুক্ত, যা দ্রুত রং প্রয়োগ ও এলাকা কভার করার জন্য ভালো।
ফ্ল্যাট ব্রাশ: বড় এলাকা কাভার করার জন্য আদর্শ, গাঢ় স্ট্রোক তৈরি করা এবং রং মিশ্রণের জন্য উপযুক্ত। যেটা সাধারণ ব্রাশ বললাম।
লাইনার ব্রাশ: অক্ষর লেখার এবং নিখুঁত রেখার জন্য পাতলা ও সূচালো ব্রাশ।
অ্যাঙ্গুলার ব্রাশ: ঢালু টিপ, যা কোণে রং প্রয়োগ, বাঁকা স্ট্রোক তৈরি এবং নির্দিষ্ট এলাকা ভরাট করতে সাহায্য করে।
রিগার ব্রাশ: সরু, লম্বা ব্রিসল, যা সূক্ষ্ম রেখা, ডিটেইল কাজ এবং অক্ষর লেখার জন্য ব্যবহার করা হয়।
স্পটার ব্রাশ: ছোট, গোলাকার ব্রাশ, ছোট এবং নিখুঁত এলাকায় রং প্রয়োগের জন্য ব্যবহৃত হয়।
আলপনার যত রং
গ্রামবাংলায় সাধারণত ভেজা সাদা চালের গুঁড়া, সিঁদুরের লাল ও হলুদগুঁড়া দিয়ে আলপনা আঁকা হতো। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে মূলত নারীরাই নিপুণ হাতে আলপনা আঁকতেন, এখনো অনেকেই আঁকেন। এসব রং তৈরি করার ঝক্কিঝামেলা এখন নেই বললেই চলে। এখন নানা পদের, নানা মিডিয়ার প্রচুর রং বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। প্লাস্টিক, ডিসটেম্পার, অ্যাক্রিলিক, এনামেলসহ বিভিন্ন ধরনের পাউডার রং। যা পানিতে মিশিয়ে তরল রং বানিয়ে অনায়াসেই আঁকা যায় আলপনা।
আলপনা আঁকার জন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হলো প্লাস্টিক পেইন্ট। এই রং ওয়াটার মিডিয়াম হওয়ায় সহজে শুধু প্রয়োজন পরিমাণ পানি মিশিয়ে নিলেই হয়। দারুণ উজ্জ্বল রং আলপনার সারফেসকে চমত্কার ফুটিয়ে তোলে। তুমি চাইলে প্রাথমিক রঙের ১ লিটারের কৌটা কিনে সেগুলো দিয়ে মিশ্রণ তেরি করে আরও অনেক রং বানিয়ে নিতে পারো। ধরো তিনটা রং কিনলে—লাল, হলুদ, নীল। যেটাকে আমরা প্রাথমিক রং বলে থাকি। আর এই তিনটা রঙের মিশ্রণে তৈরি করে নিতে পারো আরও তিনটা রং। যেটাকে আমার বলি মাধ্যমিক রং। যেভাবে তৈরি করা যায়: লাল + নীলের মিশ্রণে হয়= বেগুনি রং, নীল + হলুদ= সবুজ এবং লাল + হলুদ= কমলা!
একটা দরকারি তথ্য: হলুদ বা উজ্জ্বল কোনো রং দিয়ে ভরাট কোনো আলপনা আঁকতে হলে আগে সেখানে সাদা রং দিয়ে ভরাট করতে হবে। সেটা শুকিয়ে গেলে সেই রঙের ওপর উজ্জ্বল রং দিয়ে আবার আঁকতে হবে। তাহলে রং উজ্জ্বল দেখাবে। যদি নিচে সাদা রঙের প্রলেপ না দেওয়া হয়, তাহলে উজ্জ্বল রংও ফ্যাকাশে দেখাবে!
পাউডার রং: বাজারে বিভিন্ন রকমের পাউডার রং পাওয়া যায়। যেমন লাল পাউডার রেড অক্সাইড, ব্লু, ইয়েলোসহ অনেক রকমের। এসব পাউডারের সঙ্গে আইকা গামসহ পানিতে মিশিয়ে রং বানানো যায়। সেসব রং বিশেষ করে দেয়ালে আঁকার জন্য চমত্কার মিডিয়াম হিসেবে কাজ করে।
রঙের মিশ্রণ: রঙে পানির পরিমাণ খেয়াল করে দিতে হবে। আলপনার রং একবারে তৈরির পরও কাজের সময় যদি মনে হয় ঠিকঠাক ব্রাশ স্ট্রোক চলছে না, তখন অল্প পরিমাণ পানি দিতে হবে। এটা আঁকার মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে একটু একটু পানি দিলে ব্রাশ স্মুথলি চলতে সাহায্য করে। তরে অতিরিক্ত পানি রং পাতলা এবং আলপনার শেপ ছড়িয়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আরও একটি বিষয়। পানির জন্য দুইটা বোল বা ছোট বালতি রাখতে হবে। কোনো ব্যবহার করা ব্রাশ ধোয়ার জন্য একটা আর রঙে পানি মেশাতে হলে আরেকটা। ব্রাশ ধোয়ারটা ময়লা পানি হয়ে যাবে। ব্রাশ ধোয়ার পর সেটা আবার পরিষ্কার পানিতে না ধুলে আগের থেকে যাওয়া রং মিক্স হয়ে পচা রং তৈরি হয়ে যাবে। তাই এটাও খেয়াল রাখতে হবে।
এবার আঁকার পালা
সবকিছু জোগাড় করার পর এবার আলপনা আঁঁকার পালা। কী আঁকব, কীভাবে আঁকব—এসব বেশি ভেবে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। প্রথমে নিজের একটা খাতা আর পেনসিল নিয়ে জ্যামিতির কম্পাস ব্যবহার করে নানা রকম খসড়া করে নাও। বিষয়বস্তু হিসেবে আলপনায় আঁকা হয় পদ্ম, ধানের গুচ্ছ, বৃত্তায়িত রেখা, সূর্য, মাছ, পান, শৃঙ্খলতা ইত্যাদি। এ রকম বা যেকোনো ফোক মোটিফ দিয়ে শুরু করতে পারো। খসড়া হয়ে গেলে চকপেনসিল দিয়ে বাড়ির উঠান বা ফ্লোরে ড্রয়িং করে নাও। মনে রাখবে, এটা কোনো পরীক্ষার কাজ নয় আর তুমি বড় কোনো শিল্পীও নও। তাই ভুল হলে বা ঠিকঠাক না হলে হতাশ হওয়া যাবে না। করতে করতে একসময় সুন্দর আঁকার হাত চলে আসবে। ওই যে বলে না—প্র্যাকটিস মেকস পারফেক্ট, সে রকমই ব্যাপারটা। একবার রাফ ড্রয়িং হয়ে গেলে সেই চকের দাগের ওপর রং দিয়ে আঁকা শুরু করবে। কোথাও ভুল হলে দ্রুত পুরোনো কাপড়ের টুকরা দিয়ে মুছে নিতে পারো। সম্ভব হলে একটা ব্রাশে একটা রং ব্যবহার করবে। তাহলে রং মিশে একাকার হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। প্রথমে সাদা রং দিয়ে সব লাইন ড্রয়িং করে নেবে। তারপর ভরাটগুলোও সাদা রঙে একটা প্রলেপ দিতে হবে। প্লাস্টিক পেইন্ট দ্রুত শুকায়, তাই একটার পর একটা কাজ করে যেতে পারো। যখন যে ব্রাশ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে, তখন সেটা পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। না হলে খুব দ্রুত ব্রাশ শুকিয়ে শক্ত হয়ে রং জমাট বেঁধে যাবে। তখন ওই ব্রাশ আর কাজে আসবে না।
সবশেষে আলপনা আঁকা হয়ে গেলে চারপাশে চেয়ার বা টুল দিয়ে ব্লক করে দিতে পারো। কেউ যাতে ভুল করে আলপনার ওপর হেঁটে চলে যেতে না পারে। ওহ্ আরেকটা কথা, নববর্ষ উপলক্ষে তোমার আঁকা আলপনার ছবি তুলে আমাদের পাঠিয়ে দিতে পারে। বাছাই করা আলপনা ছাপা হবে কিআর পাতায়। তাহলে দেরি কেন, এখনই প্রস্তুতি নাও। শুভ নববর্ষ সবাইকে।