বিলুপ্তির মুখে উত্তরের সাদা গন্ডার, তবে এখনো আশা ফুরিয়ে যায়নি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে নর্দান হোয়াইট রাইনো বা উত্তরের সাদা গন্ডার বিলুপ্তির মুখে। কারণ, ইতিমধ্যে মারা গেছে এই প্রজাতির গন্ডারের শেষ পুরুষ সদস্য ‘সুদান’। তবে টিকে আছে এই প্রজাতির শেষ দুই নারী সদস্য। নাজিন ও ফাতু। একজন মা, আরেকজন মেয়ে। নাজিন ও ফাতু সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম নয়। এমন অবস্থায় এই প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। কাছাকাছি প্রজাতির গন্ডার-সাউদার্ন হোয়াইট রাইনো বা দক্ষিণের সাদা গন্ডারের গর্ভে সফলভাবে ভ্রূণ স্থানান্তর করা হয়েছে। বিরল প্রজাতির উত্তরের সাদা গন্ডারকে বাঁচাতে এই কৌশল ব্যবহার করার পথে সাফল্য পাবেন বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। ধারণা করা হচ্ছে, এই পদ্ধতিতে উত্তরের সাদা গন্ডার বিলুপ্তির মুখ থেকে ফিরে আসবে।
উত্তরের সাদা গন্ডারের শেষ পুরুষ সদস্য সুদান মারা যায় ২০১৮ সালে। তখন মনে করা হয়েছিল, আর আশা নেই। শুধু দুই নারী সদস্য দিয়ে এই গন্ডারকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। কারণ, দুই নারী গন্ডার বন্ধ্যা বা সন্তান জন্মদানে অক্ষম। তবে নাজিন ও ফাতুকে বাঁচিয়ে রাখতে কেনিয়ায় সশস্ত্র রক্ষীদের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা পাহারায় রাখা হচ্ছে। গন্ডারের শিং শিকারিদের মূল লক্ষ্য। গন্ডারের শিং এদের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।
বায়োরেসকিউর গবেষকদের একটি আন্তর্জাতিক দল জার্মান সরকারের সহায়তায় গন্ডার রক্ষায় কাজ করে। তাঁদের লক্ষ্য উত্তরের সাদা গন্ডারকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো। এ জন্য এই গবেষক দল দক্ষিণের সাদা গন্ডারের গর্ভে প্রথম ভ্রূণ সফলভাবে স্থানান্তর করেছেন। এই কৌশল উত্তরের সাদা গন্ডারের ওপরে ব্যবহারের পথ খুলে দিয়েছে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিজ্ঞানীরা কেনিয়ার ওল পেজেটা সংরক্ষণশালায় দুটি দক্ষিণের সাদা গন্ডারের ভ্রূণকে সারোগেট মায়ের গর্ভে স্থানান্তর করেন। এতে একটি সফল গর্ভাবস্থা তৈরি হয়। সাধারণভাবে মানুষ, ঘোড়া এবং গরুতে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হলেও কখনো গন্ডারে ব্যবহার করা হয়নি।
ভ্রূণের বয়স যখন ৭০ দিন, তখন একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ভ্রূণের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হয়ে বাবা এবং গর্ভবতী মা দক্ষিণের সাদা গন্ডার দুটো মারা যায়। তবে গবেষকেরা বলেছেন, এই গর্ভাবস্থা প্রমাণ করে, এই কৌশল কাজ করতে পারে।
বায়োরেসকিউ প্রকল্পের প্রধান থমাস হিলডেব্র্যান্ড গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘এই ছোট্ট শিশু সবকিছুর প্রমাণ। শুক্রাণু ইনজেকশন, নিষিক্তকরণ, তরল নাইট্রোজেন, এসব গন্ডারের জন্য আগে কখনো করা হয়নি। সবই ব্যর্থ হতে পারত।’ মানুষের ওজনের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা আড়াই টন ওজনের স্তন্যপায়ী প্রাণী নিয়ে কাজ করছি।’
এ বছরের মে বা জুনের মধ্যে বিজ্ঞানীরা প্রথম উত্তরের সাদা গন্ডারের ভ্রূণ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছেন। ভ্রূণ নেওয়া হবে মৃত পুরুষ গন্ডারের শুক্রাণু এবং ফাতু থেকে সংগ্রহ করা ডিম্বাণু থেকে। কেনিয়ার একটি সাউদার্ন সাদা গন্ডারের গর্ভে এই ভ্রূণ স্থাপন করা হবে। বর্তমানে উত্তরের সাদা গন্ডারের মাত্র ৩০টি ভ্রূণ অবশিষ্ট আছে। জার্মানির বার্লিন এবং ইতালির ক্রেমোনায় মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনে এই ভ্রূণ সংরক্ষণ করা হয়েছে।
যদি ১৬ মাসের গর্ভধারণ সফল হয়, তবে এটি হবে ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জন্ম নেওয়া প্রথম উত্তরের সাদা গন্ডার। এর মাধ্যমে সুমাত্রান গন্ডার সংরক্ষণের পথও প্রশস্ত হবে। বন্য অবস্থায় এই গন্ডার টিকে আছে মাত্র ৪০টি।
গবেষকেরা বলেছেন, প্রথম গর্ভাবস্থা ভালোভাবে চলছে বলে মনে হলে আরও ভ্রূণ স্থানান্তর করা হবে। অল্প সময়ের মধ্যে ছয়টি উত্তরের সাদা গন্ডারের বাছুর জন্ম নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। কারণটি বেশ চমকপ্রদ। এই বাছুরদের নাজিন ও ফাতুর সঙ্গে দেখা হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এদের কাছ থেকে উত্তরের সাদা গন্ডারের মতো আচরণ কীভাবে করতে হয়, তা শিখে নিতে পারবে।
অবশ্য বেশ কয়েকটি উত্তরের সাদা গন্ডার বাছুর জন্ম হলেও ভবিষ্যতে একটি কার্যকর গন্ডারের জনসংখ্যা তৈরির জন্য জিনগতভাবে যথেষ্ট বৈচিত্র্যময় হবে না। কারণ, ৩০টি টিকে থাকা উত্তরের সাদা গন্ডারের ভ্রূণ সবগুলোই ফাতুর ডিম্বাণু এবং দুটি পুরুষের শুক্রাণু থেকে তৈরি করা।
ভবিষ্যতের বংশধরদের জিনগত বৈচিত্র্যের উন্নতির জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহারের পরিকল্পনাও করেছেন গবেষকেরা। এ ছাড়া জাদুঘরের নমুনা থেকেও জেনেটিক উপাদান নেওয়া হবে।
গত বছর ঘোষণা করা হয়েছিল দক্ষিণের সাদা গন্ডারের সংখ্যা ২০১২ সালের পর প্রথমবারের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের শেষে ১৫ হাজার ৯৪২ থেকে বেড়ে ১৬ হাজার ৮০৩ হয়েছে। তবে এই প্রজাতিও দীর্ঘদিন টিকে থাকার বিষয়ে দুশ্চিন্তা রয়ে গেছে। এবার অপেক্ষার পালা। উত্তরের সাদা গন্ডারকে আবারও ফিরিয়ে আনা যায় কি না।
সূত্র: গার্ডিয়ান ও বিবিসি