১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন
যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে ১১ তলা বাড়ির ৮ তলায় মা–বাবার সঙ্গে থাকত চার বছরের ছোট্ট আহাদ। একই দিনে তাদের বাড়ির সামনেই চলছিল সংঘর্ষ। আহাদ এ সময় বাড়িতেই ছিল, মা–বাবার পাশে। হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। তার বাবা আবুল হাসান ভাবলেন, ছেলেটা মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। কিন্তু খানিক বাদেই বুঝলেন, ছেলের ডান চোখে গুলি বিঁধেছে। রক্তাক্ত ছেলেকে হাসপাতালে নেওয়ার সময়ও বাধা দিল অস্ত্রধারীরা। পরে হাসপাতালে মারা গেল ছেলে।
ঢাকার মিরপুরের কাফরুল এলাকার চারদিকে গত ১৯ জুলাই, শুক্রবার ছিল মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। বিকট শব্দে আকাশে উড়ছিল হেলিকপ্টার। কাঁদানে গ্যাসের শেলের ধোঁয়াও ঢুকছিল ঘরে। নিরাপত্তার জন্য এ সময় জানালা বন্ধ করা ছাড়া উপায় কী! সিয়াম তাই জানালা বন্ধ করতে গিয়েছিল। এমন সময় বাইরে থেকে গুলি এসে তার মাথায় লাগে। জানালার পাশে সিয়ামের পড়ার টেবিলে থাকা বইপত্র আর প্লাস্টিকের খেলনা রক্তে ভেসে যায়…!
ঢাকায় যখন এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে, সেদিনই বাবার নিরাপদ কোলে থাকার পরও মারা যায় সাড়ে ছয় বছর বয়সী শিশু রিয়া গোপ। রিয়ারা থাকত নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকার চারতলা একটি বাড়ির একেবারে ওপরের তলায়। সেদিন রিয়া আপনমনে ছাদে খেলছিল। এর মধ্যে হঠাৎই ওদের এলাকায় শুরু হলো সংঘর্ষ। মেয়েকে ঘরে আনতে ছাদে গেলেন তাঁর বাবা দীপক কুমার গোপ। রিয়াকে মাত্রই কোলে নিয়েছেন, এ সময় কোথা থেকে ছুটে এল ঘাতক বুলেট। বাবার কোলে ঢলে পড়ল মেয়েটি।
এমন শত শত ঘটনা ঘটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সহিংসতায় মারা যায় অসংখ্য মানুষ। ১ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। অহিংস এই আন্দোলনে নজিরবিহীন আক্রমণ চালায় তৎকালীন সরকার ও তার অঙ্গসংগঠন। সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সর্বস্তরের মানুষ। ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।
জুলাই ১৩, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টা
স্থানীয় সময় শনিবার সন্ধ্যায় পেনসিলভানিয়ার বাটলার এলাকায় এক নির্বাচনী সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন ট্রাম্প। তখনই তাঁর ওপর বন্দুকধারীর হামলার ঘটনা ঘটে। পাশের একটি ভবনের ছাদ থেকে গুলি চালান ক্রুকস নামের এক তরুণ। হামলার পর ট্রাম্পের একটি কান থেকে রক্ত ঝরতে দেখা যায়। এ সময় গুলিতে নিহত হন সমাবেশে অংশ নেওয়া এক ব্যক্তি। গুরুতর আহত হন দুজন।
পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের তালিকা থেকে জানা যায়, ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টিরই এক নিবন্ধিত ভোটার ছিলেন ক্রুকস। এরপর ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন ট্রাম্প। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে ভূমিধস জয় পান তিনি।
এই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হতেন ক্রুকস। হামলা চালানোর সময় তাঁর হাতে এআর-১৫ আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ছিল বলে মার্কিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
১৪ জুলাই,আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা জয়
একদিকে যখন চলছে টি-২০ বিশ্বকাপ, তখন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রান্তে বসেছিল কোপা আমেরিকার ৪৮তম আসর। এবারের আসর যৌথভাবে আয়োজন করেছিল কনমেবল ও কনক্যাকাফ। ফলে অংশগ্রহণ ছিল দুই আমেরিকার ৩২ দলের। ৩২ দলের লড়াইয়ে সবাইকে পেছনে ফেলে শিরোপা নিজেদের করে নিয়েছে আর্জেন্টিনা। তিন বছর ধরে ফর্মের তুঙ্গে থাকা আর্জেন্টিনা এবার শিরোপা জিতেছে কোনো ম্যাচ না হেরেই। ফাইনালে কলম্বিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতে নেয় আলবিসেলেস্তারা। এ নিয়ে ১৬তম বারের মতো কোপা আমেরিকা জিতল আর্জেন্টিনা।
জুলাই ২১, সরে দাঁড়ালেন বাইডেন
যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনের রানিং মেট ছিলেন কমলা হ্যারিস। রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে নিয়ম অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট হন কমলা।
পরের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন বাইডেন। কমলা তাঁকেই সমর্থন দেন। কিন্তু প্রথম সরাসরি টেলিভিশন বিতর্কে ট্রাম্পের কাছে ব্যর্থতার পর চাপের মুখে গত জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন বাইডেন। আর নিজ দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কমলার নাম প্রস্তাব করেন তিনি। সেই হিসাবে মাত্র চার মাস প্রচারণার সময় পেয়েছেন কমলা। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আর কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর এত কম সময় প্রচারণা করার নজির নেই। অবশ্য তিনি নির্বাচনে হেরে যান ট্রাম্পের কাছে। ২০২৫ সালের ১০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ট্রাম্প।
জুলাই ২৬, অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রথমবারের মতো আউটডোরে
গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিককে বলা হয় ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। আকর্ষণীয় ও বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে উদ্বোধন হয় এই অলিম্পিকের। অলিম্পিকে ২০০টির বেশি দলের প্রতিনিধিত্ব থাকে বলে বহু বৈচিত্র্যের উপস্থিতি যেমন থাকে, থাকে দৃষ্টিনন্দন আর চমকে ভরা দারুণ সব আয়োজনও।
প্যারিসের বুকে অবস্থিত সিন নদীতে হয়েছে এবারের অনুষ্ঠান। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান স্টেডিয়ামের ভেতরই হয়ে এসেছে এত দিন। এই প্রথমবার স্টেডিয়ামের বাইরে উন্মুক্ত স্থানে হয়েছে উদ্বোধনী আয়োজন। স্টেডিয়ামে অ্যাথলেটরা প্যারেড করতেন, এবার তাঁরা সিন নদী পাড়ি দিয়েছেন। প্রায় ১০০টি নৌকা ও বার্জে করে আইফেল টাওয়ারের পূর্ব কোণের অস্টারলিটজ সেতু থেকে ট্রোকাড রোতে পৌঁছান তাঁরা। সেখানেই হয় মূল আয়োজন। বক্তব্য দেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ।
ফ্রান্সের থিয়েটার ডিরেক্টর থমাস জলির পরিকল্পনায় পুরো অনুষ্ঠান মোট ১২টি ভাগে ভাগ করা হয়। এতে অংশ নেন তিন হাজারের মতো নৃত্যশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও বিনোদনকর্মী। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা সিন নদীর দুই তীরে, সেতুতে ও কাছাকাছি স্মৃতিস্তম্ভগুলোয় ছিলেন। নটর ডেম ক্যাথেড্রালও ছিল এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অংশ।
১৯ আগস্ট, ফেনীতে বন্যা
১৯ থেকে ২২ আগস্ট—এই ৪ দিনে শুধু ফেনীতে ৪৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। একই সময়ে কুমিল্লায় বৃষ্টি হয়েছে ৫৫৭ মিলিমিটার, নোয়াখালীতে হয়েছে ৬০৫ মিলিমিটার বৃষ্টি, যা স্বাভাবিক বৃষ্টির তুলনায় অনেক বেশি। একই সময়ে ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলায় ৩৭৫ মিলিমিটার, গোমতী জেলায় প্রায় ৩৫০ মিলিমিটার এবং আগরতলা ও এডিনগরে ১৮০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আগস্ট মাসের স্বাভাবিক বৃষ্টির তুলনায় এই বৃষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি।
ফেনী ও কুমিল্লায় ভয়াবহ বন্যাসহ ত্রিপুরা রাজ্যসংলগ্ন মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়িতে বন্যা মূলত ত্রিপুরা থেকে আসা অতিমাত্রার পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে একটানা অতিবৃষ্টির কারণে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
একই সঙ্গে ১৯ আগস্ট পূর্ণিমা তিথি হওয়ায় সাগরে সৃষ্টি হয়েছে অতিমাত্রার উঁচু জোয়ার, যা নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের বন্যার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং উজানের জেলাগুলোর বন্যার পানি সাগরে নেমে যেতে বিলম্ব হয়েছে।
আগস্ট মাসের শেষে দেশের ১১টি জেলার ৭৪টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল। দেশের ১১টি জেলায় বন্যায় ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৫৯ জনের মারা যাওয়ার তথ্য জানিয়েছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১১টি জেলার ৬৮টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। জেলাগুলো হলো ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল ৩ হাজার ৯২৮টি। এগুলোয় ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৫ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৩৬ হাজারের বেশি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
অক্সফামের তথ্য অনুযায়ী, এই বন্যায় বাস্তুচ্যুত হয় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবকাঠামো, বাড়িঘর, কৃষি ও মৎস্য খাত। এসব ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দুর্গত জনগোষ্ঠীর জরুরি ও ধারাবাহিক মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। সারা দেশ থেকে মানুষ এসব বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষদের সাহায্য করতে আসে।