মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে চিল আর চড়ুইয়ের গল্প
নিরাপদে বাসা বাঁধার জন্য পাখিদের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হলো ভালো জাদুঘর। চড়ুই পাখি হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। জাদুঘরের কোনো কার্নিশে ভালো জায়গা পাওয়া গেলে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, ছয় ঋতুই আরাম করে কাটিয়ে দেওয়া যায়।
আমি টুনি। আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেই আমার বাসা । ঠিক করে বললে, জাদুঘরের সামনে দোতলায় ছাদ থেকে ঝোলানো হকার হান্টার নামে এক বিমানের ডানায়। আমি আর আমার সঙ্গী টোনা এখানে বাসা বেঁধেছি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বেড়াতে গেলে আমার বাসাটাই সবার আগে দেখতে পাবে তুমি। বিমানের ডানার পাশে এসে আমাকে ডাকতে পারো। ব্যস্ততা না থাকলে দেখাও হয়ে যেতে পারে তোমার সঙ্গে।
এই হকার হান্টারটা ১৯৫১ সাল থেকে ব্যবহার করত ভারতীয় বিমানবাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হলে এই বিমানটা দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। চারটি মিসাইল, চারটি ৩০ মিলিমিটার গান আর তিনটি রকেট ছিল এই বিমানের সমরাস্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূমিতে আক্রমণ এবং আকাশ প্রতিরক্ষায় সফলভাবে উড়েছিল হকার হান্টার। নিচ থেকে দেখলে মনে হবে আকাশে ডানা মেলেছে বিশাল আকৃতির কোনো পাখি। এর দৈর্ঘ্য ৪৬ ফুট। এই জাদুঘরে হেলিকপ্টারও রাখা আছে। মুক্তিযুদ্ধে এটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
তোমাকে তো বাসার কথা বলেছি। আমাদের এক প্রতিবেশী আছে। আমাদের বাসার ঠিক ওপরে বেরিয়ে আছে জাদুঘর ভবনের কয়েকটি বিম। জায়গাটা বেশ উঁচুতে। ওখানেই বসে থাকে প্রতিবেশী। দূর থেকে দেখলে তাকে ইগল পাখি ভাবতেই পারো, আসলে সে একটা চিল। সোনালি ডানার চিল।
প্রথম যেদিন তাকে দেখি, পিলে চমকে গিয়েছিল আমার। আকারে আমার বহুগুণ বড়। ডানা মেললে আকাশ ঢেকে যায়। পরিচিত হওয়ার পর অবশ্য বুঝলাম, চিল মামা বেশ চিল, মনটা নরম। তাকে মামাই ডাকি আমি।
চিল মামার মূল আগ্রহ ইতিহাসে। ওই খাম্বার ওপর বসে থাকার কারণ এটাই। বিশাল আকারের হওয়ায় উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে জাদুঘরের ভেতরে দেখতে পায় না মামা। ভেতরে ঢুকলে মানুষ ভয় পায়। লেগে যায় হুড়োহুড়ি। তাই আমার ওপর ভরসা করে আছে সে। আমি খুব ছোটখাটো হওয়ায় বেশ কয়েকবার জাদুঘরের ভেতরটা ঘুরে ঘুরে দেখেছি। আজ যেমন নিজের কথাই বলল চিল মামা। সে আগে ছিল শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে। আমার মতো আরেক চড়ুইয়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের গল্প শুনে নাকি মামার আগ্রহ জেগেছে মুক্তিযুদ্ধকে ভালোভাবে জানার। তাই এখানে এসে খুঁটি গেড়েছে। আমাকে বেশ কদিন ধরে চাপ দিচ্ছিল, যেন তাকে গল্প শোনাই। কাজে ব্যস্ত থাকি। সময় পাই না। আজ সময় মিলল।
শুরু করলাম গল্প। বুঝলে মামা, এই জাদুঘরে চার গ্যালারিতে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময়ই নয়, বহু আগ থেকে শুরু হওয়া সভ্যতার নিদর্শন দিয়ে শুরু করে যুদ্ধ শেষে বুদ্ধিজীবী হত্যা আর বীরাঙ্গনাদের ইতিহাস পর্যন্ত। আছে অষ্টম শতকের মাটির মূর্তি। প্রাচীন বঙ্গের মানচিত্র দেখে বুঝবে, বাংলার ইতিহাস বেশ পুরোনো। যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে তোমাকে একদম প্রাচীনকাল থেকেই দেখতে হবে। পোড়ামাটির ফলক, মূর্তি আর পুঁতির দানা দেখে মনে কোরো না, সামান্য বস্তু। এর পেছনে আছে আমাদের অঞ্চলের দীর্ঘ ইতিহাস।
জাদুঘরটি আগে ছিল সেগুনবাগিচায়। এত কিছু রাখার জায়গা হয়নি বলে এখানে নিয়ে এসেছে। নতুন ভবনের বাইরেরটুকু তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ। ভেতরে আছে ছয়টি গ্যালারি। দুটি অস্থায়ী আর চারটি সব সময়ই থাকছে। জাদুঘর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান গ্যালারিতে নিদর্শন উপস্থাপনার দায়িত্বে আছে। গ্যালারিগুলো ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায়। চার গ্যালারিজুড়ে আছে জাদুঘর। তোমাকে চার গ্যালারির গল্প বলছি।
বাছাই করা নিদর্শন গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়। বাকিগুলো সংরক্ষিত রয়েছে জাদুঘরের আর্কাইভে। মিলনায়তন, অফিস, পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, ক্যানটিন, প্রদর্শনী কক্ষও আছে এই জাদুঘরে। শিখা অনির্বাণ রয়েছে প্রথম তলায়। চত্বরের বাইরে রাখা আছে দুটি ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রদর্শনীর বাস। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে আর উপস্থাপন করার জন্য জাদুঘরটি তৈরি করা হয়েছে।
আমাদের ঐতিহ্য আমাদের সংগ্রাম
প্রথম গ্যালারির নাম এটি। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই জনপদের কিছু প্রত্ননিদর্শন আছে। দশম শতাব্দীতে বাংলা অঞ্চলের সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে। আছে সপ্তম শতকে পাওয়া পোড়ামাটির ফলক, পুঁথি ইত্যাদি। ষাট গম্বুজ মসজিদের ছবি, সিরাজউদৌল্লার আন্দোলন থেকে ধীরে ধীরে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়ে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এলাম আমরা, এখানে ঘুরলে বোঝা যায়। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ব্যবহৃত চরকা দেখতে চাও? এখানে পাবে। কীভাবে এই অঞ্চলে সভ্যতার পর সভ্যতা গড়ে উঠল, তার নিদর্শন এগুলো।
এখানে দুটি ইট রাখা আছে। ব্রিটিশ আমলে আন্দামান দ্বীপের জেলখানায় স্বাধীনতাকামীদের নির্বাসন দেওয়া হতো। অনেককেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ইট দুটি দেখতে সামান্য ইট মনে হতে পারে। এ দুটি ইটের গায়ে লেগে আছে স্বাধীনতাকামীদের জীবন কেড়ে নেওয়ার ইতিহাস। আছে লড়াই, বন্দিত্ব আর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার স্মৃতি।
ইতিহাসের পরিক্রমায় আসে বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন ও মিছিলের ছবি আর নথি আছে এখানে। ভাষা আন্দোলনের সময়কার ঘটনা লিখে রেখেছিলেন ড. মাহবুবুর রহমান (মুফতি)। তাঁর ডায়েরির পাতা সঠিক ইতিহাস খুঁজে পেতে সাহায্য করে। এই ডায়েরি দেখতে পাবে এখানে।
সার্জেন্ট জহরুল হকের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয়েছিল। বন্দী থাকা অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। তুমি কি জানো, তিনি ছবি আঁকতেন? তাঁর তৈলচিত্র, রং আর কতগুলো তুলি রাখা আছে।
আমাদের স্বাধীনতা এসেছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। কত ছবিতেই তো দেখো, সফেদ পাঞ্জাবির ওপর কালো কোট চাপিয়ে আছেন তিনি। নৌকায় বসে আছেন, গায়ে তাঁর সিগনেচার পোশাক। কেমন হবে, যদি সেই পাঞ্জাবি আর কোট দেখতে পাও? কাচঘেরা এই নিদর্শন দেখতেই তোমার একবার ভেতরে যাওয়া উচিত চিল মামা!
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আন্দোলনের ব্যানার এঁকেছিলেন। তাঁর আঁকা ব্যানার একদম ছবির মতো। এখন তো কতশত ব্যানার চোখে পড়ে রাস্তাঘাটে। শিল্পের দিক দিয়ে এই ব্যানারই সবার থেকে ছাড়িয়ে।
আমাদের অধিকার, আমাদের ত্যাগ
তুমি জানো, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন। কিন্তু যে ক্যামেরায় লাখো মানুষের ছবি তোলা হলো, ক্যামেরাটি কি তুমি দেখতে চাও না? ছবিগুলো তো আছেই। সবখানেই পাওয়া যায়, কিন্তু বিশেষ কিছু ছবি আর ছবির পেছনের গল্প আছে এখানে। আওয়ামী লীগ ওই দিন সন্ধ্যায় একটা প্রেস রিলিজ প্রচার করেছিল, সেই প্রচারপত্র রাখা আছে এই গ্যালারিতে। দেখেও শান্তি।
সব যে তখনকার জিনিস এমন নয়, ভিডিও, সাউন্ড দিয়ে প্রজেক্টরে কয়েক জায়গায় ইতিহাসের গল্প দেখানো হয়। এমন জায়গায় দেখা পেলাম দুজন ছোট্ট মেয়ে আর তাদের বাবাকে। মেয়ে দুটোর নাম মানহা আর মুনতাহা। ওরা বসে বসে এই ভিডিও দেখছিল। বাবা মিরপুর থেকে নিয়ে এসেছেন ওদের। বললেন, ‘জানো, স্বাধীনতার সময় আমার বাবা আর জ্যাঠা ছিলেন করাচিতে। যুদ্ধে যোগ দিতে তাঁরা পালিয়ে দেশে আসতে চেয়েছিলেন। একসময় আসেনও। কিন্তু আসতে আসতে দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে।’ ওরা জানাল, বাবার এই গল্প জেনেই ঘুরে দেখতে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। রোববার নাকি একবার এসে ফিরে গেছে। ওই দিন সাপ্তাহিক বন্ধ।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইটে ঢাকার রাস্তায় বের হয়েছিল পাকিস্তানি আর্মির গাড়ি, ট্রাক। এমন একটি গাড়ি রাখা আছে এই গ্যালারিতে। অন্ধকার করে রাখা এক টানেলের মতো জায়গা। গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে ভিন্ন রকম এক আবহ তৈরি হয়েছে। আমি অবশ্য অন্ধকারে উড়তে গিয়ে দুবার ধাক্কা খেয়েছি। দেখতে পাইনি। এখানকার পর্দা এমন ভারী, দেখে ভেবেছিলাম দেয়াল। তবে আবহ এত সুন্দর, অন্ধকারের ভেতর সোনালি আলো।
আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র
ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে ইতিহাস বলা হয়েছে প্রজেক্টর লাগিয়ে। কোথাও বঙ্গবন্ধু কথা বলছেন, কোথাও প্রতিবাদের ভিডিও চলছে। মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের গল্প চলছে কোথাও। ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বর্বরতা তুলে ধরা হয়েছে এই গ্যালারিতে। এ ছাড়া স্বাধীনতার ঘোষণা, ৪ এপ্রিল কুষ্টিয়ার যুদ্ধ এবং সারা দেশের গণহত্যার নিদর্শন পাবে তুমি এই গ্যালারিতে।
চিল মামা, উদ্বাস্তুদের কথা কি জানো? কী কষ্ট করে তারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাত্রা করেছিল! সেখানে যাওয়ার পথে কেউ মরে পড়ে আছে। সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় এক কোটি মানুষ। ক্যাম্পে জীবনযাপনের ঘটনাবলি এই গ্যালারিজুড়ে। ড্রেনের পাইপে পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছিল। তেমন একটি পাইপ রাখা আছে। এই পাইপ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবাদ হয়েছিল। তার ছবি লাগানো আছে। খবরগুলো দেয়ালে পোস্টারের মতো করে লাগানো।
যুদ্ধের নানা রকম ব্যাপ্তি ছিল। যেমন একাত্তর সালে চট্টগ্রাম ইবিআর ট্রেনিং সেন্টারে কাজ করতেন মো. আবদুল আহাদ খান। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি রিক্রুটদের আক্রমণ করা শুরু করে। পরদিন এই মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হন। চট্টগ্রাম হাসপাতাল থেকে সাময়িক চিকিৎসা নিয়ে তিনি ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধে যোগ দেন। একাত্তরে শরীরে বিদ্ধ বুলেটটি ৩০ বছর তাঁর শরীরের ভেতরে ছিল। ২০০১ সালে অস্ত্রোপচার করে গুলিটি বের করা হয়। গুলিটি রাখা আছে এখানে।
যুদ্ধ শুরুর পর দেশের বন্ধুরা, মানবতাকর্মী, সাংবাদিকসহ বহু পেশার মানুষ বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছেন। টাইমস পত্রিকাসহ অনেক পত্রিকায় পাকিস্তানকে আক্রমণ বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সেই পত্রিকার কাটিং দেখেছি। চিল মামা, তোমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে?
তুমি হয়তো সারা দেশে মানুষের প্রতিরোধযুদ্ধের কথা শুনেছ। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন আদিবাসীরা। আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না তাঁদের। তির-ধনুক আর বল্লম নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তেমন তির-ধনুক দেখতে তোমাকে ভেতরে যেতেই হবে।
এই গ্যালারিতেই আছে শহীদ আজাদের স্মৃতি। বই আর জামাকাপড় রাখা আছে তাঁর। শহীদ আজাদকে চেনো? আজাদ ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। পুরো নাম মাগফার আহমেদ চৌধুরী। পাকিস্তানের স্বাধীনতার বছর যাঁর জন্ম। ১১ জুলাই ১৯৪৬ সালে জন্মেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বছর নিখোঁজ হন। ৩০ আগস্ট, ১৯৭১ সালে হারিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। শহীদ আজাদ নামে পরিচিত দুর্ধর্ষ গেরিলাযোদ্ধা তিনি। আজাদ তাঁর বাসায় ক্র্যাক প্লাটুনের কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরির পাশে এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের।
ছেলেকে ফিরে পেতে রমনা থানায় ছুটে গিয়েছিলেন শহীদ আজাদের মা। মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছ?’ আজাদ মাকে বলেছিলেন, ‘এরা খুব মারে, ভয় হচ্ছে কখন সব স্বীকার করে ফেলি।’ ছেলের সামনে মা ভেঙে পড়েননি, শক্ত ছিলেন। ছেলেকে সাহস দিয়েছিলেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো বাবা। কোনো কিছু স্বীকার করবে না।’
আজাদ মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। ‘মা, কত দিন ভাত খাই না। এরপর যখন আসবে, আমার জন্য ভাত নিয়ে এসো।’ পরদিন মা ভাত নিয়ে যান থানায়। গিয়ে দেখেন, ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনো দিন ফিরে আসেননি। ধরে নেওয়া হয়, সেদিনই ঘাতকেরা মেরে ফেলেছিল আজাদকে।
ছেলে এক বেলা ভাত খেতে চেয়েছিলেন, মা পারেননি ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে। সেই কষ্টে যতকাল বেঁচে ছিলেন, পুরো ১৪টি বছর মুখে একটা ভাত তোলেননি তাঁর মা সাফিয়া বেগম! অপেক্ষায় ছিলেন ১৪টা বছর। ছেলেকে ভাত খাওয়াবেন। ছেলে ফিরে আসবে। ফিরে আসেননি। কেমন করে ফিরবেন? তাঁর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল হানাদার বাহিনী।
চিল মামা কাঁদল। বলল, আমি শহীদ আজাদের মুখটা একবার দেখতে চাই। ভেতরে যেতে পারছি না, তাই তোমার চোখ দিয়ে দেখছি।
আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ
চিল মামা, তুমি কি কল্পনা করতে পারো, কেমন অস্ত্র ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন? এই গ্যালারিতে রাখা আছে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত কয়েক ধরনের অস্ত্র। প্রতিরোধযুদ্ধে এগুলো ব্যবহার করতেন তাঁরা। যুদ্ধের অনেক নিদর্শনই আছে। সব তো বলা যায় না। তোমাকে না হয় আরেক দিন বলব। তবে এই গ্যালারিতে আছে যুদ্ধ শেষে আমাদের স্বজন হারানোর বেদনা আর বিজয়ের গল্প। ভারতীয় বাহিনী আমাদের সাহায্য করেছিল। তাদের আহত এক যোদ্ধাকে আরেক যোদ্ধা কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন, চোখে লেগে আছে আমার এই ছবি।
নারীদের বন্দী ও নির্যাতন করা কক্ষের ছবি এঁকে রাখা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এই ছবিগুলো পাওয়া যায়, জানা যায় দুই লাখ মা-বোনের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা। স্বাধীনতা অর্জনের আগে হানাদার বাহিনী আর তাদের দোসরেরা দেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এখানেই আছে সেই ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের পর বধ্যভূমিতে পড়ে থাকা বুদ্ধিজীবীদের দেহছবি।
চিল মামাকে বেশ বিষণ্ন মনে হলো। সে আমাকে থামিয়ে বলে, বাকি গল্প অন্য দিন। একটু উড়ে আসি বলে উড়াল দিল। এত বড় চিল, আমার আকাশ প্রায় পুরোটা ঢেকে গেল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, উঁচু থেকে আরও উঁচুতে উঠে যাচ্ছে চিল মামা। বুকে তার স্বাধীনতার সোনালি ঝিলিক।