প্রথম এভারেস্ট জয়ের ইতিহাস কি বদলে যাবে

এভারেস্ট

পর্বতারোহী অ্যান্ড্রু আরভিনের ডাকনাম ছিল স্যান্ডি। ১৯২৪ সালের ৮ জুন এভারেস্ট অভিযানে একসময় পাহাড়ের ঢালে অদৃশ্য হয়ে যান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহ-অভিযাত্রী জর্জ ম্যালোরি। ম্যালোরিও ফিরে আসেননি। আরভিন ও ম্যালোরি এভারেস্টের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন কি না, তা এভারেস্টের বড় রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে।

বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টে আরোহণের চেষ্টা করে অনেকেই এভাবে হারিয়ে গেছেন। মারা গেছেন সবাই। কাউকে খুঁজে পাওয়া গেছে, কারও দেহ রয়ে গেছে এভারেস্টের বরফের চাদরে ঢেকে। তবে আরভিনের হারিয়ে যাওয়া অন্যদের থেকে একটু আলাদা। একটু বিশেষ কিছু। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এভারেস্ট প্রথম জয়ের ইতিহাস। রয়ে গেছে রহস্য।

আমরা তো জানি এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে প্রথম এভারেস্ট জয় করেন ১৯৫৩ সালে। কিন্তু এর আগেই কি আরভিন ও ম্যালোরি জয় করেছিলেন এভারেস্ট? আরভিনের দেহাবশেষ থেকে সম্ভবত এই রহস্যের সমাধান হবে।

বুটটি ইংরেজ পর্বতারোহী অ্যান্ড্রু আরভিনের

মৃত্যুর আগে এই জুটি শীর্ষে পৌঁছেছিলেন কি না, তা নিয়ে বহু দশক ধরে পর্বতারোহী এবং ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে। যদি তাঁরা সফল হয়েছেন প্রমাণিত হয়, তবে ১৯৫৩ সালে তেনজিং নোরগে ও এডমন্ড হিলারির শীর্ষে পৌঁছানোর ইতিহাস হবে দ্বিতীয়বার শীর্ষের পৌঁছানোর ইতিহাস। প্রথম এভারেস্ট জয় এগিয়ে যাবে ২৯ বছর। মানুষের পক্ষে অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হবে জানা ইতিহাসের ২৯ বছর আগেই।

২৫ বছর আগে এভারেস্টে ম্যালোরির হিমায়িত মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। অবশেষে আরভিনের আংশিক দেহাবশেষ পাওয়া গেল। এভারেস্টের উত্তর দিকের নিচে সেন্ট্রাল রংবুক হিমবাহে ‘এ সি আরভিন’ এমব্রয়ডারি করা একটি মোজা পাওয়া গেছে। মোজাটা ছিল বুটের ভেতরে। বুটের ভেতরে আরভিনের দেহাবশেষ ছিল।

আরভিনের বুটের সামনে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পর্বতারোহী জিমি চিন

পর্বতারোহীদের একটি দল ডকুমেন্টারির জন্য এভারেস্টে চিত্রগ্রহণ করছিল। এর মধ্যেই এমন আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। সেপ্টেম্বরে চলচ্চিত্র নির্মাণকারী পর্বতারোহীদের একটি দল এভারেস্ট নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরির কাজ করছিলেন। এ সময় এভারেস্টের উত্তর পাশের সেন্ট্রাল রংবুক হিমবাহের গলিত বরফ থেকে বেরিয়ে থাকা একটি পুরোনো চামড়ার বুট দেখতে পান। ভালোভাবে দেখে তাঁরা বুঝতে পারেন, বুটের মধ্যে একটি মোজা আছে। যার ভেতরে আছে একটি পা। মোজায় এমব্রয়ডারি করে লেখা ‘এ সি আরভিন’।

আরও পড়ুন

দেহাবশেষটি অ্যান্ড্রু আরভিনের কি না, জানতে চাইলে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পর্বতারোহী জিমি চিন গ্লোবাল নিউজকে বলেন, ‘আমার মতে, এতে একটি লেবেল আছে।’ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের তথ্যচিত্র দলটি জানায়, তারা বুঝতে পেরেছে, এটি কোনো সাধারণ বুট নয়। তারা মনে করে, এটি ইংরেজ পর্বতারোহী অ্যান্ড্রু আরভিনের।

সেপ্টেম্বর মাসে বুট জুতা আবিষ্কারের বেশ কয়েক দিন আগে সেন্ট্রাল রংবুক হিমবাহ থেকে নেমে আসার সময় একটি দল একটি অক্সিজেন বোতলের ভাস্কর্য খুঁজে পেয়েছিল। যার গায়ে ১৯৩৩ সালের তারিখ লেখা ছিল।

তবে আরভিনের মোজা এবং বুটটি ম্যালোরির দেহাবশেষের চেয়ে কম উচ্চতায় পাওয়া গেছে।

ম্যালোরির দেহাবশেষ ১৯৯৯ সালে পর্বতারোহী কনরাড অ্যাঙ্কার আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি এখন চীন তিব্বত মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্বে আছেন। এই প্রতিষ্ঠান এভারেস্টের উত্তর দিকে আরোহণের অনুমতি দেয়।

ক্যাম্প ছেড়ে আরভিন এবং ম্যালোরি যাত্রা শুরু করেছেন চূড়ার উদ্দেশে৵
ছবি: সংগৃহীত

৮ হাজার ৮৪৯ মিটার উচ্চতার এই পর্বত জয় করা খুব গর্বের বিষয়। এর দুর্ঘটনার হারও বেশি। হাজারো পর্বতারোহী এখানে প্রাণ হারিয়েছেন। আরভিনের দেহাবশেষের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য দেহাবশেষের সঙ্গে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল তুলনা করার জন্য রাজি হয়েছে আরভিনের পরিবার।

এই পায়ের অংশ দিয়ে অনেক কিছুই প্রমাণ হয়। যেমন তাঁর জীবন কোথায় শেষ হয়েছিল, তার প্রথম বাস্তব প্রমাণ এই আবিষ্কার। এটা নিয়ে অনেক তত্ত্ব, জল্পনা-কল্পনা ছিল। যখন আরভিন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তার কোনো প্রমাণ ছিল না। আরভিনের পরিবারের জন্য এটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। কোথায় আরভিনের অন্তিমযাত্রা শুরু হয়েছে, জেনে স্বস্তি পেয়েছে পরিবার। পর্বতারোহীদের জন্যও এটি বড় সূত্র।

মাত্র ২২ বছর বয়সে এভারেস্টে মারা যান স্যান্ডি আরভিন। সে সময় গ্রেট ব্রিটেনের সাম্রাজ্য ছিল পতনশীল ও ভঙ্গুর। উত্তর ও দক্ষিণ মেরু প্রথম জয় করেছিল যুক্তরাষ্ট্র আর নরওয়ে। এদের কাছে অভিযাত্রায় হেরে যাওয়ায় ব্রিটেনের গর্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী প্রকৃতি অনুসন্ধানে সামনের সারিতে ছিল ব্রিটেন। ব্রিটেনের মর্যাদা হারিয়ে যাচ্ছিল।

এভারেস্টকে দেখা হতো তৃতীয় মেরু হিসেবে। ব্রিটিশ জাতি ম্যালোরি আর আরভিনকে এভারেস্টে পাঠিয়ে তাঁদের হারানো মর্যাদা ফিরে পেতে চেয়েছিল। ব্রিটেন এর আগেও এভারেস্ট জয়ের বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালিয়েছে। তবে সফল হয়নি।

অ্যান্ড্রু আরভিন
ছবি: সংগৃহীত

ম্যালোরি সহযাত্রী আরভিনের সঙ্গে এভারেস্টে যাওয়ার আগে দুবার এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শেষবার ম্যালোরির সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন আরভিন। আরভিন ছিলেন মাত্র ২২ বছরের একজন তরুণ প্রকৌশলী। অভিযানে তাঁর আগ্রহ ছিল। ম্যালোরি নিজের স্ত্রীকে চিঠি লিখে বলেছিলেন আরভিনের কথা। চিঠিতে লেখা ছিল, শুধু কথা বলা ছাড়া আরভিনের ওপর অন্য সবকিছুতেই নির্ভর করা যায়।

আরও পড়ুন

ম্যালোরি ও আরভিনকে শেষ দেখেছিলেন নোয়েল ওডেল নামে তাঁদের এক সহকর্মী পর্বতারোহী। যিনি হাজার ফুট নিচ থেকে দুটি কালো বিন্দুকে সীমানা ছাড়িয়ে চলতে দেখেছিলেন। গত ৭৫ বছরে ম্যালোরিকে শেষবার দেখা গিয়েছিল তখন। অন্যদিকে আরভিন হারিয়ে যান ১০০ বছরের জন্য।

তাঁদের মৃত্যুর কথা ঘোষণা করেছিলেন এভারেস্ট অভিযান দলের সদস্য কর্নেল নর্টন। তিনি তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। শত বছর আগের ১৯ জুন বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে পাঠানো তারবার্তায় লেখা হয়েছিল, ‘ম্যালোরি ও আরভিন তাঁদের শেষ চেষ্টায় নিহত হয়েছেন। দলের বাকিরা বেজক্যাম্পে ফিরেছে।’

সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে রাজা পঞ্চম জর্জের উপস্থিতিতে এই জুটির জন্য একটি স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল। ব্রিটেনবাসী তাঁদের জন্য শোক করেছিল। ইনটু দ্য সাইলেন্স বইয়ের লেখক ওয়েড ডেভিস ১৯২৪ সালের অভিযানের বিবরণে লিখেছেন, ব্রিটেনের ইতিহাসে এটাই একমাত্র ঘটনা, যেখানে পর্বতারোহীদের অনেক সম্মান জানানো হয়েছিল।

এর আগেও ম্যালোরি ও আলভিন খবরের শিরোনামে এসেছেন। ম্যালোরির মৃতদেহ ১৯৯৯ সালে পাওয়া যায়। সঙ্গে পাওয়া যায় কিছু আরোহণ সরঞ্জাম। ছিল একটি হাতঘড়ি এবং আলটিমিটার (উচ্চতা মাপার যন্ত্র)। যা উদ্ধার করা হয়েছিল এভারেস্টচূড়া থেকে মাত্র ৬৭০ মিটার নিচে বা এভারেস্টের ৮ হাজার ১৬৫ মিটার উচ্চতায় আবিষ্কার করা হয়েছিল।

সহঅভিযাত্রিদের সঙ্গে ম্যালোরি ও আরভিন (বাঁ থেকে দাঁড়ানো)
ছবি: সংগৃহীত

এভারেস্ট অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এই আবিষ্কার দুর্দান্ত একটা প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। আরভিন ও ম্যালোরি কি বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করেছিলেন? তাঁরাই কি প্রথম এভারেস্টজয়ী? এর কোনো উত্তর ছিল না। নেমে আসার সময় কি তাঁরা মারা গিয়েছিলেন? নাকি চূড়ায় যাওয়ার পথেই তাঁদের জীবন শেষ হয়?

ম্যালোরির ক্যামেরা হারিয়ে গেছে। তাঁরা শিখরে পৌঁছেছিলেন কি না, তার প্রমাণ থাকতে পারে এই ক্যামেরায়। রুথের ছবিটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ম্যালোরি বলে গিয়েছিল, স্ত্রী রুথের ছবিটা তিনি চূড়ায় রেখে আসবেন।

এখন এভারেস্টের চূড়ায় তাঁরা পৌঁছেছিলেন কি না, তার উত্তর লুকিয়ে আছে তাঁদের দেহ আর পর্বতে। আরভিনের দেহাবশেষ নতুন করে আলোচনা তৈরি করেছে। হয়তো এর মাধ্যমে পাওয়া যাবে নতুন সূত্র।

আরও পড়ুন

সেপ্টেম্বর মাসে বুট জুতা আবিষ্কারের বেশ কয়েক দিন আগে সেন্ট্রাল রংবুক হিমবাহ থেকে নেমে আসার সময় একটি দল একটি অক্সিজেন বোতলের ভাস্কর্য খুঁজে পেয়েছিল। যার গায়ে ১৯৩৩ সালের তারিখ লেখা ছিল।

বোতলটি ম্যালোরি ও আরভিন নিখোঁজ হওয়ার ৯ বছর পরে প্রথম চিহ্নিত হয়েছে। এটা ছিল ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশদের চতুর্থ এভারেস্ট অভিযান প্রচেষ্টার সময়কার ঘটনা। এই অভিযানও ব্যর্থ হয়েছিল। তবে ১৯৩৩ সালের অভিযানের সদস্যরা উত্তর-পূর্ব দিকের চূড়ায় একটি কুড়াল খুঁজে পেয়েছিলেন। যদিও এটি ম্যালোরিকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিল তার অনেক নিচে ছিল।

১৯৩৩ সালের অক্সিজেন বোতল চলচ্চিত্রকর্মী চিনকে বিস্মিত করে। স্যান্ডির দেহ কাছাকাছি কোথাও থাকতে পারে, তাঁদের দল অনুমান করেছিল। পরের দিনগুলোয় চিন এবং অন্যরা হিমবাহের খাঁজ ও আশপাশে এলোমেলো রাস্তায় খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে।

একপর্যায়ে বরফের থেকে বেরিয়ে আসা একটা বুট তাঁরা খুঁজে পান। তাঁদের মনে হয়েছে, খুঁজে পাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে বুটটি বরফ গলে বেরিয়ে এসেছে।

রক্তের আত্মীয়ের বুট পাওয়া গেছে শুনে তিনি ‘কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন
ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

আরভিনের ভাতিজি ও জীবনী লেখক জুলি সামার্স বলেছেন, মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর পর এই আবিষ্কার ‘অসাধারণ’। তাঁর রক্তের আত্মীয়ের বুট পাওয়া গেছে শুনে তিনি ‘কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন’।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সাত বছর বয়স থেকে এই গল্প শুনে বেড়ে উঠেছি। আমার বাবা আমাদের এভারেস্টে স্যান্ডি চাচার রহস্য নিয়ে বলেছিলেন। ১৯৯৯ সালে পর্বতারোহীরা যখন জর্জ ম্যালোরির মৃতদেহ খুঁজে পান, তখন গল্পটি আমার কাছে আরও বাস্তব হয়ে ওঠে। আমি ভাবছিলাম চাচার মৃতদেহ পরে কখনো আবিষ্কার হবে।’

১৯৩৩ সালের অক্সিজেন বোতল চলচ্চিত্রকর্মী চিনকে বিস্মিত করে। স্যান্ডির দেহ কাছাকাছি কোথাও থাকতে পারে, তাঁদের দল অনুমান করেছিল। পরের দিনগুলোয় চিন এবং অন্যরা হিমবাহের খাঁজ ও আশপাশে এলোমেলো রাস্তায় খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে।

চিন জানিয়েছেন, ‘এটি আমাদের পুরো দলের জন্য একটি স্মরণীয় এবং আবেগময় মুহূর্ত। আমরা কেবল আশা করি, এটি শেষমেশ স্যান্ডির আত্মীয়স্বজন এবং পর্বতারোহীদের মানসিক শান্তি দিতে পারবে।’

আরভিনের দেহাবশেষ থেকে নতুন কী তথ্য পাওয়া যাবে, তা সময়ই বলে দেবে।

সূত্র: ইনডিপেনডেন্ট ডট ইউকে

আরও পড়ুন