যুদ্ধে মানুষ মরে। সুনির্দিষ্ট করে বললে, অসহায় মানুষ মরে। যদি আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে হয়, যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারী ও শিশুরা। সর্বশেষ গাজায় ফিলিস্তিনের হামলাতেও সেটাই দেখা গেল। ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা শুরু হয়। এই হামলায় ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শিশুই মারা গেছে ৩ হাজারের বেশি। আর আহত হয়েছে ২০ হাজারের বেশি।
এদিকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের হামলায় নিহত হয়েছেন দেড় হাজারের মতো ইসরায়েলি। এই হামলা চলাকালে তাদের হাতে আটক হয়েছেন দুই শতাধিক ইসরায়েলের নাগরিক।
এবারের যুদ্ধকে বলা হচ্ছে গাজা যুদ্ধ। এখানে দিনক্ষণগুলো আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। মূলত ৭ অক্টোবর প্রথম হামলা শুরু করেছিল হামাস। এর কয়েক ঘণ্টা পরই পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েলের বাহিনী। এর এক দিন পর; অর্থাৎ ৮ অক্টোবর হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই যুদ্ধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে পুরো গাজা নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
দুই পক্ষেরই এবারের আক্রমণ অনেক বেশি তীব্র। অন্যান্য সময় খবরে দেখা যায়, কোনো হামলায় হামাসের পক্ষ থেকে হয়তো হাতে গোনা কয়েকটি রকেট ছোড়া হয়। এর জবাবে ইসরায়েল ছোটখাটো অভিযান চালায়। কিন্তু এবারের চিত্র একেবারে ভিন্ন। ইসরায়েলে হামলা শুরুর পর হামাসের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছিল, প্রথম ২০ মিনিটের অভিযানে ৫ হাজারের বেশি রকেট ছোড়ে তারা।
হামলার জবাবও ছিল কড়া। ইসরায়েলের পাল্টা হামলার শুরুর ছয় দিন পর দেশটির বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, ছয় দিনে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ছয় হাজার বোমা ফেলেছে তারা, যার মোট ওজন চার হাজার টন। এখন হিসাব করা যেতে পারে, সেখানে আসলে শিশুরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গাজায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষের বয়স ৩০ বছরের নিচে এবং অর্ধেকের বয়স ১৮ বছরের নিচে; অর্থাৎ বলা যায়, অর্ধেকই শিশু। ইসরায়েলের এই লাগাতার হামলায় সবাই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার মৃত্যুর সংখ্যা হিসাব করা যাক। ইসরায়েলের হামলায় ৩ হাজার শিশু মারা গেছে। এর বাইরে যে ৫ হাজার মানুষ মারা গেছেন, তাঁদের সবাই কোনো না কোনো শিশুর আত্মীয়। কোনো শিশু তার মাকে হারিয়েছে, কেউ বাবাকে হারিয়েছে, কেউ ভাইকে, কেউ বোনকে হারিয়েছে। কেউ কেউ চোখের সামনে স্বজনকে মরতে দেখেছে। এমন সব ঘটনার ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখা গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব ছবি ভাইরাল হয়েছে, তার মধ্যে একটি বড় অংশ শিশুদের ছবি। অসহায় শিশুরা কাঁদছে এবং চোখেমুখে তাদের আতঙ্ক; শরীরে একটি অংশ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে—এমন অনেক ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে এই কদিনে।
এটা বলতে দ্বিধা নেই, গাজার প্রত্যেক মানুষ মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়েই প্রতিটা দিন পার করেন। ছোট শিশু থেকে প্রবীণ পর্যন্তও জানেন যেকোনো সময় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে যে কেউ নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে পারেন। তবে এবার গাজাবাসী যেভাবে মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখছেন, সম্প্রতি এমনটা আর ঘটেনি। ইসরায়েলের হামলা শুরুর প্রথম ২০ দিনে অবিরাম বোমাবর্ষণে গাজায় দুই লাখ আবাসিক ইউনিট (বাড়ি ও ফ্ল্যাট) ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন গাজার গণপূর্তমন্ত্রী মোহাম্মদ জিয়ারা। স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে গাজার ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বেশি (১৪ লাখ) গৃহহীন হয়েছেন। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীও রয়েছেন।
গাজার হাসপাতালগুলোও বেহাল। গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের চিকিৎসক ইয়াসের আলী বলেন, ‘প্রতিদিন অনেক মরদেহ হাসপাতালে আসছে। সেগুলো হিমঘরে রাখার জায়গা নেই। তাই মরদেহ রাখার জন্য আমরা আইসক্রিমের কারখানা থেকে ফ্রিজার নিয়ে এসেছি। যদি এই সংঘাত চলতে থাকে, তাহলে মানুষকে দাফন করার জায়গাও থাকবে না।’
অনেকেই মৃত্যুকে নিয়তি হিসেবে ধরে নিয়েছেন। যেমন গাজার বাসিন্দা আলী এল দাবা ও লিনা দম্পতির কথাই বলা যেতে পারে। সাত সন্তান তাঁদের। ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলার মুখে বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে পরিবারটি। তবে বাড়ি ছাড়ার আগে আলী সিদ্ধান্ত নেন, যেখানেই যাবেন, একসঙ্গে থাকবেন না সবাই। কারণ, একসঙ্গে থাকলে এক হামলায় সবার মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে যায়। দুই ছেলে, দুই মেয়েসহ স্ত্রী লিনাকে গাজার উত্তরাঞ্চলে পাঠিয়েছেন আলী। তিন সন্তানসহ তিনি আছেন গাজার দক্ষিণের খান ইউনিসে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে।
আলী তাঁর সঙ্গে থাকা সন্তানদের হাতের কবজিতে বেঁধে দিয়েছেন হালকা বেগুনি ও কালো রঙের মোটা সুতা। তিনি এভাবে সন্তানদের সাজিয়েছেন, বিষয়টি এমন নয়। ইসরায়েলি হামলায় কিছু হয়ে গেলে যেন সন্তানদের চিনতে পারেন, সে জন্য তিনি এমনটা করেছেন।
আলী বলেন, ‘যদি কিছু হয়ে যায়, সে জন্য এমনটা করেছি। আমি অনেক লাশ ছিন্নভিন্ন হতে দেখেছি। যদি তারাও (সন্তানেরা) এভাবে টুকরা টুকরা হয়ে যায়, তাহলে আমি তাদের হাতে থাকা এই রঙিন মোটা সুতা দেখে চিনতে পারব।’
যেকোনো সময় সন্তানদের হারাতে হতে পারে, এমন আতঙ্কে ভুগছেন অভিভাবকেরা। হাতে রঙিন মোটা সুতা বাঁধা তারই একটি লক্ষণ।
এমন অনেক শিশুকেই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, যারা এই স্বজন হারানোর অর্থই এখনো বুঝতে পারেনি। আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে।
এবার আসা যাক খাদ্যসংকটে। গাজা যেহেতু অবরুদ্ধ, তাই সেখানে খাবার ও পানি কোনো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। ত্রাণ থেকে যে খাবার ও সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আসলে ক্ষুধা মরছে না। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ফিলিস্তিনের হাসপাতালে থাকা রোগীরা প্রতিদিন পানি পাচ্ছেন ৩০০ মিলিলিটার। একজন সাধারণ মানুষের প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি পান করা দরকার, তার সাত ভাগের এক ভাগের কম পানি পাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। সেখানে খাদ্যসংকট যে চরমে, তা-ও বোঝা যাচ্ছে। যেমন ফিলিস্তিনিরা খাবার না পেয়ে জাতিসংঘের ত্রাণের গুদামে লুটপাট চালিয়েছেন। একটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়, এই ত্রাণ কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জন্যই নেওয়া হয়েছে সেখানে; অর্থাৎ ক্ষুধা কতটা বেশি হলে এই কাজ করতে পারেন মানুষ!
এখানেও আসা যাক শিশুদের প্রসঙ্গে। যেসব শিশুরা তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে হারিয়েছে, তাদের অবস্থা কী? এই শোকার্ত শিশুগুলো কী খাবারের জন্য ছুটবে?
গাজার হাসপাতালগুলোয় এমন আহত অনেক শিশুকেই নেওয়া হয়েছে, যারা মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছে। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখা এই শিশুরা একদিন বড় হবে। তবে তাদের মধ্যে এই ট্রমা বা মানসিক আঘাত রয়েই যাবে। ‘ইসরায়েলি মানেই হত্যাকারী’—এই ভাবনা নিয়েই সে বেড়ে উঠবে। ইসরায়েলের কোনো নাগরিককে কি সে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে পারবে?
আবার ইসরায়েলের নাগরিকদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। সম্প্রতি হামাস ইসরায়েলে যে হামলা চালিয়েছে, তাতে শিশুরা মারা গেছে। যে দেড় হাজারের মতো ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন, তাঁরাও তো কোনো না কোনো শিশুর বাবা, মা, ভাই, বোন। এই শিশুরাও তো একই ট্রমার মধ্যে পড়েছে। এই শিশুরাও কি কখনো কোনো ফিলিস্তিনিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে পারবে?
গাজা, জেরুজালেম আসলে কার, এ নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে। সেই বিতর্ককে বাইরে রেখেই শিশুদের বিষয়টি বিবেচনা করা যাক। যুদ্ধ মানেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সেখানে রাজা-উজিরদের নানা হিসাব-নিকাশ থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষ? তারা আসলে যুদ্ধে কী পায়? এই যে শিশুরা স্বজন হারাচ্ছে, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারাচ্ছে, তারা কী পাবে? গাজা উপত্যকার প্রান্তে প্রান্তে এখন স্বজন হারানোর মাতম। উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে আড়াই মাস বয়সী ছেলেকে হারিয়ে এক বাবার আহাজারি ছিল এ রকম, ‘ও কি কাউকে মেরেছে? অপহরণ করেছে? নিষ্পাপ শিশুগুলো তো বাসার মধ্যে ছিল। তাদের দোষ কী?’