সাবমেরিনে সাগরতলে

‘আব্বু, এটা তো মনে হয় স্ক্যাম।’ রেগে বললাম আমি।

বাসার সবাই মিলে মালদ্বীপে যাব আমরা। সেখানকার হোটেল বুকিং দিতে গিয়ে ‘হোয়েল সাবমেরিন’ নামের একটি ওয়েবসাইটের খোঁজ পেয়েছেন আমার বাবা। মালদ্বীপের রাজধানী মালে থেকে স্পিডবোটে করে নিয়ে যাবে আমাদের। তারপর সাগরের মাঝখানে গিয়ে তুলবে একটা সাবমেরিনে। সেই সাবমেরিন নাকি পানির নিচ থেকে ঘুরিয়ে আনবে আমাদের! পুরো ব্যাপারটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না আমার কাছে। কিন্তু আমাদের মতামত না নিয়েই পরিবারের সবার জন্য সেই সাবমেরিনের টিকিট কেটে ফেললেন বাবা। আমি রেগে বললাম, ‘এসব সাবমেরিন–টাবমেরিন কেবল থাকে জুল ভার্নের বইতে আর ওশানগেটের টাইটান সাবমেরিনে। এসব যে খুব নিরাপদ, তা–ও কিন্তু না! গত বছর তো টাইটানে করে পাঁচজন মিলে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসস্তূপ দেখতে যাওয়ার পর নিখোঁজ হওয়ায় সারা দুনিয়ায় হইচই পড়ে গেল।’ বাবা বললেন, ‘আরে বোকা, টাইটান গিয়েছিল প্রায় চার হাজার মিটার নিচে। হোয়েল যাবে মাত্র ৪০ মিটার।’ আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘টাইটানের যাত্রীরা লাখখানেক ডলার দিয়ে টিকিট কিনেও নিজেদের বাঁচাতে পারল না, আর তুমি কিনা ১০০ ডলার দিয়ে টিকিট কিনে পানির নিচে যাওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছ!’ দুর্লভ ভৌগোলিক অবস্থান, বিরল ভূপ্রকৃতি ও ভিন্ন জীবনধারার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মালদ্বীপ দেশটিতে ভ্রমণ যথেষ্ট ব্যয়বহুল। দেশটির ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশই জলভাগ। স্থলভাগ মাত্র দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। মালদ্বীপ এশিয়া মহাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে ৭৫০ কিলোমিটার দূরে, বলা যায় এ মহাদেশের সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। এমন একটি জায়গায় অচেনা ‘হোয়েল সাবমেরিন’ আমাকে একেবারেই আশ্বস্ত করতে পারছিল না।

আরও পড়ুন
তারান্নুম মৃত্তিকা

কিন্তু এই বাগ্‌বিতণ্ডার ঠিক এক সপ্তাহ পর আবিষ্কার করলাম, ভারত মহাসাগরের মাঝখানে যাত্রীদের লাইনে আমি দাঁড়িয়ে আছি স্পিডবোটে ওঠার জন্য। পাশেই ভেসে আছে মিনিবাসের আকারের সমান হলুদ রঙের একটা সাবমেরিন। সবাই মিলে বিশৃঙ্খলভাবে একসঙ্গে সাবমেরিনে না ঢুকে একজন একজন করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, যাতে বসার জায়গায় যাত্রীদের ওজনের ভারসাম্য থাকে। পানির নিচে নিরাপদ ভ্রমণের জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাবমেরিনে গিয়ে দেখলাম, মাঝখানে হাঁটাচলার একটু জায়গা রেখে দুই পাশে বসার ব্যবস্থা। প্রতিটি চেয়ারের সামনে একটি গোলাকার কাচের জানালা এবং সেই জানালা দিয়ে অদ্ভুত বর্ণের নীলচে আলো আসছে। এমন নীল আমি আগে কখনো দেখিনি! নীলটা যেন এই পৃথিবীর নয়। মনে হলো, আমরা রকেটে চড়ে অচেনা এক গ্রহের ঘোরগ্রস্ত নভোচারী, জানালা দিয়ে অবাক হয়ে বাইরের নতুন জগৎ দেখছি!

জানালা দিয়ে অবাক হয়ে বাইরের নতুন জগৎ দেখছি!

সব যাত্রী ওঠার পর ধীরচিত্তে সাবমেরিন পানির তলে নামতে থাকল। সবাই জানালা দিয়ে পানির নিচের জগৎ দেখছেন। কিন্তু আমি তাকালাম ওপরে, পানির বিভেদতলের দিকে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! আমি শরীর না ভিজিয়েই পানির এত নিচে চলে এসেছি! ওপরের স্থলভাগ যেন ধরাছোঁয়ার বাইরের দেশ, সেখানকার বিভেদতলে প্রতিসরিত হয়ে পানির নিচে বিচ্ছিন্নভাবে নকশা কেটে যাচ্ছে আলো। গাঢ় নীলের ভেতর এই হালকা আলোর খেলা খুব অদ্ভুত লাগছিল!

আরও পড়ুন

আরও কিছুটা নিচে গিয়ে প্রথমবারের মতো সামুদ্রিক প্রাণীর দেখা পেলাম। আয়েশি ভঙ্গিতে সাঁতরে যাচ্ছিল একঝাঁক রেড স্ন্যাপার। আমার স্পষ্ট মনে হলো, মাছগুলোর পলকহীন চোখ আমাদের দিকে বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে আছে। ওরা তো সাঁতরে বেড়ানোর সময় প্রতিদিন এমন ঢাউস একটা যানবাহন ভেসে থাকতে দেখে না! সত্যি বলতে আমরাও বেশ অবাক হয়েই ওদের দেখছি। আমরা তো এত দিন মাছ দেখতাম অ্যাকুয়ারিয়ামে, এখন আমরাই যেন মাছগুলোর কাছে খাঁচায় ভরা স্থলভাগের প্রাণী!

একটা বড়সড় কচ্ছপকে দেখলাম সামনে–পেছনে চারটি পা দিয়ে পানি কেটে এগিয়ে গেল। শত বছর আয়ু পাওয়া প্রজাতির এই সদস্যের বয়স কত, কে জানে!

ওপরের স্থলভাগ যেন ধরাছোঁয়ার বাইরের দেশ

পাশেই দেখলাম একটা পুরোনো মরচে পড়া লোহার কাঠামো। নিশ্চয়ই মানুষের কাজ! সেটার ভেতর থেকে একঝাঁক ছোট আকারের রঙিন মাছ বেরিয়ে এল। চটপটে মাছগুলো এতই ছোট যে আমার মনে হলো, এদের একেকটি একটি সিম কার্ডের চেয়ে বড় নয়। সাবমেরিন দেখে এই ঝাঁকও বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তবে তাদের তাৎক্ষণিক সংঘবদ্ধতা অবাক করার মতো। মাছের পুরো দলটি একসঙ্গেই অবস্থান করে ছিল, সাবমেরিন দেখামাত্র কয়েকবার ছত্রভঙ্গ হতে হতে শেষমেশ আবার নিজেরা দ্রুত এক হয়ে দূরে সাঁতরে গেল। সবে মিলে করি কাজ, হারি–জিতি নাহি লাজ!

এরপর পেলাম একটা প্রবালপ্রাচীর। একটি আলাদা অঞ্চল মিলে নানা রঙের মাঝারি আকারের পত্রহীন গাছের মতো প্রবাল, সেখানে শতাধিক মাছের সংসার! মাছগুলোও রঙিন। লাল, নীল, হলুদ, কমলা, সবুজ! মনের আনন্দে এরা প্রাচীরের আশপাশে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। আমি গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, লাল জমিনে সাদা ডোরাকাটা বেশ কয়েকটি ক্লাউনফিশ ছোটাছুটি করছে। হ্যাঁ, পিক্সারের ‘ফাইন্ডিং নিমো’ সিনেমার মূল চরিত্র যে মার্লিন নামের এক ক্লাউনফিশ, সেই ক্লাউনফিশ! এত দিন তো মার্লিন আর ওর ছেলে নিমোকে অ্যানিমেট করে বানানো সিনেমা পর্দায় দেখেছি, আর আজ দেখছি ওদের বাসস্থানের সামনে এসে! ফাইন্ডিং নিমোর বাস্তবিক গল্প আর আমার মধ্যে দূরত্ব মাত্র একটি কাচের জানালা!

আরও পড়ুন