মানুষের সমুদ্রযাত্রার ইতিহাস বহুদিনের। সমুদ্রে মাছ ধরার ইতিহাস তো আরও পুরোনো। সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে বহু জলযান ডুবে গেছে। এর সঙ্গে ডুবে মারা গেছে কতশত মানুষ! তবে কেউ কেউ দুর্ঘটনার কবলে পড়েও সমুদ্র থেকে বেঁচে ফিরেছেন। জলযান ডুবে যাওয়ার পর সমুদ্রে ভেসেই বেঁচে থেকেছেন এমন উদাহরণও কম নয়। তবে মেক্সিকোর জেলে হোসে সালভাদর আলভারেঙ্গার গল্পটা আলাদা। ঝড়ের কবলে পড়ে সমুদ্রে দীর্ঘ সময় একাকী বেঁচে থাকার রেকর্ডটি তাঁর।
২০১২ সালের ১৭ নভেম্বর মেক্সিকোর সমুদ্র উপকূল কোস্টা আজুলের মাছ ধরা গ্রাম থেকে সমুদ্রে মাছ ধরতে নেমেছিলেন আলভারেঙ্গা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ইজেকুয়েল কর্ডোবা নামের আরেক জেলে। কর্ডোবার সঙ্গে আগে কখনো মাছ ধরতে যাননি আলভারেঙ্গা। মাছ ধরার সঙ্গী হিসেবে কর্ডোবা ছিলেন নতুন।
তীর ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই তাঁদের নৌকা ঝড়ের কবলে পড়ে। আলভারেঙ্গাদের মাছ ধরা নৌকাকে একরকম উড়িয়ে নিয়ে যায় সেই ঝড়। প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাতে নৌকার মোটর আর বেশির ভাগ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ঝড়ের কবলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওতে তাঁর বসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন আলভারেঙ্গা। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড় থাকায় কোনো সাহায্য করতে পারেননি তাঁর বস।
ঝড় চলল পাঁচ দিন ধরে। ঝড় শেষ হওয়ার পর আলভারেঙ্গা ও কর্ডোবার কোনো ধারণাই ছিল না তাঁরা কোথায় আছেন বা কীভাবে বাড়ি ফিরে যাবেন। ওদিকে মাছ ধরার প্রায় সব সরঞ্জাম ধ্বংস হয়ে গেছে। সঙ্গে শুধু অল্প কিছু খাবার। নৌকার মোটর, পাল, বইঠা কোনো কিছুই ছিল না। শুধু ভেসে ছিল তাঁদের নৌকা।
এভাবে দুই মাস ধরে তাঁরা ভেসে ছিলেন। বৃষ্টির পানি পান করতেন। মাছ, কচ্ছপ ও পাখির মতো সামুদ্রিক প্রাণী ধরে ধরে ক্ষুধা মেটাতেন। দুঃখজনকভাবে চার মাস পর বাঁচার আশা ছেড়ে দেন কর্ডোবা। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে অপেক্ষা করেন মৃত্যুর জন্য। একপর্যায়ে অনাহারে মারা যান তিনি। হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন আলভারেঙ্গাও। কিন্তু কঠোরভাবে নিয়মের মধ্যে আটকে রেখেছিলেন নিজেকে।
চার মাস সমুদ্রে টিকে থাকার পর শুরু হয় আসল পরীক্ষা। একদিকে একা একা টিকে থাকার লড়াই। অপর দিকে একের পর এক সমুদ্রগামী জাহাজ পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। বিশালাকার পণ্য পরিবহনকারী জাহাজের প্রতিটিতেই তিনি সংকেত দিয়েছেন। কিন্তু কোনো জাহাজই তাঁকে দেখতে পায়নি। এই দিনগুলো বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে আর সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করে খেয়ে বেঁচে থাকছিলেন আলভারেঙ্গা। চাঁদের পূর্ণিমা-অমাবস্যার মতো পর্যায়গুলো দেখে রাখছিলেন সময়ের হিসাব।
এক বছরের বেশি সময় পর ভাগ্য সহায় হয় আলভারেঙ্গার। যে ঝড় তাঁকে সমুদ্রে ঠেলে দিয়েছিল, সেই সমুদ্রের স্রোতে ভাসতে ভাসতে ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ সালে উপকূলের দেখা পান তিনি। আলভারেঙ্গা নৌকা থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে তীরের দিকে সাঁতার কাটা শুরু করেন। প্রশান্ত মহাসাগরের যেদিক থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, বিপরীত দিকের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের একটিতে নিজেকে খুঁজে পান তিনি। সেখানকার মানুষ হাসপাতালে নিয়ে যায় আলভারেঙ্গাকে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। সব মিলিয়ে ৪৩৮ দিনের জন্য সমুদ্রে ভেসে ছিলেন আলভারেঙ্গা। এ সময় ভ্রমণ করেছেন ৬ হাজার ৭০০ মাইলের বেশি।