গোয়েন্দা হতে চাইলে যা করতে হবে...
নিঝুম রাতের অন্ধকার চিরে দূর থেকে ভেসে এল একটা রাতজাগা শিকারি কুকুরের ডাক। ওই অন্ধকারেই ছোট্ট একটা টর্চ জ্বেলে নিচু দেয়ালের নিচে ঝোপঝাড়ের ভেতরে কী যেন দেখছেন ভদ্রলোক। পোড়া সিগারেটের অবশিষ্ট, ছেঁড়া কাগজ, যা পাচ্ছেন তুলে নিচ্ছেন। হঠাৎ হাতে কী একটা ঠেকতেই অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠে দাঁড়ালেন। চাঁদের আলোয় শরীরের কাঠামোটা চোখে পড়ল। ছয় ফুটের মতো লম্বা, একহারা গড়ন, খাড়া নাকটা এই শীতেও ঘামছেন। পকেট থেকে পাইপটা বের করে আগুন লাগাতে লাগাতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোটাসোটা লোকটির দিকে ফিরে বললেন, ‘কী বুঝলে, ভায়া?’ পাশের লোকটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে বেরিয়ে এল চিরায়ত সেই বাক্য, ‘এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ার ওয়াটসন! এলিমেন্টারি!’
এতটা না বললেও তোমরা ধরে ফেলতে বলে মনে হয়। ভদ্রলোকের নাম শার্লক হোমস। আহ্! সে এক বিরাট স্বপ্নের ব্যাপার, তাই না? ২২১বি বেকার স্ট্রিটের সেই বাসা, ঠোঁটে ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকা পাইপ, ইজিচেয়ারে দুলতে দুলতে অতিথিকে হতভম্ব করে দিয়ে একের পর এক নিভুর্ল অনুমান! বুকে হাত দিয়ে বলত, হোমস হতে ইচ্ছা করে না!
হোমস বাদ দাও। জেমস বন্ড, এরকুল পুয়ারো, রবার্ট ল্যাংডন কিংবা বাড়ির পাশের বোমকেশ বক্সি, ফেলুদা, অজুর্ন, কিরীটী রায়, কাকাবাবু থেকে শুরু করে আমাদের কুয়াশা, মাসুদ রানা বা কিশোর পাশা—হাতছানি দিয়ে ডাকে তো সবাই। একটার পর একটা পাতা উল্টে যায়, আর স্বপ্নটা তেড়ে এসে বলে, ‘আয় বেরিয়ে পড়ি দুনিয়ার যত রহস্যের দ্বার খুলে দিতে।’ স্বপ্ন, গোয়েন্দা হওয়ার স্বপ্ন!
আশপাশে কাকা-মামা কেউ থাকলে কিন্তু খুব একচোট হেসে নেবেন। বলবেন, ‘গোয়েন্দা হবে! তা-ও আবার বাস্তবে? ওসব বইয়ের পাতায় হয়।’ কাকা-মামাদের আর দোষ কী! আমরাও তো তা-ই মনে করতাম, ফেলুদা-হোমস বইয়েই সম্ভব। কিন্তু আসলে দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা একটু অন্য রকম। এই তুমিও চাইলে অপরাধীদের কাঁপিয়ে দেওয়া গোয়েন্দা হয়ে যেতে পারো!
সত্যি বলছি। বাইরের দেশগুলোতে এখন বেসরকারি গোয়েন্দা, আরেকটু ভালো করে বললে ‘প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর’দের খুব দাপট। তাঁরাই এখন বড় ভূমিকা রাখছেন ডায়ানার মৃত্যু, পাতানো ফুটবল ম্যাচ বা ক্রিকেটের জুয়া—এসব দুনিয়া-কাঁপানো বিষয়ে। আচ্ছা, ইউরোপ-আমেরিকার কথা থাক। এই ভারতেও কিন্তু এখন ব্যাপারটা বেশ জমে উঠেছে। মাঝেমধ্যে খবরেও দেখবে, ওদের দেশের বড় বড় রহস্যের কিনারা পেতে সরকারি কর্মকর্তারা পর্যন্ত ‘ফেলুদা’দের স্মরণ নিচ্ছেন।
আমাদের দেশে তাহলে কেন হবে না? হবে না, তা নয়। বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা দপ্তরে অনেক দক্ষ গোয়েন্দা কাজ করে যাচ্ছেন। এই ধরো, পুলিশের তিনটি দপ্তর আছে—এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ), সিআইডি (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট) ও ডিবি (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ)। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আছে এনএসআই আর সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে আছে ডিজিএফআই। এ ছাড়া তিন বাহিনীর নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনীও আছে। তার পরও আমাদের যেটা স্বপ্ন, সেই ফেলুদা-হোমসরা নেই! তবে পথ কিন্তু একটু একটু করে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। হয়তো এই তুমিই বাংলাদেশের শার্লক হোমস হয়ে উঠতে যাচ্ছ।
তো কী করতে হবে, হোমস হতে গেলে? আজকের দিনে একটা ডিগ্রিটিগ্রি থাকলে কাজটা সোজা হয়ে যায়। আমাদের এখানে গোয়েন্দাগিরির পড়াশোনায় খুব সুযোগ-সুবিধা নেই। তবে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটা পথ খুলে দিয়েছে। ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে তারা চালু করেছে অপরাধবিদ্যা ও পুলিশ-বিজ্ঞান বিভাগ। চাইলে এখানে ভর্তি হয়ে রীতিমতো গোয়েন্দা হয়ে বের হতে পারো। তারপর বিভিন্ন বিভাগে চাকরি তো রইলই। না চাইলে ফেলুদা বনে যাও।
আচ্ছা, হোমস-ফেলুদা তো এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে গোয়েন্দা হননি! আমাদের কেন ডিগ্রি নিতে হবে?
নিতেই হবে, তা নয়। নিলে ভালো হয়। নতুবা নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি তো থাকছেই। অনেকে বলেন, গোয়েন্দা নাকি তৈরি হয় না, জন্মায়। ভালো কথা, জন্মগত গোয়েন্দা হলেও তো তার কিছু প্রস্ত্ততি লাগে।
নিজের জ্ঞান-বুদ্ধির সঙ্গে কিছু প্রস্ত্ততি তাহলে জুড়ে দাও। প্রথমেই চোখ-কান বুজে পড়তে শুরু করো (চোখ বুজলে পড়বে কী করে!)। পৃথিবীর তাবৎ গোয়েন্দা সাহিত্য গুলে খেয়ে ফেলো। ফেলুদাসমগ্র, টিনটিনসমগ্র, ব্যোমকেশসমগ্র বাজারে পাবে। কাকাবাবুও পাবে। সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন পুজোসংখ্যা সংগ্রহ করো। দেখবে অসাধারণ সব গোয়েন্দাদের চালচিত্র। সবচেয়ে বড় খোরাকটা পাবে সেবা প্রকাশনীতে। তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, কুয়াশার মতো অবিস্মরণীয় সিরিজ তো আছেই। সেই সঙ্গে বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা কাহিনির অসাধারণ সব অনুবাদ আছে তাদের। হোমস, এরকুল পেয়ারো, জেমস বন্ড—পারলে ইংরেজি পড়ো। না পারলে বাজারে ভালো ভালো অনুবাদও পাওয়া যায়। আর দেখতেও হবে বেশ। তাই শার্লক হোমসের চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজ, টিনটিনের টিভি সিরিজসহ আরও নানান টিভি সিরিজ বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। সংগ্রহ করে দেখে ফেলো। তবে আসল প্রস্ত্ততিটা নিজের ভেতরে। সবার আগে খুব কৌতূহলী হয়ে ওঠো, যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করো—নিজেকে এবং অন্যকে। তবে অন্যদের প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে বিনয়ী হওয়াটা জরুরি। পর্যবেক্ষণের ক্ষমতাটা কিন্তু বাড়াতে হবে। আশপাশের লোকদের দেখে অনুমান করো তাদের পেশা-নেশা-চরিত্র। হোমস যেমন করতেন। এ কাজে চোখটাকে পর্যবেক্ষণের উপযোগী করে তুলতে হবে। কোনো চরিত্র বা স্থানের ছোট্ট বৈশিষ্ট্যটিও সে চোখের এড়ানো চলবে না। লোকদের মুখ দেখে বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করো। মনে মনে নোট নাও, আশপাশে যা দেখছ, মনে রাখো। কাগজ-কলমেও নোট নিতে হবে। সন্দেহজনক কিছু দেখলে খোঁজ নাও। তবে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত না হয়ে পর্যবেক্ষক হওয়া ভালো। বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি, ছোটখাটো বিষয়গুলো একটু খবর রাখো।
দল বেঁধে কাজ করতে পারো। খুব বড় দল না হওয়াটাই ভালো। দল করলে অবশ্যই নেতা ঠিক করতে হবে। ইন্টারনেটের যুগ, মাঝেমধ্যে হলেও ওয়েবসাইট ঘাঁটতে থাকো। নতুন নতুন কৌশল পাবে। ছোটখাটো বিষয় থেকে ‘ক্লু’ আবিষ্কার করার অভ্যাসটা করতে হবে। পত্রিকার পাতায় দেওয়া ধাঁধা, শব্দভেদ, সুডোকুর সমাধান করাটা ভালো অভ্যাস। এটাই কিন্তু তোমাকে ভিঞ্চি কোড-খ্যাত রবার্ট ল্যাংডনের মতো বৈশিষ্টে্যর অধিকারী করে তুলতে পারে। এর কোনোটাই রাতারাতি বললে হয়ে যাবে না। আসলে একধরনের গবেষণা শুরু করতে হবে।
বলা হয়, ‘বিপ্লব পরিবার থেকে শুরু হয়।’ তোমার গোয়েন্দাগিরিটাও তাই করো না কেন? বাসায় ছোটখাটো সমস্যা তো তৈরি হয়ই। এই ধরো, বাবার ঘড়িটা হারিয়ে গেছে বা বড় আপুর কানের দুল। হেসে উড়িয়ে দিয়ো না। অন্য কারও ওপর এসব দোষ চাপাতে না দিয়ে তদন্ত করে দেখো। নিশ্চিত যে, তুমিই সমাধান করে ফেলবে কেসটা। কেস! হয়ে গেল! আজ থেকেই লেগে পড়ছ? তাহলে প্রথম কেস সমাধানের খবরটা জানিয়ে দিয়ো কিন্তু!
হাতের কাছেই রাখো
ম্যাগনিফাইং গ্লাস (সম্ভাব্য ক্লু যাচাই করতে হবে)।
টেপ রেকর্ডার (যাদের সঙ্গে কথা বলবে, প্রমাণ রাখতে হবে। বেশি বেশি নোট নেওয়া থেকে বেঁচে যাবে)।
কাগজ-কলম (কাগজের নোটটাও জরুরি)।
বাইনোকুলার (নজরটা একটু দূর থেকে রাখতে হলে)।
দড়ি (দেয়ালটেয়াল বেয়ে নামতে হতে পারে)।
ক্যামেরা (চোখের দেখা সত্যি নাও হতে পারে। ছবি তুলে রাখো)।
টর্চ (অন্ধকারেই বেশি কাজ কিন্তু)।
ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিট (যদি সম্ভব হয়)।
বেশ কিছু টাকা (কখন কোথায় চলে যেতে হয়, কখন কী কিনতে হয়, কে জানে)।
শুকনো খাবার (ব্রেকফাস্টটা কারও পাঁচিলের পেছনে বসেই সেরে ফেলতে হতে পারে)।
সহজে বহনযোগ্য ভালো একটা ব্যাগ (এসব জিনিস রাখবে কিসে?)।
সাবধান
নিজে অপরাধী হয়ে পড়ো না। আইন মেনে চলো। গোয়েন্দা হওয়া মানে কিন্তু আইনের ওপর চলে যাওয়া নয়!
এমন কোনো পরিস্থিতিতে ঢুকে পড়ো না, যেখান থেকে বের হওয়া কঠিন। সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখলেই পুলিশের সাহাঘ্য চাও। এতে লজ্জার কিছু নেই।
পরিষ্কার প্রমাণ হাতে না পেয়ে কাউকে অভিযুক্ত কোরো না।
সন্দেহভাজনকে হয়রানি কোরো না। উল্টো নিজে পুলিশি ঝামেলায় পড়ে যেতে পারো।
তোমার ওপরই কেউ নজর রাখছে না তো? সতর্ক দৃষ্টি রাখো।
সাবধান! যাকে অনুসরণ করছ, সে কিন্তু বিপজ্জনক হতে পারে।
সর্বোচ্চ প্রস্ত্ততি নিয়ে নাও। যেসব জায়গা থেকে সাহাঘ্য পেতে পারো, তাদের কাছ থেকে আরেকবার নিশ্চয়তা নিয়ে নাও।
গল্পের গোয়েন্দাদের মতো সাজ-পোশাক পরার চেষ্টা কোরো না। দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলবে সবার।