সাপকে অনেকে অপছন্দ করেন কেন

স্কুলের বইয়ে আমরা পড়ি, যারা বুকে ভর দিয়ে চলে, রক্ত শীতল, তাদের সরীসৃপ বলে। উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই আসে সাপের নাম। শেষ গণনা অনুযায়ী পৃথিবীতে ৩ হাজার ৭৮৯ প্রজাতির সাপ আছে। টিকটিকির পর সরীসৃপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হলো সাপ।

বলা হয়, সাপ শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী। কথাটা অবশ্য পুরোপুরি সত্য নয়। সরীসৃপের রক্ত আসলে ঠান্ডা নয়। সঠিকভাবে বললে সরীসৃপ অ্যাকটোথার্মিক। অর্থাৎ, এদের শরীরের তাপমাত্রা পরিবর্তনশীল। সূর্যের শক্তি ব্যবহার করে দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণ করে এরা। পুরোপুরি নির্ভর করে বাইরের আলো ও তাপের উৎসের ওপর। স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখিরা এদের বিপরীত। স্তন্যপায়ী প্রাণীরা শরীরের তাপমাত্রা ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অন্যদিকে উষ্ণ হওয়ার জন্য সরীসৃপদের সূর্যের মতো তাপের উৎস ব্যবহার করতে হয়।

স্কুলে সরীসৃপ নিয়ে আরেকটি তথ্য আমরা পড়ি। সরীসৃপ ডিম পাড়ে। সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে না। তবে মজার ব্যাপার হলো, সব সাপ কিন্তু ডিম পাড়ে না। মানুষ হিসেবে আমরা চারপাশের সবকিছুকে শ্রেণিবদ্ধ করতে চাই। কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম আছে। সাপের ক্ষেত্রে শ্রেণিবদ্ধ নিয়মের বাইরে কিছু বিষয় দেখা যায়। যেমন আনুমানিক ৭০ শতাংশ সাপ ডিম পাড়ে। বাকিরা বাচ্চা প্রসব করে। বিশেষ করে ঠান্ডা জলবায়ুতে বাস করা সাপ জীবন্ত জন্ম নেয়। কারণ, ডিম ঠান্ডায় জমে যায়। ঠান্ডায় ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে পারে না। মরে যায়।

জন্ম থেকেই সাপের ছানারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে। জন্মের পর দুধ পান করতে হয় না সাপদের। স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাচ্চার মতো বড় হওয়ার আগে মায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় না। তাই জন্মের পরই সাপের ছানারা একা একা চলতে শুরু করে। কোনো কোনো সাপের ছানাকে জন্মের পরপরই ফণা তুলে ফোঁসফোঁস করতে দেখা যায়। শিকারী কোনো প্রাণী যেন চট করে খেয়ে না ফেলতে পারে, সে জন্যই এদের এই প্রতিরোধী স্বভাব।

সাপের নাম শুনলে বা সাপ দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে অনেকেরই। ‘ইয়াক’ বলে বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলেন, এমন মানুষও কম নয়। অধিকাংশ সাপই দেখতে পিচ্ছিল। চলেও কিলবিল করে। সাপকে ভয়ংকর কিংবা অস্বস্তিকর লাগার কিছু কারণ আছে। অন্যতম একটা কারণ হলো, সাপের চোখের পাতা থাকে না। কেউ একজন একদৃষ্টে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, একবারের জন্যও চোখের পাতা ফেলছে না, যত শক্ত মনের মানুষই হও না কেন, তোমার গা শরীর শিরশির করে উঠতেই পারে। তার ওপর আবার সাপ চোখের পলক ফেলতে পারে না। চোখ খোলা রেখে ঘুমায়। চোখ রক্ষার জন্য পাতার পরিবর্তে একটা পাতলা ঝিল্লি থাকে। ঝিল্লিকে বলে ব্রিল, জার্মান ভাষায় যার অর্থ চশমা।

সাপকে অপছন্দ করার আরেকটি কারণ হলো, সাপ একটু পরপর জিহ্বা বের করে। জিহ্বা দিয়ে গন্ধ পায় সরীসৃপজাতীয় প্রাণী। এদের নাকে ছিদ্র আছে। তবে এরা নাকের পরিবর্তে জিহ্বা দিয়ে গন্ধ নেয়। টের পায় পরিবেশের আর্দ্রতা। কাঁটাযুক্ত জিহ্বায় থাকে একাধিক রিসেপ্টর, যেগুলো বিভিন্ন মাত্রার রাসায়নিক স্বাদ বুঝতে পারে।

সাপের খাওয়ার ধরনও অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা। সাপ যখন খায়, তখন পুরো খাবার গিলে ফেলা ছাড়া তাদের উপায় থাকে না। কারণ, চিবিয়ে খেতে পারে না এরা। গিলে খাওয়ার সুবিধার জন্য সাপের নিচের চোয়াল হয় অত্যন্ত নমনীয়। তাই নিজের মাথার আকারের তুলনায় ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ বড় প্রাণীও খেতে পারে এরা। খেয়েদেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। পেটের ভেতরের এনজাইম খাবার ভেঙে তরল করে ফেলে।

শহর এলাকায় সাপ তেমন একটা দেখা যায় না। তাদের আবাসস্থল ধ্বংস করে ফেলার ফলে শহর থেকে হারিয়ে গেছে সাপ। তবে গ্রামে গেলে সাপের দেখা পাওয়া যায়। ইন্টারনেটে সাপের অনেক ভিডিও পাবে। এসব ভিডিওতে কখনো সাপের চলাচল খেয়াল করেছ? না খেয়াল করলে তুমি কল্পনা করো, একটা সাপ মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সাপের গতি কেমন হবে? S আকৃতি কল্পনা করতে পারো? সাপের গতির সবচেয়ে সাধারণ রূপ হলো S আকৃতির চলন। সাপের আরও চার ধরনের নড়াচড়া আছে। কোনো সাপ যখন একটি মসৃণ পৃষ্ঠে পালানোর চেষ্টা করে, তখন তার একটি বিশেষ গতি দেখা যায়, যাকে বলে স্লাইড পুশিং। S আকৃতির সঙ্গে সামনের দিকে পিছলিয়ে চলা হলো স্লাইড পুশিং।

সাপ নিয়ে এত কথা বলার কারণ, আজ বিশ্ব সাপ দিবস। সাপ নিয়ে প্রচলিত প্রবাদ হলো, ‘সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে’। এর মানে উভয় দিক বজায় রেখে কাজ করা। আমরা সব দিক বজায় রেখে কাজ করলেও সাপের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিছু হলেই সাপের জান শেষ। প্রাচীন প্রবাদে সাপকে ক্ষতিকর প্রাণী হিসেবে দেখার চল আছে। সাপের কথা ভাবলেই মনে হয়, এই বুঝি কামড়ে দিল। মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়—কথাটা অনেকাংশে সত্য। কিন্তু সাপ না থাকলে মানুষ আরও বেশি মারা যাবে। সাপের একটি প্রধান খাবার ইঁদুর। সাপ ইঁদুর না খেলে পরিবেশে ইঁদুর বেড়ে যাবে। ইঁদুর মানুষের চাষের ফসল খেয়ে ফেলবে। খাদ্যে ঘাটতি তৈরি হবে। মহামারিও নিয়ে আসতে পারে ইঁদুর। তাই সাপকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। সাপ না মারার পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে সাপকে সুরক্ষা দেওয়া যায়