শুনলে হয়তো অবাক হবে। তবু বলছি, পিঁপড়া কিন্তু আমাদের তুলনায় পৃথিবীতে অনেক বেশি প্রভাব রাখে। পৃথিবী থেকে মানুষ যদি অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে বিশ্বের পরিবর্তন হবে নিশ্চয়ই। কোভিডকালে পৃথিবীব্যাপী বিধিনিষেধে মানুষ ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। তখন শহরের রাস্তায় দল বেঁধে নিশ্চিন্তে বন্য প্রাণীদের ঘুরতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের উপকূলে দেখা গেছে গোলাপি ডলফিনের খেলা।
তবে মানুষ যদি পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়, পৃথিবীর জন্য খারাপ পরিবর্তন হবে খুব সামান্যই। কিন্তু পিঁপড়া যদি হারিয়ে যায়, প্রাণের পুরো চক্রই ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি জীবনচক্রের একটা বড় অংশই ভেঙে পড়তে পারে। পিঁপড়া মাটিতে বায়ুর ঘনত্ব বাড়ায়। পরিবহন করে গাছ ও ফসলের বীজ। জৈব পচনে সাহায্য করে। প্রচুর পুষ্টির ভান্ডার হিসেবে কাজ করে পিঁপড়ার ঢিবিগুলো। জীবের জীবনচক্রের জন্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এটি।
মানুষ অবশ্যই পিঁপড়ার চেয়ে বুদ্ধিমান। আকারেও বড়। পৃথিবীতে আমাদের প্রজাতির রাজত্ব তিন লাখ বছর বা তারও বেশি সময়ের। আমরা পৃথিবীকে জয় করেছি। ভূমি, জলজ পরিবেশ আর বায়ুকে এমনভাবে ব্যবহার করেছি, যা প্রাণিজগতের ইতিহাসে অতুলনীয়। কিন্তু পিঁপড়া আর অন্যান্য সামাজিক পোকামাকড়, যেমন মৌমাছি, উইপোকা ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের রেকর্ডটি হাস্যকর।
পিঁপড়ারা পৃথিবীতে আছে প্রায় ১৪ কোটি বছর ধরে। জীবনচক্রে এরা খুব প্রভাবশালী। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভূমিভিত্তিক বাস্তুতন্ত্রে এরা ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে। পিঁপড়া অন্তত ছয় কোটি বছর ধরে চাষ করছে। পাতাকাটা পিঁপড়ারা যেসব পাতা তুলে নিয়ে যায়, সেগুলো সার হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের ঘরের নির্দিষ্ট চেম্বারে ছত্রাক জন্মাতে পাতার সার কাজে লাগায়।
অন্য পিঁপড়ারা এফিড পোকার পাল রক্ষণাবেক্ষণ করে। এফিড হলো রসচোষক ক্ষুদ্র একপ্রকার পোকা, যাকে উদ্ভিদের উকুনও বলা যায়। মানুষ যেমন গরুর পাল মাঠে চড়ায়, ঘাস খাওয়ায়, তেমনি পিঁপড়ারা গাছের রস খাওয়ায় এফিডকে। মাটির নিচে অসাধারণ আর জটিল কলোনি গড়ে তোলে পিঁপড়ারা। তাই দক্ষ স্থপতিও বলা যায় এদের। প্রতিটি সিপাহি পিঁপড়া একটি শক্তিশালী যোদ্ধা। শক্তির মাধ্যমে শান্তি বজায় রাখতে পারে এরা। এমনকি আপস এবং একধরনের গণতন্ত্রও এদের মধ্যে দেখা যায়।
ছোটবেলায় আমাদের অনেকেরই সময় কাটে বাড়ির উঠানে বা ঘরের দেয়ালে পিঁপড়ার চলাচল পর্যবেক্ষণ করে। একটি পিঁপড়া আরেকটি পিঁপড়ার মুখের কাছে এক মুহূর্ত থেমে কী যেন বলে! বোধ হয় পথের কথা। কোন দিকে যাবে? তারপর আবার ছুটে চলে। কার্নিশ বেয়ে কোথায় যেন চলে যায়। কারও কারও মুখে খাবার। কারও মুখে সাদা ডিম। পৃথিবীতে তোমার মতো অনেক ছেলেমেয়েই তাদের বিকেলগুলো কাটায় পিঁপড়া পর্যবেক্ষণ করে। শুধু ছোটরা পিঁপড়া দেখে বেড়ায় এমন নয়, বড় যাঁরা আছেন, কীটপতঙ্গ নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীদেরও সময় কাটে পিঁপড়া দেখে দেখে।
তোমাদের মাথায় নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, একটা দলে কতগুলো পিঁপড়া থাকে? পুরো পৃথিবীতেই–বা কত পিঁপড়া আছে? বিজ্ঞানীদের মাথায়ও এ রকম প্রশ্ন জেগেছে। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, এত পিঁপড়া গোনা সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা গুনে ফেলেছেন। প্রশ্নটার উত্তর একটা বড় সংখ্যা। সংখ্যাটায় যতগুলো শূন্য কল্পনা করছ, তোমার অনুমানের চেয়ে বেশি বেশি শূন্য লাগতে পারে।
নতুন এক হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীতে ২০ কোয়াড্রিলিয়ন পিঁপড়া রয়েছে। প্রত্যেক জীবিত মানুষের বিপরীতে প্রায় আড়াই মিলিয়ন। সম্ভবত পিঁপড়ার সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। ২০ কোয়াড্রিলিয়ন মানে ২০–এর পর ১৫টা শূন্য।
এখন পিঁপড়ারা অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব কটি মহাদেশে ঘোরাঘুরি করছে। জীবনযাপনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে পিঁপড়ারা। এরা খাদ্য সংগ্রহ করে। গাছের বীজ ছড়ায়। মাটি খোঁড়ে। কেউ শুনলে বিশ্বাস করবে না, কিন্তু সত্যিই পিঁপড়ারা সভ্যতার দ্বিতীয় স্তরে বাস করে। সভ্যতার শুরুতে মানুষ শিকার করে জীবন ধারণ করত। এরপর কৃষিকাজ ও পশুপালন শুরু হলো। এখন আমরা শিল্পভিত্তিক সমাজে বাস করছি। পিঁপড়ারা প্রাচীন মানুষের মতো শিকার করে। সঙ্গে কৃষিকাজ ও পশু পালনও করে! দুর্যোগের সময় খাওয়ার জন্য গোলাঘরে ফসল জমিয়ে রাখে। তুমি হয়তো জানো না, পিঁপড়ারা তোমাকে কতটা সাহায্য করে। তুমি কতটা পিঁপড়ানির্ভর?
পিঁপড়া বাস্তুতন্ত্রকে গতি দেয়। নিয়ন্ত্রণও করে অনেকটা। কোনো এলাকার সব জীবসত্তা, গাছ, প্রাণী এবং ক্ষুদ্র জীব একে অপরের সঙ্গে ও চারপাশের পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। এদের মেলামেশায় একধরনের শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে। এটাকেই বলে বাস্তুতন্ত্র। এই যেমন হংকং ইউনিভার্সিটির ইকোলজিস্ট প্যাট্রিক শুলথাইস মনে করেন, বেশির ভাগ বাস্তুতন্ত্র কেবল পিঁপড়া ছাড়াই ভেঙে পড়বে। তিনি তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে একটি পিঁপড়াশুমারি করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে একজন–একজন করে যেভাবে মানুষ গোনা হয়, পিঁপড়াশুমারি তেমন কিছু নয়। তবে এই শুমারি বৈজ্ঞানিক। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এই গণনা করা হয়েছে। গবেষণাটি প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস-এ প্রকাশিত হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ১ হাজার ৩০০টির বেশি জায়গায় ফাঁদ পেতে পিঁপড়ার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন এবং শুষ্ক ঝোপঝাড়সহ বিভিন্ন পরিবেশে কী পরিমাণ পিঁপড়া পাওয়া যায়, তা অনুমান করেছেন। এগুলো শুধু গাছপালায় বাস করা পিঁপড়ার হিসাব। ভূমি বা মাটির নিচে গর্ত করে বাস করা পিঁপড়াদের হিসাবে ধরা হয়নি। দেখা গেছে, এই হিসাবমতে পিঁপড়া আছে ২০ কোয়াড্রিলিয়ন। যদি ভূমির পিঁপড়াগুলোও হিসাব করা যায়, তাহলে বিশাল আকারের আরেক সংখ্যা পাওয়া যাবে। একজন মানুষকে যদি একদল পিঁপড়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সে হয়ে যাবে পঁচিশ লাখ পিঁপড়ার প্রধান! এ রকম করে প্রত্যেক জীবিত মানুষই আড়াই মিলিয়ন পিঁপড়ার সরদার বনে যাবে।
পিঁপড়ার যে পরিমাণ জৈব বস্তু আছে, তা মানুষের বায়োমাসের প্রায় ২০ শতাংশ। পিঁপড়ার জৈব বস্তুর ওজন প্রায় ১২ মেগাটন, যা মিশরের গিজার দুটি পিরামিডের সমান। পিঁপড়ার সংখ্যা এবং বায়োমাসের আগের হিসাবগুলো করা হয়েছিল পৃথিবীর মোট কীটপতঙ্গের সংখ্যার ভিত্তিতে অনুমান করে, যেখানে পিঁপড়ার মোট জৈব বস্তুর জন্য কার্বনের পরিমাণ অনুমান করা হয়েছে ২ দশমিক ৫ মেগাটন থেকে ৭০ মেগাটন পর্যন্ত। বড় একটা স্কেল বা সীমার মধ্যে এই অনুমান করায় নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যেত না।
নতুন গবেষণাটি একটি সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে পেরেছে। এখন আমরা চট করে বলে দিতে পারি, পৃথিবীতে কত পিঁপড়া আছে। পিঁপড়ার প্রকৃত সংখ্যা প্রায় নিশ্চিতভাবেই ২০ কোয়াড্রিলিয়নের বেশি। কারণ, নতুন গণনায় শুধু গেছো বা ভূমির ওপরের পিঁপড়া গণনা করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পিঁপড়াকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলগুলো জীববৈচিত্র্যের হটস্পট। মানে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন ও তৃণভূমিতে গাছপালা এবং প্রাণীদের একটি বড় অংশ বাস করে। পিঁপড়াদেরও একই হারে এসব এলাকায় পাওয়া যায়। হিসাব করে দেখা গেছে, ভূমিতে বাস করা প্রায় ৭০ শতাংশ পিঁপড়া এসব এলাকায় আছে। এ বছর সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত একটি হিসাবে দেখা গেছে, উপক্রান্তীয় অঞ্চলে বিশ্বের সর্বোচ্চ পিঁপড়ার জীববৈচিত্র্য আছে।
নতুন একটি পিঁপড়াশুমারি করা খুব জরুরি ছিল। পোকামাকড়ের বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তন অনুসরণ করার জন্য বিজ্ঞানীদের এদের সম্পর্কে জানতে হয়। পোকার সংখ্যা কমা বা বেড়ে যাওয়া পুরো খাদ্যশৃঙ্খলে প্রভাব ফেলে। আমাদের অস্তিত্বের জন্য পিঁপড়ার হিসাব রাখতে হচ্ছে।