সমুদ্রের অগভীর পানিতে রঙিন পাথর কিংবা উদ্ভিদের মতো দেখতে বস্তুগুলোর নাম প্রবাল। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, এটি হয়তো কোনো উদ্ভিদ। কারও মনে হতে পারে, এটি শক্ত পাথর। প্রবাল আসলে কী? পাথর নাকি এগুলো কোনো উদ্ভিদ, না কোনো জীব? এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের ডুব দিতে হবে প্রবালের রহস্যময় জগতে।
প্রবালকে আমরা প্রায়ই পাথর ভেবে ভুল করি। কিন্তু আসলে এরা জীবন্ত প্রাণী। আমরা যখন প্রাণীর কথা বলি, তখন আমাদের মনে সাধারণত গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, বাঘ, ভালুক, হাতি, ঘোড়া, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদির ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু প্রবাল দেখতে এদের মতো নয়। বরং এদের কিছুটা পাথর বা গাছের মতো দেখায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে প্রায় ৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। প্রতিটি প্রজাতির স্বভাব, আচরণ ও বৈশিষ্ট্য আলাদা। এই বিশাল প্রাণিজগতের মধ্যে প্রবাল একটি অনন্য প্রাণী। কিছু প্রবাল দেখতে শাখাসহ গাছের ঝোপের মতো, আবার কিছু প্রজাতি দেখতে ফুলের মতো। এই অসাধারণ রূপের কারণে দীর্ঘকাল ধরে বিজ্ঞানীরাও নির্ধারণ করতে পারেননি যে প্রবাল আসলে কী? ১৮২৭ সালে ফরাসি প্রকৃতিবিদ হেনরি মারিঁ ডে পেসোনেল প্রথমবারের মতো নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছিলেন, প্রবালগুলো মোটেই সামুদ্রিক উদ্ভিদ নয়, বরং প্রাণী। ফলে প্রবালকে প্রাণিজগতের অংশ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর আগে প্রবালের আবির্ভাব ঘটেছিল।
‘সাইফোনোফোরা’ নামের বিশেষ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এই প্রবাল প্রাণী পলিপ নামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবের সমন্বয়ে গঠিত। এরা একধরনের সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এই ক্ষুদ্র প্রবাল পলিপের আয়তন বয়সভেদে বিভিন্ন রকমের হয়। ১ মিলিমিটার ব্যাসের থেকে শুরু করে ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে এরা। প্রবাল হলো অ্যান্থজোয়া শ্রেণিভুক্ত সামুদ্রিক প্রাণী। অ্যান্থজোয়া ফাইলামে ছয় হাজারের বেশি প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো প্রবাল। প্রবাল পলিপের কেন্দ্রের অঙ্গ স্বচ্ছ ও নমনীয়। এই অঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসে অনেকগুলো তন্ত্র, যা অক্টোপাসের বাহুর মতো নড়াচড়া করে। প্রবালকে বিভিন্ন রঙে দেখা যায়, যার মধ্যে বাদামি, লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রবালপ্রাচীরের জটিল কাঠামো বিভিন্ন ধরনের মাছ ও জলজ প্রাণীর জন্য আশ্রয়, খাদ্য ও প্রজননের জায়গা দেয়। প্রবালের পলিপকে ঘিরে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের আবরণ থাকে বলে প্রবালকে পাথুরে বলা চলে। তবে প্রবাল মূলত প্রাণী।
প্রবাল সাধারণত কলোনি তৈরি করে বসবাস করে। একটি কলোনিতে অসংখ্য পলিপ থাকে, যারা জিনগতভাবে, অর্থাৎ জেনেটিক্যালি অভিন্ন। প্রবাল পলিপ যদিও জেলিফিশের মতো নরম, তবে এরা প্রতিরক্ষার জন্য নিজেদের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বনেট নিঃসরণ করে শক্ত পাথুরে খোলস বা বহিঃকঙ্কাল তৈরি করে। খোলসটি পলিপকে স্থিতিশীলতা প্রদান করে এবং তাদের স্রোত ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। প্রবাল পলিপের দেহে ‘জোয়ান্থোজেলিন’ নামের শৈবাল থাকে। শৈবাল সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে এবং প্রবালের পলিপকে খাবার সরবরাহ করে। পলিপ শৈবালকে নিরাপদে বসবাসের অবলম্বন দেয়। একে বলে মিউচুয়ালিজম। পরস্পরের ওপর নির্ভর করে প্রকৃতিতে টিকে থাকে।
পলিপগুলো মারা যাওয়ার পরও খোলসটি রয়ে যায় সেই স্থানে এবং জায়গা নেয় নতুন পলিপ। এভাবেই মৃত পলিপের কলোনি বহু প্রজন্ম ধরে এভাবে চলার ফলে বড়সড় পাথুরে আকৃতি ধারণ করে, যার থেকে সৃষ্টি হয় বিশাল প্রবালপ্রাচীর কিংবা বড় প্রবাল দ্বীপের।
প্রবালপ্রাচীর বিশ্বের সব মহাসাগরেই দেখা যায়। তবে এগুলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবালপ্রাচীর আছে। এরপর আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর। প্রবাল ২৩ থেকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে বেঁচে থাকে। ৬০-৭০ মিটার সামুদ্রিক গভীরতা প্রবালপ্রাচীরের জন্য সুবিধাজনক। বিভিন্ন ধরনের প্রবালপ্রাচীর রয়েছে, যেমন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ, বেলিজ ব্যারিয়ার রিফ, মেসো-আমেরিকান ব্যারিয়ার রিফ সিস্টেম, রেড সি ব্যারিয়ার রিফ, চাগোস-মালদ্বীপ ব্যারিয়ার রিফ। এ ছাড়া নারিকেল জিঞ্জিরা, যা সেন্ট মার্টিন নামেও পরিচিত বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ।
প্রবালরাজ্য সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্রবিন্দু। সমুদ্রের মাত্র ২ শতাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই রাজ্যে বাস করে ২৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণী। প্রবাল আসলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর এক অপূর্ব মিশ্রণ। বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো ক্যানসার, আর্থ্রাইটিস, ভাইরাসসহ আরও অনেক রোগের ওষুধ তৈরিতে প্রবাল ও সামুদ্রিক প্রাণী ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নানাভাবে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে এই প্রবালপ্রাচীর। সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে ও প্রবালপ্রাচীরকে বাঁচাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ করছে। আমাদের প্রত্যেকের সামান্য প্রচেষ্টা প্রবালপ্রাচীরকে রক্ষা করতে এবং সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তা না হলে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এই প্রাকৃতিক বিস্ময় ধ্বংস হতে ২০ বছরও সময় লাগবে না।