১ মে ২০২৩। সকালে একটি সেসনা ২০৬ বিমান আরারাকুয়ারা থেকে যাত্রা শুরু করে। গন্তব্য কলম্বিয়ান আমাজনের সান হোসে ডেল গুয়াভিয়ারে শহর। আরারাকুয়ারা এলাকাটি আমাজনের পরিচিত এক জঙ্গল। এই যাত্রাপথের দূরত্ব ২১৭ মাইল। ছোট্ট হালকা বিমানটি নিয়ে উড্ডয়ন করেন একজন পাইলট। যাত্রী ছিলেন একজন আদিবাসী নেতা, একজন মা এবং তাঁর চার শিশুসন্তান। আকাশে উড়াল দেওয়ার কিছু পরে পাইলট বুঝতে পারেন, ইঞ্জিনে কিছু গড়বড় হয়েছে। কন্ট্রোল টাওয়ারে সমস্যার কথা জানান পাইলট। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি বলতে থাকেন ‘মে ডে, মে ডে, মে ডে।’ এরপরও ২৬ মিনিট বিমানটি উড়ছিল। পাইলট আবার কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তিনি জানান, বিমানের ইঞ্জিন কাজ করছে না। তিনি নদীর খোঁজ করছেন। ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করবেন। এর কিছুক্ষণ পরই রাডারের বাইরে চলে যায় বিমানটি।
বিমানের কোনো খোঁজ না পেয়ে শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিমানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেতে লেগে যায় এক সপ্তাহ। এ সময় উদ্ধারকারী ব্যক্তিরা তিনজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মৃতদেহ খুঁজে পান। কিন্তু বিমানের অপর চার যাত্রীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বনের ভেতর শিশুদের পায়ের ছাপ, ডায়াপার, আধখাওয়া ফল ও আশ্রয়স্থল দেখে উদ্ধারকারীরা নিশ্চিত হন, শিশুরা বেঁচে আছে। স্বেচ্ছাসেবক, আদিবাসী দলের স্কাউট, প্রশিক্ষিত কুকুর এই উদ্ধার অভিযানে কাজ করে।
এরপর তিনটি উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার কলম্বিয়ান আমাজনের ওপর উড়ে উড়ে লাউডস্পিকারে শিশুদের নানির বার্তা ছড়িয়ে দেয়। নানির কণ্ঠে বার্তাটি ছিল এ রকম, তোমরা একই জায়গায় থাকলে ভালো হবে। এ ছাড়া বনে টিকে থাকতে কী কী করতে হবে, তা লেখা শত শত লিফলেট ফেলা হয়। এক এক করে কেটে যায় ৪০দিন।
৪০ দিন পর গভীর জঙ্গল থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় শিশুদের। গভীর জঙ্গলে এত দিন কীভাবে শিশুরা টিকে থাকল, তা নিয়ে বিস্ময় জেগেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই চার শিশুর একজনের বয়স মাত্র এক বছর।
বিবিসির সংবাদ থেকে জানা যায়, চার শিশু বেঁচে ছিল তাদের নানির শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করে। বুনো পরিবেশে কীভাবে টিকে থাকতে হয়, তা নানির কাছে শিখেছিল এই শিশুরা। সবচেয়ে বড়জনকে নানি খুব ছোটবেলা থেকে গভীর জঙ্গলে মাছ ধরা ও শিকারের কলাকৌশল শিখিয়েছেন। যার নাম লেসলি (১৩)। আর বাকি তিনজন হলো সোলেইনি (৯), তিয়েন (৪) ও ক্রিস্টিন (১)। ওরা সবাই ভাইবোন এবং হুইতোতো জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। শিশুদের নানি জানিয়েছেন, মা যখন ছেলেমেয়েদের রেখে কাজে যেতেন, তখন ছোট ভাইবোনের দেখাশোনা করত বড় বোন লেসলি।
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর তাদের মা বেঁচে ছিলেন তিন দিন। শিশুরা তিন কেজি ‘ফারিনা’ খেয়ে বেঁচে ছিল। ফারিনা হলো কাসাভার ময়দার একটি ধরন, যেটা ততটা মসৃণ নয়। এই খাবার আমাজন অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো খেয়ে থাকে। আমাজন রেইনফরেস্টের ফলের সঙ্গে তারা পরিচিত ছিল। এই ফলই বাঁচিয়ে দিয়েছে শিশুদের।
কলম্বিয়ান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বলেন, উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন শিশুরা তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া খাবার খেয়ে টিকে থাকে। খাবার শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা এমন জায়গার খোঁজ করছিল, যেখানে তারা টিকে থাকতে পারবে।
দুর্ঘটনার তিন দিন পর শিশুদের মা মারা যান। মারা যাওয়ার আগে শিশুদের মা তাদের চলে যেতে বলেন বিমানের ধ্বংসস্তূপ থেকে। শিশুরা সাপ, প্রাণী ও মশায় ভরা জঙ্গলে নিজেদের রক্ষা করার জন্য গাছের গুঁড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল।
দুর্ঘটনাস্থলে একটা ত্রিপল, একটা তোয়ালে, একটা টর্চলাইট আর কিছু কাপড়সহ একটা স্যুটকেস পেয়েছিল লেসলি। ত্রিপলের নিচে তোয়ালে বিছিয়ে বিছানা বানিয়েছে সে। স্যুটকেসে পাওয়া খেলনা মিউজিক বক্সটা কাজে লাগিয়েছে ছোট্ট বোন ক্রিস্টিনের কান্না থামাতে। দুর্ঘটনাস্থলে দুটি মুঠোফোনও পেয়েছিল লেসলি। কিন্তু বনে নেটওয়ার্ক ছিল না। প্রথম দিকে রাতে ভয় কাটাতে মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকত ওরা। কিন্তু একসময় চার্জ শেষ হয়ে যায় মুঠোফোনের।
উদ্ধার তৎপরতার প্রধান জেনারেল পেদ্রো সানচেজ জানান, দুর্ঘটনাস্থল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি ছোট পরিষ্কার করা জঙ্গলে শিশুদের পাওয়া গেছে। উদ্ধারকারী দলগুলো এই জায়গার ২০ থেকে ৫০ মিটারের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু তারা শিশুদের দেখতে পায়নি।
৪০ দিন অল্প পানি এবং সীমিত খাবার খেয়ে শিশুরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অল্প করে খাওয়াদাওয়া করছে। তাদের শরীরে পানির অভাব ছিল। তাদেরকে তরল খাবার খেতে দেওয়া হয়েছে। দ্রুতই ধকল কাটিয়ে উঠেছে সাহসী এই শিশুরা।
উদ্ধারের পর একটি হেলিকপ্টারে শিশুদের কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটার সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। উদ্ধারের সময় থার্মাল ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে মোড়ানো ছিল তাদের শরীর। রাষ্ট্রপতি গুস্তাভো পেত্র, সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তারা এবং পরিবারের সদস্যরা উদ্ধারের পরের দিন শনিবার শিশুদের সঙ্গে দেখা করেন। শিশুদের পানিশূন্যতা ও ম্যালনিউট্রিশনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
উদ্ধারকারীরা এই অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন হোপ’। অভিযান সুন্দরভাবে শেষ হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে চার শিশুকে। এই অনুসন্ধানে সাহায্য করেছে তেলিয়াস ও উইলসন নামের এক জোড়া কুকুর। শিশুদের ঘ্রাণ নাকে তুলে নিয়ে অনুসন্ধান করেছে কুকুর দুটি। লেসলি জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে একটি কুকুর কিছু সময় কাটিয়েছিল। একসময় সেটি চলে যায়। কিন্তু সেটি উইলসন কি না, জানা যায়নি। তবে শিশুদের উদ্ধারের পরও উদ্ধার অভিযান শেষ হয়নি। কারণ, উদ্ধারকারী কুকুর উইলসনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হুইতোতো আদিবাসী গোষ্ঠীর এই শিশুরা বেঁচে ফিরেছে। গভীর জঙ্গলে লড়াই করে টিকে থেকেছে তারা। এমন গহিন জঙ্গলে এত দিন টিকে থাকা সত্যিই বিস্ময়কর। বিশেষ করে শিশুদের জঙ্গলে টিকে থাকার এমন ঘটনা সচরাচর চোখে পড়ে না।