পৃথিবীজুড়ে অন্যতম পাঁচ স্থাপনা বিপর্যয়
বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র, যোগাযোগ কিংবা নিছক নান্দনিকতার জন্য নানা স্থাপনা নির্মাণ করে মানুষ। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন এসেছে স্থাপনা নির্মাণে। মাটি বা কাঠের ঘরদুয়ারের জায়গায় এখন কংক্রিটের বহুতল ভবন শোভা পায় পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায়। চাইলেই অবশ্য নির্মাণ করা যায় না অতিকায় এসব স্থাপনা। এ জন্য রীতিমতো পড়াশোনা করে জ্ঞান অর্জন করতে হয়। নিখুঁত হিসাব-নিকাশ করে নির্মাণ করলে তবেই তা টেকসই হয়।
অনেক সময় নানা প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রিতভাবে স্থাপনা ধ্বংসের প্রয়োজন পড়ে। সে ক্ষেত্রে যাবতীয় সতর্কতা মেনে কাজটি করা হলে প্রাণহানি ঘটে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা এমন ধ্বংসের ভিডিও অনেক দেখেছি। যেহেতু এসব নিয়ন্ত্রিতভাবে করা হয়, তাই বিপর্যয় বলা যায় না। আবার ভূমিকম্প, ভূমিধস, বন্যা বা তীব্র ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগে স্থাপনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ধ্বংস হয়। এসব ক্ষেত্রে মারা যায় অসংখ্য মানুষ।
প্রাকৃতিকভাবে বা মানুষের নিয়ন্ত্রিত স্থাপনা বিপর্যয়ের বাইরে আরেক ধরনের বিপর্যয় ঘটে। আর সেটা হয় স্থাপনা নির্মাণে যথাযথ নিয়ম না মানার কারণে। খামখেয়ালিপনায় যেনতেনভাবে নির্মিত স্থাপনা হঠাৎই ভেঙে পড়ে একটা সময়। হয় প্রাণহানি। পৃথিবীজুড়ে সংঘটিত এমন পাঁচটি স্থাপনা বিপর্যয়ের কাহিনি থাকছে এ লেখায়। শেষে আমাদের বাংলাদেশের একটি ঘটনাও যুক্ত করা হয়েছে।
লোটাস রিভারসাইড কমপ্লেক্স, চীন
২০০৯ সালে চীনের সাংহাই প্রদেশে বহুতল এক ভবন ভেঙে পড়ে নির্মাণকাজ শেষ না হতেই। দিনটা ছিল ২৭ জুন। পুরো ভবনটা যেন একদিকে মাটিতে শুয়ে পড়ে। ভবন হেলে যাওয়া শুরু করতেই কর্মরত সব শ্রমিক সেখান থেকে সরে আসেন। এরপরও একজন নির্মাণশ্রমিক মারা যান। ভবনের অ্যাপার্টমেন্টগুলো ফাঁকা থাকায় প্রাণহানির পরিমাণটা কম ছিল।
নদীর তীরের ২৭২ ফুট জায়গা ভেঙে যাওয়ায় ওই অঞ্চলটিকে ভবন নির্মাণের জন্য অস্থিতিশীল ঘোষণা করা হয়েছিল আগেই। কিন্তু ডেভেলপার কোম্পানি সেই সতর্কবার্তার তোয়াক্কা না করেই কাজ শুরু করে। ফলাফল, পপাত ধরণিতল।
টোকোমা ন্যারো ব্রিজ, ওয়াশিংটন
মূল টোকোমা ব্রিজটি তৈরি হয় ১৯৪০ সালে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সাসপেনশনের ব্রিজের (ঝুলন্ত সেতু) দিক থেকে এটি ছিল তৃতীয় অবস্থানে। ১৯৪০ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিনে সেতুটি উদ্বোধন হয়। প্রায় ৬ হাজার ফুট দৈর্ঘ্যের এ সেতু সে বছরই নভেম্বরে ভেঙে পড়ে। ঘণ্টায় মাত্র ৪০ মাইল বেগে বয়ে চলা বাতাস ঘটনাটি ঘটায়। এর তারগুলো বাতাসের বিপরীতে সেতুকে দীর্ঘ সময় ধরে রাখার মতো যথেষ্ট উপযোগী ছিল না। সৌভাগ্যক্রমে এ দুর্ঘটনায় একজন মানুষও মারা পড়েনি। যাহোক, টাকোমা ন্যারো ব্রিজের এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে আবারও নতুন করে সেতুটি তৈরি করা হয়।
স্যামপুং ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ধস, উত্তর কোরিয়া
১৯৯৫ সালের ২৯ জুন। মাত্র ২০ সেকেন্ডের ব্যবধানে ভেঙে পড়ে উত্তর কোরিয়ার সিউল শহরের এক ডিপার্টমেন্ট স্টোর। এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫০২ জন মানুষ। আহত হন ৯৩৭ জন। স্যামপুং ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ভবনটি ১৯৮৯ সালে অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়। পরে তা ডিপার্টমেন্ট স্টোরে রূপান্তর করার সময় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কলাম ভেঙে ফেলে চলন্ত সিঁড়ি তৈরি করে কর্তৃপক্ষ। শুরুতে কোনো প্রতিষ্ঠানই ভবনের এমন ক্ষতি করে রূপান্তর করতে আগ্রহী ছিল না। পরে একটি প্রতিষ্ঠানকে পাওয়া যায়। তাঁরা কাজটি করে দেয়। ১৯৯০ সালে ডিপার্টমেন্ট স্টোর হিসেবে ভবনটি নতুনভাবে পরিচিতি পায়। সমস্যা দেখায় যায় পাঁচ বছর পর, ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে। ফাটল ধরে নানা জায়গায়। পরে দুই মাসের ব্যবধানে ভূপাতিত হয় পুরো ভবনটি।
রয়েল প্লাজা হোটেল, থাইল্যান্ড
১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে চমৎকার ছয়তলা ভবন ধসে পড়ে। মুহূর্তেই পরিণত হয় কংক্রিটের স্তূপে! থাইল্যান্ডের রয়েল প্লাজার হোটেল ভবনটির ভাগ্যে ঘটেছিল এমন বিপর্যয়। ১৯৯৩ সালের ১৩ আগস্টের সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১৩৭ জন মানুষ। ২২৭ জন আহত হন। ভবনটি সোজা ওপর থেকে নিচের দিকে ভেঙে পড়ে। ভবনের ভারে কলামগুলো যেন নিচতলায় চ্যাপটা হয়ে যায়। একটি কলাম ভেঙে পড়ার পর বাকিগুলোও একই পরিণতি বরণ করে।
এমনটা হওয়ার মূল কারণ ছিল ভবনের ভার সহ্যক্ষমতাকে উপেক্ষা করে একাধিক তলা নির্মাণ করা। একটি ভবন কতটা ভার সহ্য করতে পারবে, তা নির্ভর করে সেখানকার মাটি, ভবনের বেজ বা ভিত্তি, কলাম ইত্যাদি কতটা শক্ত তার ওপর।
রয়েল প্লাজা হোটেলের ক্ষেত্রে সেসব আমলে না নিয়েই ওপরে আরও কিছু তলা যোগ করা হয়। এসব তলার কলাম ভবনের মূল কলামের সঙ্গে যথাযথভাবে যুক্ত ছিল বলে জানা যায়। অতিরিক্ত ভার কলামে ধরে রাখার মতো কাঠামো অকেজো হয়ে পড়েছিল। এরই ফলাফল, ধ্বংসযজ্ঞ আর এতগুলো মানুষের প্রাণহানি।
তিনটি বহুতল অফিস ভবন, ব্রাজিল
২০ তলা ভবন ভেঙে পড়ে একটি ১০ তলা ও একটি তিন থেকে চারতলা ভবনের ওপর। ধসের ফলে তৈরি ধুলোর স্রোত ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। কমপক্ষে ১৭ জন মানুষ মারা যান তাতে।
সৌভাগ্যক্রমে, ভবনগুলো কর্মক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভবনধসের ঘটনাটি ঘটে ছুটির সময়ে। ফলে প্রাণহানির পরিমাণটা কম ছিল। জানা যায়, যথাযথ নিয়ম না মেনে ভবনের সংস্কার ও নির্মাণের কারণে ২০ তলা ভবনটি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে পাশের দুটি ভবনের ওপর লুটিয়ে পড়ে। তিনটা ভবনই হয় ধূলিসাৎ। ২০১২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে ঘটে ভয়ংকর এই ঘটনা।
(আরও ১টি)
রানা প্লাজা, বাংলাদেশ
রানা প্লাজার খবরটি তোমরা অনেকেই দেখেছ। নিকট অতীতে এত বড় মানবিক বিপর্যয় দেশের মানুষ আর দেখেনি। দৃশ্যগুলো কল্পনা করলে এখনো রক্ত হিম হয়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে আসা কান্নার দমক আটকে রাখা যায় না।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভেঙে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ভয়াবহ, সেদিনের সেই দুর্ঘটনায় ১১৩৫ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন আড়াই হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ১ হাজার ১৬৯ জন।
অভিশপ্ত আটতলা সেই ভবনের ওপরের অংশে ছিল পোশাক কারখানা। নিচে ছিল ব্যাংক ও বাসস্থান ও কিছু দোকানপাট। ভেঙে পড়ার আগের দিন অর্থাৎ ২৩ তারিখে ভবনের ফাটল দেখা যায়। নিচের বাসিন্দা ভবন খালি করে চলে গেলেও পোশাক কারখানা চালু রেখেছিল ভবন ও কারখানা মালিক। যথারীতি পরের দিনও কাজে যেতে হয়েছিল হতভাগ্য মানুষগুলোকে। ২৪ তারিখে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর পোশাক কারখানার কার্যক্রম চলমান রাখতে তিনটি বিশাল জেনারেটর চালু করা হয়। যমদূত যেন এরই অপেক্ষায় ছিল। মানুষভর্তি কংক্রিটের ভবনটি যখন ধসে পড়ে, তখন বেশির ভাগ মানুষেরই আর কিছু করার ছিল না।
ওপরের পাঁচটি ঘটনার মতো, এটিও কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলাফল নয়। কিসের ফলাফল আশা করি বুঝতে পারছ। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্মাণ ও কাঠামোজনিত ত্রুটির কারণে বিভীষিকাময় এ ঘটনা ঘটে। “আধুনিক মানবেতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক অ-ইচ্ছাকৃত কাঠামোগত ব্যর্থতাজনিত দুর্ঘটনা (Dhaka garment factory collapse, 2022)” ও “ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী গার্মেন্টস কারখানা বিপর্যয় (Hoskin, 2013)” হিসেবে বিবেচনা করা হয় এটাকে। অর্থাৎ আধুনিক কালে কাঠামোগত ত্রুটির কারণে মানুষের তৈরি অন্য কোনো স্থাপনা ভেঙে এতগুলো প্রাণ ঝরে যায়নি। সহজ কথায় আমাদের খামখেয়ালিপনা আর কিছু মানুষের সামান্য লাভের কারণে এত চড়া মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের।
সূত্র: আর্কটুও ডট কম