প্রকৃতিতে যত আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে অন্যতম আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। কখন ঘটবে, কেউ অনুমান করতে পারে না। অনুমান না করতে পারার কারণ, আগে থেকে তেমন কোনো লক্ষণ টের পাওয়া যায় না। পৃথিবীপৃষ্ঠের নিচে মূল ঘটনা ঘটে বলে সবই থাকে মানুষের চোখের আড়ালে। বাইরে শুধু ফলাফলটুকু দেখা যায়।
আমরা তো জানি, পৃথিবীর ভেতরটা উত্তপ্ত। তরল উত্তপ্ত পদার্থ তাপ পরিচলন করে। তাপ পরিচালিত হয়ে পৃষ্ঠে বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসে। এর সঙ্গে আংশিক গলিত উত্তপ্ত শিলা বেরিয়ে এসে তাপ ছেড়ে ঠান্ডা হয়। ভেতর থেকে পরিচালিত হয়ে আসা বস্তু ম্যাগমা। বাইরে বেরিয়ে এলে বলে লাভা। বিস্ফোরণের সময় দেখা যায় আগ্নেয়গিরির ছাই, যা দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। হাজার কিলোমিটার দূরে ছাই ছড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ‘স্বাভাবিক’।
আল–জাজিরার খবর অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট মারাপির আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছে। গত ৩ ডিসেম্বর দেশটির পশ্চিম সুমাত্রা দ্বীপের ২ হাজার ৮৯১ মিটার চূড়ায় মাউন্ট মারাপি থেকে আকাশে ছাই উদ্গিরণ শুরুর মাধ্যমে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়। এ সময় পাহাড়ে ট্রেকিংয়ে ছিলেন পর্বতারোহীরা। মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত ২২-এ। এর মধ্যে ৯ পর্বতারোহীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।। আহত আরও ১২ পর্বতারোহী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ৬০টির মতো অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটে। কোনো কোনোটি আমাদের চোখে পড়ে। কোনোটি তেমন আলোচনায় আসে না। ইন্দোনেশিয়ার ঘটনাটি আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ইতিহাসে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিখ্যাত রোমান নগরী পম্পেই ধ্বংস হওয়ার ঘটনা। ৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এ নগর ধ্বংস হয়ে যায়। পৃথিবীতে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির সংখ্যা দেড় হাজার। এসব আগ্নেয়গিরি ছড়িয়ে আছে ৮১টি দেশে। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরিসংখ্যান ঘেঁটে বলেছেন, ১৫০০ সালের পর থেকে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ২ লাখ ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে মাত্র ৬টি অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনায়। আগ্নেয়গিরির গ্যাসে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে ক্যামেরুনে, ১৯৮৬ সালে। সে সময় লেক নয়েজ আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত কার্বন ডাই–অক্সাইডে প্রাণ হারায় প্রায় দেড় হাজার মানুষ। ১৯০২ সালে ক্যারিবীয় একটি দ্বীপে নিহত হয় ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ। ২০০০ সালের পর থেকে মারা গেছে প্রায় ২ হাজার মানুষ। এসব মৃত্যুর বেশির ভাগই হয়েছে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান ও গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে।
একটি আগ্নেয়গিরি দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলতে পারে। যেমন পৃথিবীতে যত সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আছে, তার একটি কিলাওয়ে। প্রায় ৩৫ বছর আগে এই আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে বলছে, এখানে সাম্প্রতিক সময়ে অগ্ন্যুৎপাতের মাত্রা বেড়েছে। উত্তপ্ত লাভা পাঁচ কিলোমিটার দূরে চলে গেছে। যেতে যেতে পথে ধ্বংস করেছে বাড়িঘর। সরিয়ে নেওয়া হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। লাভা যে পথ দিয়ে যায়, সেখানে সবকিছু পুড়িয়ে ফেলে। কারণ, উত্তপ্ত লাভার তাপমাত্রা থাকে প্রায় ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বেশির ভাগ আগ্নেয়গিরির সঙ্গে প্লেট টেকটোনিকের সম্পর্ক আছে। প্লেট টেকটোনিক মানে, আমাদের পৃথিবীর ভূত্বক প্রধানত সাতটি বড় এবং কয়েকটি ছোট গতিশীল কঠিন প্লেট বা স্তর দিয়ে গঠিত, যেগুলো এর নিচের উত্তপ্ত পদার্থের ওপর ভাসমান। এই প্লেটের নড়াচড়া ও সংঘর্ষের কারণে ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত ও পর্বত সৃষ্টি হয়।
এসব প্লেট জাপান, আইসল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্য অনেক জায়গায় আগ্নেয়গিরি তৈরি করেছে। আগ্নেয়গিরি মূলত দুটি প্লেটের মাঝখানে তৈরি হয়। বিশাল কঠিন পাথুরে প্লেটের প্রান্তে একটি প্লেট অন্যটির নিচে স্লাইড করে বা ঢুকে যায়। তখন দুটি প্লেটের মধ্যে নিচের ডুবন্ত প্লেটে আটকে থাকা তরল প্রচণ্ড চাপে বের হতে চায়। এই তরলের কাছাকাছি থাকা শিলা গলে যায়। যথেষ্ট তাপ উৎপন্ন হওয়ার ফলে ম্যাগমা তৈরি হয়।
ম্যাগমা আশপাশের শিলাগুলোর চেয়ে বেশি উত্তপ্ত, তাই পরিচলন পদ্ধতিতে (চুলায় পানি ফোটালে গরম পানি ওপরে চলে আসে, ঠান্ডা পানি নিচে যায়। ক্রমাগত চলতে থাকা এই পদ্ধতিকে পরিচলন বলে) এটি ওপরে উঠে যায়। এরপর পৃথিবীপৃষ্ঠের কাছাকাছি খালি জায়গায় উত্তপ্ত ম্যাগমা জমতে থাকে। খালি জায়গা বা চেম্বার পূর্ণ হওয়ার পর চাপ বাড়তে থাকে। সাইকেলের টিউবে বাতাস ভরে যাওয়ার পরও বাতাস দিতে থাকলে যেভাবে চাপ বাড়বে, ঠিক তেমন।
একসময় চাপ বাড়তে বাড়তে চেম্বারের ওপরের শিলার ওজনের চেয়ে নিচের শিলার ঊর্ধ্বমুখী চাপ বেশি হলে ওপরে ফাটল তৈরি হয়। তখনই ফাটল থেকে ম্যাগমা বের হয়, যাকে আমরা বলি লাভা। লাভা আসলে পৃথিবীর অভ্যন্তরের গরম বাতাস, জলীয় বাষ্প, গলিত শিলা, কাদা, ছাই ও গ্যাস। লাভার বিভিন্ন ধরন আছে। কোনোটা খুব বেশি ঘন, গড়িয়ে বেশিদূর যেতে পারে না। কোনো তরলের ঘনত্ব কম, ঠান্ডা হতে হতে বেশ কিছুটা দূরে চলে যেতে পারে। পাঁচ কিলোমিটার দূরের কোনো বাড়ির উঠানে দেখতে পাওয়া যেতে পারে এই উত্তপ্ত লাভা। এত ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়, মানুষ এর সামনে দিয়ে খুব সহজেই হেঁটে চলে যেতে পারে। ঠান্ডা বায়ুর সংস্পর্শে দ্রুত ঠান্ডা হয়ে লাভা হয়ে যায় কঠিন শিলা। এমন শিলা একসময় পর্বতের মতো আকৃতি তৈরি করে!