ইথিওপিয়ার পাহাড়ের ওপর দেয়ালঘেরা এক ছোট্ট শহর হারার। শহরের চারদিকের এ দেয়ালগুলোতে রয়েছে ২০০ বছর, মতান্তরে ৫০০ বছরের পুরোনো কিছু ছোট দরজা। এই দরজাগুলো দিয়ে সেই প্রাচীনকাল থেকে গভীর রাতে শহরে আসে অতিথির দল। তাদের পছন্দের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করে হারারবাসী। আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি রাখে না তারা।
হ্যাঁ, শুনলে অবাক লাগবে, কিন্তু শহরবাসীর সঙ্গে আবহমানকাল ধরে এমন আন্তরিক আতিথেয়তার সম্পর্ক আসলে হায়েনাদের। হারারের লোককাহিনিতে বলা হয়ে থাকে, উনিশ শতকের এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় শহরের বাইরের জলাভূমি অঞ্চলে বসবাসরত হায়েনার দল আক্রমণ করে হারার শহরে। ধ্বংস করে ফসলের খেত, এমনকি প্রাণহানিও ঘটে কিছু মানুষের। এমন দুর্ঘটনা এড়াতে স্থানীয় এক কৃষক হায়েনাদের পরিজ বা পায়েস খাওয়ানো শুরু করে। পরবর্তী সময়ে প্রথার রূপ নেয় ব্যাপারটা। আবার অনেকে বলে, হায়েনাদের পায়েস খাওয়ানোর এ রীতি শুরু করেন এক ধর্মপরায়ণ মানুষরা। প্রথার প্রচলন নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি আছে। তবে হায়েনাদের আক্রমণ থামাতে এটি বেশ কার্যকরী প্রথা ছিল, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত শোনা যায় না। প্রায় দুই শতকের পুরোনো এ প্রথার স্মরণে এখনো প্রতিবছর আশুরার দিনে হারারের মানুষ খাঁটি মাখন দিয়ে তৈরি পায়েস পরিবেশন করে হায়েনাদের। তারা মনে করে, হায়েনা দলের নেতা প্রথমে পায়েসের স্বাদ নিরীক্ষণ করে। খাবার তার মনমতো হলেই খেতে শুরু করে অন্য হায়েনারা। এ ছাড়া হায়েনাদের পায়েস খাওয়ার ধরন থেকে তারা নানা ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে। যেমন, হায়েনারা যদি অর্ধেকের বেশি পায়েস শেষ করে তবে তারা মনে করে, আগামী বছরটা সাফল্যে কাটবে। আর যদি হায়েনারা পায়েস না খায় বা পরিবেশিত পায়েসের পুরোটা খায়, তবে তারা ধরে নেয় যে আগামী বছর অশুভ বা দুর্ভিক্ষে কাটবে।
তবে হায়েনাদের নিয়মিত খাবার দেওয়ার প্রথা ১৯৬০ সালের আগে ছিল না। তখন থেকেই শহরের একটি নির্দিষ্ট পরিবারকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হায়েনাদের খাবার দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। হায়েনাদের যারা খাবার পরিবেশন করে, তাদের বলা হয় ‘হায়েনা ম্যান’, অনেক সময় বংশানুক্রমেও এ দায়িত্ব অর্পিত হয়। এমনই এক হায়েনা ম্যান আব্বাস ইউসুফ জানান, ‘আমার আগে আমার বাবা ইউসুফ মুমে সালেহ হায়েনাদের খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করেছে। আমিও প্রায় ১৩ বছর ধরে এ কাজ করছি। আমি কাজটি চালিয়ে যাওয়ায় আমার বাবা খুব গর্বিত এবং আমারও ভালো লাগবে যদি আমার সন্তানেরা কাজটি অব্যাহত রাখে।’ তিনি আরও জানান, হায়েনাদের খাবার দেওয়া শুরু করার পর তারা আর কখনোই শহর আক্রমণ করেনি। খাবার পেলে আর তাদের বাচ্চারা নিরাপদে থাকলে তারা আর কোনো ক্ষতি করে না। হায়েনাদের খাবার পরিবেশন করতে করতে ইউসুফ ও হায়েনাদের মধ্যে এক অদ্ভুত সখ্যও গড়ে উঠেছে। হায়েনাদের আচরণ অনুযায়ী তিনি নানা নামে তাদের ডাকেন। এমনকি ইউসুফের বাড়িতে শোবার ঘরেও একটি শিশু হায়েনা রয়েছে।
আব্বাস ইউসুফের কাজটি বর্তমানে হারারের পর্যটকের কাছেও এক দেখার মতো বিষয় হয়ে উঠেছে। হারারের পুরোনো মসজিদ দেখতে আসা পর্যটকেরা আজকাল প্রায়ই ইউসুফকে কেন্দ্র করে ভিড় জমান। আর ইউসুফ নানা পদ্ধতিতে নাম ডেকে, হাতে করে, এমনকি নিজের মুখ দিয়ে হায়েনাদের খাবার দেন।
শহরের অন্যান্য মানুষও হায়েনাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে। যেমন আনিসা মোহাম্মাদ নামের ৩২ বছর বয়সী এক রুটি বিক্রেতা মনে করেন, হায়েনারা না থাকলে হারারে শহর এতটা পরিষ্কার হতো না। কারণ, মানুষ দিনের বেলা শহরে যত আবর্জনা জমায়, তার সবই রাতে হায়েনারা খেয়ে যায়।
পাহাড়ের ওপরের এই ছোট্ট শহর হারার ২০০৩ সালে ইউনেসকোর ‘সিটি অব পিস’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল নানা ধর্মাবলম্বী মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণে। কিন্তু শুধু মানুষের মাঝেই নয়, তারা এ সম্প্রীতির হাত প্রসারিত করেছে পশুদের প্রতিও। তাই তো এই একবিংশ শতাব্দীতেও হায়েনার মতো এক ভয়ানক শিকারি প্রাণীর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে হারারবাসী।